বেশীরভাগ শিক্ষিত নাস্তিকই বস্তুবাদী, বস্তুবাদীদের প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। বস্তুবাদে যুক্তিই মুখ্য, অথচ ভালোবাসা যুক্তিহীন এক বোধ। বস্তুবাদে আবেগ মূল্যহীন, আবেগকে দেখা হয় একধরনের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে, চৈতন্যকে দেখা হয় কার্যকারনরূপে। কিন্তু আমরা জানি ভালবাসা মানেই আবেগ যা কোন যুক্তির ধার ধারেনা, ভালবাসা এমন এক ব্যাখাতীত জিনিস যার জন্যে ঘর ছাড়তে পারে বিত্তশালী লোকের সন্তান কোন বিত্তহীনের সাথে, তিন সন্তানের মা স্বামীসন্তান ছেড়ে পালাতে পারে তার চেয়ে কমবয়েসী কারো সাথে, মাঝে মাঝে নানী সম্পর্কীয় মহিলার সাথেও প্রেমের সম্পর্কের কথা শোনা যায় শুধুমাত্র এই ভালবাসার কারনে, বাংলা সিনেমার ভাষায় বলা যায় – ‘প্রেম মানেনা বাঁধা’। আজকে আমরা দেখবো প্রকৃত বস্তুবাদীদের ভালোবাসার অভিনয় কেমন হতে পারে।
বস্তুবাদীরা সব জিনিসের পেছনেই কারন খুঁজেন তাই তাদের এই ভালবাসার পেছনেও কোন না কোন কারন থাকবে সেটা আর বলতে হয়না, ভালোবাসার পেছনে কোন কারন অর্থাৎ স্বার্থ থাকবেই থাকবে। সেই ভালবাসার পেছনের কারনগুলো কি কি হতে পারে চলুন অনুমান করি, কারন অথবা ফ্যাক্টরগুলো হতে পারে- মেয়ের ফিগার, মেয়ের বাবার টাকা, মেয়ে স্বাবলম্বী কিনা অর্থাৎ ভবিষ্যতে সংসারে কনট্রিবিউট করতে পারবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথমে ফিগারের কথাই আসবে তাদের মাথায় এর কারনও হচ্ছে যুক্তি, যুক্তি বলে যে বাতি নিভালে সবই একই রকম, থাকে শুধু অন্ধকার, অনুভব করিবার একটা বস্তু। সৌন্দর্যেয় ভর নেই, সৌন্দর্য স্থান দখল করেনা, সৌন্দর্যের আকার কিংবা আয়তনও নেই তাই সৌন্দর্য কোন বস্তু নয়, বস্তুবাদে বস্তুই মুখ্য অন্যসব গৌণ, এতে কি প্রমানিত হলো? এতে প্রমানিত হলো যে বস্তুবাদীদের কাছে সৌন্দর্যের কোন দাম নেই, অনুভবকৃত বস্তুটি অথবা মাল’টি নরম নাকি শক্ত, আকারে ছোট নাকি বড়, সাদা নাকি কালো সেটা বিবেচনাই মুখ্য।
ভাইসব, প্রথম দিকে একটু কঠিন কঠিন কথা বলতে হচ্ছে, নিরাশ হইয়েন না, শেষের দিকে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, কোনকিছু স্কিপ না করে সাথেই থাকুন। যাই হোক, প্রসঙ্গে আসি, বস্তুবাদীরা তাদের যুক্তি খাটিয়ে জানেন যে ‘economy faces trade off’, অর্থাৎ সোজা বাংলায় ‘একই সাথে গাছেরটা খাওয়া আর তলারটাও কুড়ানো যায় না’, একদিক দিয়ে ছাড় দিলে অন্যদিক দিয়ে পুষিয়ে নিতে হয়। ধরেন মালটির ফিগার (বস্তু আর মাল আমার কাছে একই শব্দের প্রতিশব্দ মনে হয়) ভালো না, তখন মাথায় অন্যান্য ফ্যাক্টরের কথা এনে বস্তুবাদীরা চিন্তা করবে অপটিমাইজেশনের কথা, ‘ফিগার ৪৫-৪৫-৪৫ ঠিক আছে চলে, মাইয়ার বাপের অবশ্য টাকা আছে, আর নইলে মাইয়া ভালো চাকরিতো করে… লেলে মামু… লেলে… (:নিয়ে নে…’। এতোসব হিসেব নিকেশ বিশ্লেষনের পর বস্তুবাদীরা যে সম্পর্ক তৈরী করেন এটাকে ভালোবাসা বলেনা, এটাকে বড়জোর ‘চুক্তি’ বলা যায়। ভালোবাসা হবে অকারনে, ভালোবাসা হবে হাসি দেখে, একজনের মাথার সামনের দিকের চুলগুলো মৃদু বাতাসে হালকা এলোমেলো হয় সেই দৃশ্য দেখে, কিংবা কোন মেয়ের চোখ মুখ কুঁচকানো ‘ধূরো!’ বলার ভংগী দেখে…!!
