সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ তার বুদ্ধি আর পেশীশক্তি দিয়ে একে একে প্রভুত্ব কায়েম করেছে অন্য সব প্রাণীর উপর। মানুষ জীবজগতের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রাণী। মানুষের সামনে যে প্রাণীই বিন্দুমাত্র অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাকে সে হয়ত হত্যা করেছে অথবা তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু এতে করে পরিবেশের উপর শত শত বছর ধরে পড়েছে বিরুপ প্রভাব। জীববিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি সহাস্রাধিক প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তির পেছনে মানুষ প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছে। এছাড়া আরও অনেক প্রজাতিই এখন বিলুপ্তির পথে। পরম পরাক্রমশালী আফ্রিকান সিংহও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। যদিও বিভিন্ন দেশের সরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষনের জন্য ইকোপার্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তারপরও মানুষের জীবন অথবা সম্পদের উপর যখন কোন প্রাণী আঘাত হানে তখন মানুষ তার প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই সেই প্রাণীকে হত্যা করে বা করার চেষ্টা করে। তাই যখন কোন প্রাণী সরাসরি মানুষের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় তখন একমাত্র উপায় ঐ প্রাণী আর মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। কিন্তু বাস্তবে বন্য শিকারি প্রাণীর সাথে মানুষের সহাবস্থানের ব্যাপারটি শুধুমাত্র হাস্যকর নয়, অসম্ভবও বটে। কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন আফ্রিকার এক নওজোয়ান। আজকের পোস্ট সেই আফ্রিকান যুবা রিচার্ড তুরেরেকে নিয়ে।
তুরেরেরা থাকত কেনিয়ার নাইরোবি ন্যাশনাল পার্কের দক্ষিণ অংশে। পার্কের ঐ দিকটাতে অনেক জায়গায় ঠিকমত বেড়া দেওয়া না থাকায় বন্য জেব্রাসহ অন্যান্য প্রাণীরা অবাধে চলাচল করতে পারত এবং জেব্রাদের অনুসরণ করতে করতে অনেকসময় সিংহও ঢুকে পড়ত। পার্কের ভেতরে যে পরিবারগুলো বসবাস করত তারা সাধারণত গবাদি পশু পালন করত। তুরেরের বাবারও একটি ষাঁড় ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সিংহ এসে একদিন খেয়ে গেল তুরেরের সেই ষাঁড়। তুরেরের বয়স তখন আট কি নয়। ষাঁড়টির মৃত্যুতে তুরেরে প্রচণ্ড কষ্ট পেল। কিন্ত ষাঁড়টির মৃত্যুর জন্য তুরেরের বাবা ওকেই দায়ী করল কারণ পশুটিকে দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব ওর উপরেই ছিল। সেই থেকে তুরেরে চিন্তা করতে লাগল কিভাবে এই সমস্যার একটা সমাধান বের করা যায়। পার্কে বসবাসকারী লোকজন ততদিনে ছয়টি সিংহকে ইতোমধ্যে হত্যা করেছে। কিন্তু বনের সব সিংহ তো আর ধরে ধরে হত্যা করা সম্ভব নয় আর তুরেরে নিশ্চয়ই সেটা চাইতও না। তাই সে প্রথমেই চেষ্টা করল গবাদিপশু যেখানে থাকবে তার চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে রেখে সিংহকে ভয় পাইয়ে দিতে যাতে ওরা দূরে চলে যায়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হল। আগুনের আলোয় সিংহ তার নিশানা ঠিক করতে পারল আরও ভাল করে। তাই এই কৌশল বাদ দিতে হল। পরবর্তী কৌশল হিসেবে সে ব্যবহার করল কাকতাড়ুয়া। কিন্তু এক্ষেত্রেও সিংহগুলো বুদ্ধির পরিচয় দিল। প্রথমদিন হয়ত ভয় পেয়ে ঠিকই ফিরে গেল কিন্তু পরেরবার ওরা বুঝতে পারল কাকতাড়ুয়া জিনিসটা নড়াচড়া করে না সেহেতু ওটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাই ঐ পরিকল্পনাও ভেস্তে গেল। তুরেরে তবুও ভেঙ্গে পড়ল না। সে চিন্তা করেই যেতে লাগল। অবশেষে সে একটি জিনিস আবিস্কার করল। গবাদিপশু পাহারা দেওয়ার সময় তারা যখন টর্চ জ্বালিয়ে চলাফেরা করে তখন সিংহ কাছে আসে না। এ ভাবনা তার মনে নতুন আশার আলো জ্বেলে দিল। সে বুঝতে পারল সিংহ গতিশীল বা চলমান কোন আলোকে ভয় পায়। পরদিন উৎসাহী হয়ে সে তার মায়ের রেডিওটি চুরি করল এবং ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে গাড়ির একটি ব্যাটারি, মোটরসাইকেলের ইনডিকেটর এবং টর্চের ভাঙ্গা ফ্ল্যাশলাইট ও সুইচ ব্যবহার করে সে সিংহকে ভয় দেখানোর জন্য একটি যন্ত্র বানিয়ে ফেলল। সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে তার ব্যাটারি চার্জ হতে লাগল, ব্যাটারি শক্তি সরবরাহ করল ইনডিকেটর বক্স এ এবং ইনডিকেটর বক্স লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে সবগুলো লাইট একবারে অন হল না। একেকটি লাইট একেকবার জ্বলে উঠল। এতে করে লাইটগুলো যখন অন্ধকারে রাখা হল এবং একটার পর একটা জ্বলে উঠতে লাগল তখন মনে হতে লাগল আলোটা যেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলছে। এবার সে লাইটগুলো সহ পুরো সিস্টেমটা বেড়ার উপর আটকে দিল এবং রাতে লাইট অন করে দিল। সিংহ নিশ্চয়ই তুরেরের লাইটগুলোকে চলমান আলো ভেবে ভুল করল কেননা এরপর থেকে তুরেরের সিস্টেমটি কাজ করা অবস্থায় পার্কের ভেতরে কখনো সিংহের আগমন ঘটে নি। এবার তুরেরে তার সিস্টেম অন করে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারল। তুরেরের এই আবিষ্কারের কথা অন্যরা জানতে পেরে তারাও এ ব্যাপারে আগ্রহী হল এবং তুরেরে খুশিমনে তাদের সাহায্য করল। এভাবে গোটা কেনিয়াতে এখন তুরেরের এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সিংহ, হায়েনা, চিতাসহ বিভিন্ন্ন বন্য প্রাণীর আক্রমন থেকে গবাদিপশুকে রক্ষা করা হচ্ছে।
ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে তুরেরের এই আবিস্কার ও আগ্রহের কথা জানতে পেরে কেনিয়ার সবচেয়ে ভাল স্কুল থেকে তাকে বৃত্তি দেওয়া হয়। সে এখন পড়াশুনা করছে যে সুযোগটি হয়ত স্বাভাবিকভাবে সে কখনই পেত না। তুরেরের আবিষ্কারের কথা জানতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রের টেড কর্তৃপক্ষও তাকে আমন্ত্রন জানিয়েছিল তার এই অসাধারণ আবিষ্কারটির কথা বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
আমি মনে করি তুরেরের এই আবিস্কার থেকে আমরাও উৎসাহিত হতে পারি। সুন্দরবনের কাছাকাছি গ্রামগুলোতে এ ধরনের ব্যবস্থা প্রচলন করে একইসাথে গবাদিপশুর নিরাপত্তা দেওয়া এবং আমাদের জাতীয় পশু বাঘসহ অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচান যায় কিনা সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
তুরেরের টেড টকটির ইউটিউব ভিডিওঃ