জানি, তুমি আমার ফাঁসি দাবি করে এসেছ। এজন্য তোমার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। সেই শৈশবে যেদিন তুমি অসহায় ছিলে, তখন আমি তোমাকে আনতে যাইনি, তোমার মাদ্রাসার হুজুরই কোথাও থেকে তোমাকে এনে ছাত্রাবাসে আশ্রয় দিয়েছেন, লিল্লাহ-সদকা-কোরবানির চামড়া মেগে এনে তোমাকে তিনিই পেলেপুষে বড় করেছেন। সুতরাং তোমার ওস্তাদ তোমার পিতৃতূল্য অভিভাবক, তাঁর নির্দেশে সাড়া দিয়ে তুমি আজ এই রাজধানীতে আমার ফাঁসি চাইতে এসেছ।
অথচ আমি কখনোই তোমার প্রতিপক্ষ ছিলাম না। বিশ্বাস করো, আমিও সামান্য মানুষ, আমার পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল পুকুর পাড়ে, আমার ধর্ষিতা মা কে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছিল বাড়ির উঠোনে, আমি শুধু সেই নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে রাজপথে নেমেছিলাম।
অথচ ঘাতকেরা খুব কৌশলী, ঘাতকদের অনেক টাকা, সেই টাকায় কেনা রাশি রাশি জ্ঞানপাপী মানুষ। তারা ঠিকই একটা না একটা দাবার ছকে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলবে-এই সত্যি আমি বরাবরই জেনে এসেছি। অতপর তারা আমার বিরুদ্ধে তোমাকে উস্কে দিয়েছে। বাকি সবই যুক্তি-কুযুক্তির বেড়াজাল, সত্য শুধু এটুকুই, তারা আমার বিরুদ্ধে নিজেরা না পেরে তোমাকে উস্কে দিয়েছে।
আমি এখন যতবারই বলি আমি মুসলিম, তারা তোমাকে সেটা বিশ্বাস করতে দেবে না। প্রয়োজনে তারা নিজেরাই আল্লাহ আর মহানবী( সাঃ ) কে অসম্মান করে সেই অসম্মানের দায় আমার কাঁধে ফেলে রাখবে। আমি তোমার দিকে হাত বাড়ালে তারা চিৎকার করে বলবে, ঐ নাপাকের হাত স্পর্শ করিস না রে, আর তুমি আঁতকে উঠে দূরে সরে যাবে।
আমি তোমার দরজায় যেতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম একদিন তুমি আর আমি বসে সবগুলো গল্প করি, তোমাকে জানাই কীভাবে আর কেন আজ তুমি আর আমি প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলাম। আমাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি। ঘাতকেরা দাবার গুটিতে চাল দিচ্ছে আর তুমি রেগেমেগে চিৎকার করে বলছ-নাস্তিকের সঙ্গে কোনো আলাপ নেই, আমি তার কল্লা চাই।
এই দায় তোমার নয়। আমরা এমন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি, যেখানে তুমি আর আমি একই ইতিহাস বই পড়ে বড় হয়ে উঠব, একই বিদ্যায়তনের বেঞ্চে বসে কাটাকুটি খেলে খেলে বড় হব। তুমি ক্লাসে ফারসি পড়েছ, আমি ইংরেজি পড়েছি-রাষ্ট্র তো সেই ছোটবেলায়ই তোমার আর আমার ভাষাকে ভিন্ন করে দিয়েছে-আজ যদি আমরা একই ভাষায় কথা বলতে না পারি, সেই দায় তবে তুমি একলা নেবে কেন? আর তাই আমরা এমন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি যেখানে তুমি আর আমি মিলে পরষ্পরকে একটাও গালি না দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করে কোন একটা সিদ্ধান্তে একমত হয়ে এক কাপ চা খাব। তোমাকে কাঠমোল্লা ভেবে, আনপড় গোঁয়ার ভেবে আমি উপহাস করব না তরুণ, তুমি তো আমারই হারিয়ে যাওয়া ভাই, আজ ভাগ্যের ফেরে আর ভ্রষ্টদের প্ররোরচনায় সেই তুমিই ভাবছ আমায় বিভ্রান্ত শত্রু।
লাঠি-গুলি-টিয়ারগ্যাসের ভয়কে জয় করে তুমি আজ ঢাকা শহরে আমার মাথাটা কেটে ফেলার দাবি নিয়ে এসেছ তরুণ। আমি তবু তোমার মঙ্গল কামনা করি। তোমাকে যারা প্ররোচিত করল আমি তাদের অভিসম্পাত দিব, কিন্তু তোমার মঙ্গল কামনা করা থেকে বিচ্যুত হব না।
আমি কায়মনে দোয়া করি, এই ইট-কাঠ-বর্গার শহর থেকে তুমি আবার নিরাপদে তোমার মায়ের কোলে ফিরে যেও।
তোমাকে অভিবাদন।
শাহবাগ থেকে
তোমারই নাম না জানা কোনো এক ভাই
মূল লেখার লিঙ্ক