ধরেন তারপরেও কোনভাবে কোন বস্তুবাদীর অন্য এক মেয়ের সাথে চুক্তি হলো, সমাজ সেই চুক্তির নাম দিল ভালবাসা, সেখানেও সমস্যা আছে। বস্তুবাদে ত্যাগ বা স্যাক্রিফাইসের কোন স্থান নেই, এমনি এমনি কেউ কাউকে কিছু দিয়ে দেবে সেটাকে ইকোনমিক্স সাপোর্ট করেনা, ইনভেস্টমেন্টের অবশ্যই প্রফিটিবিলিটি থাকতে হবে। আর বস্তুবাদে মাল বা বস্তু থেকে প্রাপ্ত যৌনসুখটাই মুখ্য, সেখানে ভালবাসা নামক কোন অনুভূতির স্থান নেই। ধরেন তাদের দুজনেরই একটা কমন স্বার্থ যৌনসুখের জন্যে তারা এই চুক্তিতে গেল, বস্তুবাদ মানলে সেখানে একটা শর্তই থাকবে, সেটা হচ্ছে সাম্যবাদ, অর্থাৎ গিভ এন্ড টেক, টেক আন্ড গিভ; কেহ কারে নাহি ছাড়ে টাইপ অবস্থা, দুজনের সমান অধিকার, কেউ কাউকে কেন কোন ছাড় দেবে! আর সেখানেই সমস্যা, ব্যাখা করছি ব্যাপারটা।
ধরেন সাম্যবাদে চুক্তিবদ্ধ দুইজন বস্তুবাদী বিছানায় গেলো, সমস্যার উৎপত্তি সেই বিছানায়ই, আমি পুরো ‘কামসূত্র’ ঘেঁটে দেখেছি সেই আকামসূত্রে সাম্যবাদ ফলো করা হয়নি, বেশীরভাগ আসনে পুরুষদের প্রাধান্য, বেশীরভাগ আসনই পুরুষবাদী। নারীবাদী আসন আছে অল্পকিছু, আর সাম্যবাদী আসন আছে মাত্র একটা। সেই সাম্যবাদী আসনেও একজনকে এক পা হেলিয়ে সামান্য একটু স্যাক্রিফাইস করতে হয়। বস্তুবাদীদের তাহলে কি হইবেক…??? :’(
সমস্যা আরো আছে। এটা সত্য যে সংসারের কাজকর্ম স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ভাগাভাগি করে করা উচিত, কিন্তু যারা হার্ডকোর সাম্যবাদে বিশ্বাসী অথবা বস্তুবাদী তাদের ভাগাভাগিটা হবে এইরকম, ‘আমি পাতিলের অর্ধেকটা ধুইছি বাকি অর্ধেক পাতিল তুমি ধোও, আমি চামচের ডগাটা ধুয়েছি তুমি চামচের ডান্ডাটা ধোও’, কি একটা সমস্যা না বলেন…??? সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় গর্ভধারনের সময়, দুজনের সন্তান নারী্সঙী একা কষ্ট করে জন্ম দেবে কেন? এ ব্যাপারে জনৈক বস্তুবাদী বলেনঃ ”নারীর গর্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ। নারীকে কি চিরকালই ধারণ ক'রে যেতে হবে, পালন ক'রে যেতে হবে পশুর ভূমিকা? গর্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুরই মতো, দৃশ্য হিশেবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক”। [নারী, হুমায়ূন আজাদ]
নারীর একা সন্তান জন্ম দেয়ার বিষয়টা বস্তুবাদীদের কাছে পাশবিক মনে হয়, পাশবিক মনে হলেও হূমায়ূন আজাদ স্যার নিজেই এক নারী অর্থাৎ তার স্ত্রীকে তিনজন সন্তান জন্ম দেয়ার মত পাশবিক কাজে বাধ্য করিয়েছেন। তসলিমা নাসরিনের কোন এক বই পড়ে জেনেছিলাম সন্তান জন্মদানের মতো ঝামেলাযুক্ত কাজে তিনি যাবেন না, ভাগ্যিশ উনার মায়ের এমনটা মনে হয়নি, তসলিমা নাসরিনের মায়ের যদি সন্তান জন্মদান ঝামেলা বলে মনে হতো তবে হয়তো তসলিমা এই পৃথিবীর আলোই দেখতে পেতেন না।
