এখন এই হাজার বছরের মাথাব্যাথা নিয়ে কি করা যায়? আমরা কাদেরকে সুন্দর বা সুন্দরী বলি? কাদেরকে অসুন্দর বলি? সেটা কিভাবে বোঝা যায়? আসলেই কি কোন মানদন্ড আছে? যেমন নাকটা অতটুকু উঁচু হলে, অথবা চোখদুটো সেই পরিমাণ টানাটানা হলে সুন্দরী বলা যায়। হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু আছে, যেমন অতিরিক্ত মোটা মানুষের চেয়ে হ্যাংলা মানুষকে দেখতে ভালো দেখায়, বা টাকমাথার চেয়ে মাথায় চুলওলাদের বেশী ভালো দেখায় -- এরকম খুব পরিস্কার প্যারামিটার আছে (মোটা বা টাকমাথারা খেপবেননা, কারণ আমি নিজেও ঐ দুটো দলের মধ্যেই পড়ি)। সেখানেও আবার সমস্যা আছে, নায়িকা মৌসুমী বেশী সুন্দরী না ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল বেশী সুন্দরী, সে প্রশ্নে হয়ত এখনও মৌসুমীর দিকেই বেশী ভোট যাবে।
আবার আরেকটা কথা আমরা প্রায়ই শুনি, সবার কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একইরকম না। যেমন কারো হয়ত ক্লাসমেটদের মধ্যে শীলাকে বেশী পছন্দ, কারও হয়ত মিলাকে। কেউ বলে টম ক্রুজ, কেউ বলে কিয়ানু রীভস; কেউ মাধুরীর জন্য পাগল, কেউ ভাবে ঐশ্বরিয়া মানুষ না, পরী। এরকম মতভেদ হয়ই। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, হয়ত এই মতবিরোধটা কে কার চেয়ে বেশী সুন্দর সেখানেই সীমাবদ্ধ। সবাই কিন্তু স্বীকার করছেই যে, বিপাশা ও শমী দুজনেই সুন্দরী। কে বেশী, কে কম সেখানে ঝামেলা হচ্ছে। আবার যে দেখতে ভালোনা, তার ব্যাপারেও সবাই কিন্তু একমত হচ্ছে যে হ্যাঁ, ঐ মেয়েটা/ছেলেটা দেখতে খারাপ। কাজেই বলা যায় যে, আসলে আমাদের মাঝে সৌন্দর্য মাপার একটা মাপকাঠি প্রোথিত আছে, যেটা মোটামুটি সবার ক্ষেত্রেই একরকম।
কথা হলো, এই সৌন্দর্যের মাপকাঠিটা কি?
তার আগে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা বলি। আমি সাধারণত বছরে একবার দেশে যাই, মাসখানেক থাকি। তো, দেশে গিয়ে প্রথম কয়েকদিন শুধু মনে হতে থাকে, "আহা, জাপানী মেয়েগুলো কত সুন্দর ছিল! বাঙালী মেয়েগুলো কেমন কেমন!" অথচ, একসপ্তাহ কাটতে না কাটতেই দেখা যায়, রিক্সায় বসা বা মার্কেটে শপিং করতে আসা বেশ কিছু মেয়েকে দেখেই মনে হচ্ছে, "আরে! হেভী তো!" তারপর মাসখানেক ছুটি কাটিয়ে যখন জাপানে ফিরে আসি, প্রথম কয়েকদিন মনে হয়, "ধুর! জাপানী মেয়েগুলা কেমন! আহা, দেশে কত কত সুন্দরী দেখে আসলাম!" আমার দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়। আপনারও কি এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি?
(এখন অবশ্য ঘটনা ভিন্ন, এটা বলতেই হবে, কারণ আমার বউ মাঝেমাঝে ব্লগ পড়ে, এবং আমি প্রতি বেলা আরাম করে খেয়েদেয়ে সুখে থাকতেই আগ্রহী , বউ রেগে গিয়ে রান্না বন্ধ করে দিলে এবয়েসে পেটে সইবেনা)।
জাপানে একটা কথা প্রচলিত আছে, "সুন্দরীর মোহ তিনদিনে কেটে, আবার তিনদিন একসাথে থাকলে পেত্নীকেও সুন্দরী মনে হয়।" -- একথাটার সাথে কি আপনি একমত।
অথবা, এ ব্যাপারটা কি আপনি জানেন? প্রায় সবপুরুষের চোখে যতই দিন যায় স্ত্রী ততই সুন্দরী হয়ে ওঠেন। অনেকেই হয়ত স্বীকার করতে লজ্জা পাবেন, তবে ব্যাপারটা বাস্তব। অধিকাংশ পুরুষই নাকি ভাবেন তার সংস্পর্শে এসে তার নারী সুন্দরতর হয়ে উঠেছে (একশোভাগ পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা -- এক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে শুনেছি, আমি জানিনা, উনি নিজে কতটুকু ঠিক আছেন)।
