নিতান্ত সাধারণ করে বললে, মানুষ বাঁচতে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসকে কেন্দ্র করে।
মানুষ তারপর, একটা সন্তোষজনক সময় পার হয়ে গেলে, পিছু ফিরে তাকায় এবং পূর্বতন জীবন যেমনই কাটিয়ে থাকুক না কেন - তখন সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকে। কিংবা, কিছু আছে, তারা মৃত্যুকে শিশুর মতো অবোধ অস্বীকার করে আরেকটু-সময়-লোভী জীবনে ডুবতে চেষ্টা করে। শুরু যার যেভাবেই হোক, পূর্ণবয়স্ক মানবের সকল সিদ্ধান্তের পেছনে মৃত্যু সতর্কপায়ে লুকিয়ে আছে ছায়াপদী জন্তুর মতো।
তাহলে বলা যায়, আমাদের জীবনটা আসলে আবর্তিত হয় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে।
শৈশব-কৈশোরে আমরা মৃত্যুর একটা আবছা ধারণা নিয়ে বড় হই, তেমন ছাপ ফেলে না। যুবক হবার পর মৃত্যুকে চিনি, কিন্তু সেটাকে তখন বহু দূরের ঘোলাটে কোন অপার্থিব ঘটনা বলে মনে হয়- যা কেবলমাত্র অন্যদের ক্ষেত্রেই ঘটে। আমরা তখন বাঁচতে ব্যস্ত, যৌবনের সঞ্জীবনীশক্তি আমাদেরকে অমর হবার অনুভূতিতে ডুবিয়ে রাখে, আমরা মৃত্যুর কথা জানি, চারিপাশে দেখি, কিন্তু মনে মনে ভাবি- না, এখনো অনেক দেরি আছে। আমরা ভুল করি, ভুল শিখি- শেখাই, আনন্দ খুঁজি ভালোয় আর মন্দতে, শরীর আর মনের চাহিদা মেটাতে খাটি, বাঁচতে শুরু করি।
তারপর চোখের পলক ফেলার আগেই মধ্যবয়স এসে যায়। আমরা হঠাৎ নিজেদেরকে আবিষ্কার করি সংসার জীবনে, যেখানে আমরা দায়িত্ব-কর্তব্য আর ছোট ছোট আনন্দের মাঝে সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলছি। আমাদের জীবনে একঘেয়েমি আসে, দুনিয়ার কলকব্জা আমাদের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়। আমরা বুঝতে পারি আসলে জীবনের প্রকৃত আনন্দ পরের জন্যে কিছু করতে পারায় নিহিত; কিন্তু এই সত্য এত দেরিতে বুঝতে পারায় আদতে পরের জন্যে কখনো কিছু করা হয়ে ওঠে না। আমরা তারপর চোখ কান বুজে স্বার্থপরের মতো বংশবৃদ্ধি করে নিজের বীজকে উপযুক্ত বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার মাঝে জীবনের সার্থকতা খুঁজি।
অনেকে সেটা খুঁজেও পাই।
ক্রমশঃ দেখি- আমরা বুড়িয়ে যাচ্ছি, আমাদের জীবনীশক্তি কমে আসছে ধীরে ধীরে। তিক্ততা বাড়ছে, সহনশীলতা কমে আসছে, তবু আমাদের মানিয়ে চলা শিখতে হয়। দুনিয়ার নিয়ম-কানুন বড় বেশি বিরক্তিকর, বড় বেশি নড়বড়ে লাগে তখন। কঠিনমুখো সত্যে ভয় লাগে, আমরা স্বস্তি খুঁজি বিশ্বাসে। এই দুনিয়া বাদেও অস্তিত্ব বের করতে চাই অন্য কোন দুনিয়ার, অন্য কোন জীবনের। আর বাদবাকি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাই ডুবে যাই মৃত্যুর পরের দুনিয়ার সাধনায়। কিংবা কেউ কেউ খেপে যাই মৃত্যুর ওপরে, থোড়াই কেয়ার করি ওসবের- এই মনোভাব নিয়ে বাঁচতে শুরু করি।
তারপর, স্বভাবতইঃ, মৃত্যু আসে।
যদি পরকাল সত্য হয়, তবে মৃত্যু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। অনন্তকাল শাস্তি হোক বা পুরষ্কার মিলুক, অন্ততঃ আমাদের সত্ত্বার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে না মহাশূন্যে- এটা তো স্বস্তির ব্যাপার!
কিন্তু যদি না হয় তেমন? যদি মৃত্যুর পর ওপার বলতে কিছু না থাকে? শুধু শূন্যতা, কালো অন্ধকার। একটা গহ্বরের মাঝে স্রেফ লীন হয়ে যাওয়া। তাঁর চে ভয়ের কি কিছু আছে?
নেই বোধহয়। শূন্যতা ভয়ানক জিনিস। আমার তাই মনে হয়। এই বিশ বছরের হাস্যকর রকম ক্ষুদ্রদৈর্ঘ্যের জীবন পার করে এসে এখন মনে হয়- যদি একটা কিছুও অনুভূত হোতো বুকের ভেতরে- হোক বিষাদ, ঈর্ষা, ক্ষোভ, কাম- কিছু একটা- বেঁচে যেতাম। এই শূন্যতা, এই ফাঁকা পরিত্যক্ত গহ্বরে ডুবে থাকতে আর ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে মনে হয় বুকের মাঝে একটা কবর খুঁড়ে রেখেছে কেউ- কার কবর জানি না, কে খুঁড়েছে জানি না। কিন্তু যতবার তাকাচ্ছি বুকের মাঝখানে অনুভূতির খোঁজে- সেই কবরটা চোখে পড়ছে। আর অসীম শূন্যতার অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে আমাকে। আমার মাঝেমধ্যে ভেঙ্গেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করে সবকিছু- মাঝেমধ্যে দম আটকে আসে। আমি তখন দাঁড়াতে পারি না, বসতে পারি না। আমি মানুষের মাঝে যাই। তাঁদের একঘেয়ে জীবনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ শুনি, তাঁদের আবেগের নহরে পা ভেজাই। দিনশেষে বুঝতে পারি- জীবনচিত্রের কাছ থেকে কয়েক পা পিছু হটে সমস্ত ছবিটাকে কেউ ইচ্ছে করেই দেখছে না। কারণ সেখানে দেখলে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। তাই আমরা, মানুষেরা, মনোযোগ দিয়েছি এরকম খুঁটিনাটি বিরক্তিকর জীবনের অংশাবশেষের ওপরে। সেখানে যার যার মতো মানে খুঁজে নিচ্ছি।
আর বেঁচে আছি যার যার মতো। এটাই সত্য হয়তো। এটাই সেই বিব্রতকর সত্য যা আমরা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি।
দুনিয়ায় মানুষের জীবন তাই বিশাল একটা কমেডি। দেখে হাসছে কে- মূল প্রশ্ন হলো এটা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৫৩