প্রকৃত বস্তুবাদে ভালোবাসা কিংবা মানসিক বন্ধনের কোন স্থান নেই, তাই নাস্তিকেরা উতসাহিত করেন অবাধ যৌনতা, ফাত্তাহ এই ব্যাপারটা বারবার বলতে চেষ্টা করে কিন্তু নাস্তিকেরা সেটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন, আজকে আমি বস্তুবাদ দিয়ে ব্যাখা করলাম ব্যাপারটা, আমাকে দেখান তো উপরের ব্যাখাকৃত সম্পর্কগুলোতে ভালোবাসার স্থান কোথায়, এগুলো তো চুক্তিমাত্র। যেহেতু সম্পর্কটা শুধু গিভ এন্ড টেকের, তাই সম্পর্ক টেকেও না বেশীদিন, প্রয়োজন কিংবা মজা ফুরোলেই পাখি গিয়ে অন্য ডালে বসে। আর এভাবে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। আর এজন্যেই অবাধ যৌনতা প্রচলনে নাস্তিকদের এতো উতসাহ। আর তাই মেয়েদের বলছি, বস্তুবাদী নাস্তিক প্রেমিক হইতে সাবধান!!!
মানবিকতার বিষয়টাতো কোনভাবেই বস্তুবাদীদের সাথে যায় না, নাস্তিকরা যে মানবিক হতে পারেনা সেটা ইদানীং ব্লগ ফেসবুকে নাস্তিকদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, সামান্য একটু সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় তারা বিশ্বাসীদের গালাগালি করেও তাদের প্রগতিশীলানুভূতি প্রকাশে দ্বিধা করেন না। তারপরেও এ প্রসঙ্গে শুধু একটা কথাই বলবো, বস্তুবাদীদের মতে ল্যাংড়া, আঁতুড়, লুলা অর্থাৎ প্রতিবন্ধীদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই, তাদের মতে ‘সারভাইভ্যাল ফর দা ফিটেস্ট’ অর্থাৎ যারা ফিট তারাই শুধু বেঁচে থাকবে আর বাকীরা *দায়া মুড়ি খাবে। তাদের এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ইউজেনিক্স তত্ত্বের, এ শুধু তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর প্রয়োগও দেখা যায় এথনিক ক্লিনজিং এর সময়ে। তারা আগে থেকেই সন্তান প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে গর্ভপাত করে ফেলেন অর্থাৎ সন্তানকে খুন করে ফেলতেও দ্বিধা করেন না। বস্তুবাদীরা কেন দান খয়রাত করবে, নিজের কষ্টার্জিত টাকা দরিদ্রকে দিয়ে দেবে, এটাতো তাদের জন্য কোন ইকোনমিক প্রফিট বয়ে আনবে না…? জরিপ থেকে দেখা যায় বিশ্বাসীরা পরকালের লোভে হলেও বস্তুবাদী নাস্তিকদের চেয়ে অনেকগুন বেশী দান করেন।
তাই বস্তুবাদীরা যখন মানবতা নিয়ে চিতকার চেঁচামেচি করেন তখন কয়েকদফা হেসে নেয়ার অধিকার ভাববাদীরা সত্যিই রাখেন!!!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১২ সকাল ১১:৩৭