আপনি একমত হোন বা নাই হোন, বিজ্ঞান বলছে উপরের ঘটনাগুলো ঘটছে, অহরহ। একটা ছোট প্রমাণ দেই। ফুটবল খেলার ভিডিওগুলো দেখলে বুঝবেন, ধরুন আপনি যদি সেই মেক্সিকো'৮৬ এর ম্যারাডোনার খেলাগুলো আজ টিভিতে দেখেন, আপনার মনে হবে সব কেমন ক্ষ্যাত ছিল! অথচ চিন্তা করে দেখুন, সেই ৮৬তে কি মনে হয়নি "আরে কি মাঞ্জা!!"? অথবা, দশ পনের বছর আগের নিজের ছবি দেখুন। অথচ একবার চিন্তা করে দেখুন তখন কি নিজেকে হিরো ভাবতেননা? তাহলে এখন কেন এমন অস্বস্তি বোধ করেন? এটার উত্তরও এখানে পাওয়া যাবে।
এজন্য যে পরীক্ষাগুলো বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা চালিয়েছেন সেগুলো একটু একটু করে বর্ণনা করব। (ডিসকভারি চ্যানেল বা কোন সাইটে পড়েছিলাম, পরীক্ষাগুলো কারা চালিয়েছেন, এখন একদম মনে করতে পারছিনা। যতদূর সম্ভব হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানীদের একটা গ্রুপ শুরু করেছিলেন।)
প্রথমে তারা দেখতে চেয়েছিলেন যে , সুন্দর বা এ্যাট্রাকটিভ চেহারা এবং সহজেই চোখে পড়ে বা ডিসটিংকটিভ চেহারার মাঝের সম্পর্ক বা কোরিলেশন কি। এখানে সুন্দর বা এ্যাট্রাকটিভ বলতে বোঝাচ্ছে একটা ছবি দেখে আপনি মনে মনে বলবেন, "ওয়াও!!", আর ডিসটিংকটিভ চেহারা বলতে বোঝানো হচ্ছে, ধরুন একদল মানুষের মাঝেও যে চেহারাটা সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করে বা আলাদা করে মনে থাকে। স্বভাবতই আমরা ভাবি যে যে যত এ্যাট্রাকটিভ সে তত ডিসটিংকটিভ।
এই কোরিলেশনটা খুঁজতে গিয়েই তারা যে পরীক্ষণটা করেন তা হলো, প্রথমে একদল সবাজেক্টকে(মানুষকে) কতগুলো ছবি, ধরুন পঞ্চাশজন মানুষের মুখের ছবি দেখান একটা একটা করে। যারা ছবিগুলো দেখেন, তারা প্রত্যেকটা ছবিকে ১ থেকে ১০ এর স্কেলে সোন্দর্য্যের মানদন্ডে একটা নাম্বার দেন। অর্থাৎ, ঐশ্বরিয়ার মতো ফাটাফাটি সুন্দরী পাবে নয়/দশ, আর ধরুন আরনল্ড শোয়ার্জনেগার পাবে দুই বা বড়জোর আড়াই। এই পরীক্ষায় অবশ্য পরিচিত স্টার বা ব্যাক্তিত্বদের ছবি ব্যবহার করা হয়নি।
সবার দেয়া নাম্বার বিচার করে গবেষকরা পঞ্চাশটা ছবিকে সুন্দর থে অসুন্দর রেটিংয়ে সাজালেন। তারপর সবচেয়ে সুন্দর ১৫টা ছবি আর সবচেয়ে অসুন্দর ১৫টা ছবি আলাদা করলেন। এই আলাদা করা ১৫ + ১৫ = ৩০ টা ছবির সাথে এখন তারা আরো ৩০ টা নতুন ছবি যোগ করলেন। মোট হলো ৬০ টা ছবি, যেগুলো দিয়ে তার পরের পরীক্ষাটি করেন। কয়েকসপ্তাহ পর আগের সাবজেক্টদেরকে এই ৬০ টি ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় কোন ছবিগুলোকে তারা আগে দেখেছে সেগুলো সিলেক্ট করতে। স্বভাবতই যে ১৫টি সুন্দর ছবিকে তারা আগে দেখেছে সেগুলোর বেশী সিলেক্টেড হবার কথা।
কিন্তু ফলাফল বলল, যে ৩০ টি ছবি তারা আগে দেখেছে তার প্রত্যেকটিই মোটামুটি কাছাকাছি সংখ্যকবার সিলেক্টেড হয়েছে। এখানে সুন্দর অসুন্দরের মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই। তারমানে কি দাঁড়ালো, মানুষ সুন্দর চেহারাকে অসুন্দর চেহারার চেয়ে বেশী মনে রাখে এমন ধারনা ভুল, মানে ভিড়ের মাঝে যাদের আলাদাভাবে চোখে পড়ে তারা সুন্দরও হতে পারে, অসুন্দরও হতেপারে।
এখন ভাবতে হবে ভীড়ের মাঝে কাদের আলাদাভাবে চোখে পড়ে?
বলাইবাহুল্য, যাদের চেহারা এভারেজ মানুষের চেহারার চেয়ে বেশী আলাদা তাদের।
তারমানে, সুন্দর/সুন্দরীদের চেহারা এভারেজ মানুষের চেহারার চেয়ে আলাদা না?
বলে কি? গবেষকরা মজা পেয়ে গেলেন।
(চলবে ...)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ২:২৭