(সংবিধিবদ্ধ সতর্কবাণী- যারা নিজেদের ভদ্র সমাজের সুশীল নাগরিক ভাবেন এবং সে অনুসারে ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে চলেন, তারা দূরে থাকুন। যারা সমাজে কোন সৎ ভূমিকা রাখতে পারেন নাই এবং লেখকের মত অশালীন অকর্মার ধাড়িবিশেষ, তারা স্বাগতম!)
১.
আক্রাম সাবের আজকে পেটব্যথা। মানে ব্যথার-চোটে-ঘরবাড়ি-ভাংচুর-করবার-মন-চায় এইরকম পেটব্যথা। আসলে এইটা পেটব্যথাও না, কিসের ব্যথা সেইটা আক্রাম সাবের কাউকে বলার উপায় নাই। গুপন ব্যথারা যেমন হয়। তিনি অবশ্য কিচ্ছু বলার বা ভাংচুর করার অবস্থায় নাই, বিছানায় পেটের উপরে বালিশ চেপে হাঁটু দ বানিয়ে শুয়ে কোঁকড়াচ্ছেন। পাগলা হাতি ডাকছে পেটের ভেতর। তার মধ্যে আবার ঘনঘন আসছে ফোন, আনন্দিত সুরে 'ম্যাজিক মামুনি' বেজে উঠছে বারবার, কেমন লাগে?
ষোলতমবার রিং হবার পরে তিনি মুখ বিকৃত করে ফেললেন, সংসদের অধিবেশন থেকে শেখা কিছু উপাধি অস্পষ্টভাবে ঝেড়ে খপ করে ধরে ফোনটা কানে লাগালেন, 'আক্রাম বলছি!'
-'জনাব, আপনি ফোন ধরছেন না কেন?'
'কে?'
-'আমি সেক্রেটারি আদাচো বলছিলাম। 'বিবেকবান বঙ্গবাসী সমাজ' থেকে?'
আহাহা [মৃদু কণ্ঠে আর্তনাদ]...কি চাই?
-'খুন হয়েছে আরেকজন। আমরা প্রতিবাদ করব কিভাবে তা নিয়ে মিটিং আছে আজকে। রাত নটায়। ক্লাবহাউজে। আপনার উপস্থিতি আবশ্যক।'
অহহ...মিয়াইতেপারুম্না...
-'জি?'
[অনেক কষ্টে গলায় বীর্য ঢেলে] আমি আসতে পারব না। অসুস্থ। বিদায়। ওহহ...আল্লাগো...
খুট করে লাইন কেটে গেলে আদাচো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। সভা ডাকা খুবই জরুরি, আর সাধারণতঃ আক্রাম সাব-ই সভাপতিত্ব করেন; কিন্তু তিনি না এলে জাতির এই ক্রান্তিকালে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মিটিং হবে কিভাবে? বিবেকবান বঙ্গবাসী সমাজ -এর কার্যক্রম তো থেমে থাকতে পারে না!
দুই একবার ভেবে সে বাকি সদস্যদের সবাইকে কল দেওয়া শুরু করল। সবাইকে জানিয়ে দেবে ও- মিটিঙয়ের সময় একই থাকবে, তবে স্থান পাল্টাবে।
নতুন স্থান- আক্রাম সাবের বাসা।
আক্রাম সাব সভায় আসতে না পারলে, সভা-ই যাবে আক্রাম সাবের কাছে!
২.
আক্রাম সাব বিছানা থেকে উঠতে আপত্তি জানানোয়, তাঁর আলিশান বেডরুমে বিছানা ঘিরেই মিটিং বসেছে। পাঁচটা চেয়ার, তাতে সমাসীন-
সেক্রেটারি-- আদাচো
বাংলাদেশ জনদলের নেত্রী-- জনাবা শেঠ সুন্দরী
বাংলাদেশ নবীশ চোরিত্রবানদের তহবিলদার-- জনাব মইনুদ্দি
বিশিষ্ট ইসলাম গবেষক-- হুজুরে আলা খাদেমে রাসুল আশেকে খোদা হাজি মীর মোহাম্মদ শিকদার
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী-- জনাব সুনীল হাসান
সুনীল হাসানঃ [হাই তুললেন] আদাচুর, কি জন্যে ডাকছো আজকে?
আদাচোঃ জনাব, আমার নাম আদাচো। আজকে কুমিল্লায় এক জনকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। জাতির বিবেক হিসেবে আমাদের কি করা উচিত, তাই ঠিক করতে এই মিটিং।
সুনীলঃ অ। শুনেছি তো মনে হয়, নাম যেন কি? অভিজিত না বিশ্বজিৎ না ত্বকী, মনে পড়ছে না।
আদাচোঃ না জনাব, নাম প্রকাশ করে নি এখনো।
হাজি শিকদারঃ ব্যাটা নাস্তিক ছিল?
আদাচোঃ কিজানি।
শেঠ সুন্দরীঃ তাহলে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করত?
আদাচোঃ কিজানি।
মইনুদ্দিঃ হিন্দু না মুসলিম? পরিচয় বের করে নাই? কাপড় উঠাইয়া দেখলেই তো হয় কাটা না আকাটা। রামদার কোপ কয়টা খাইছে?
আদাচোঃ [সন্দেহের চোখে] রামদা দিয়ে কুপিয়েছে আপনি জানলেন কি করে?
মইনুদ্দিঃ [নিষ্পাপ মুখে ছাদের দিকে তাকিয়ে] আইডিয়া করলাম। এখন রামদার ট্রেন্ড চলতাছে। সহজে কাটে, হাড্ডি মাড্ডি কিছু মানে না। আমার পরিচিত কসাইয়ের কাছে শুনছি।
আদাচোঃ যতদূর জানা গেছে, লোকটা ইংরেজি পড়াত। কবিতা লেখত। আর রামদার বাইশটা কোপ খেয়ে মরেছে। আমি প্রস্তাব তুলছি একটা সেমিনার করার, বিষয় থাকবে-- 'নাগরিক নিরাপত্তাঃ আমাদের করণীয় কি?' সেখানে এই লোকের মৃত্যুকে হাইলাইট করা হবে। সভাপতি সাব, কি বলেন?
[আক্রাম সাব আরেকটা ছোটোখাটো গোঙরানি দিয়ে আরেক কাত হলেন। অস্পষ্ট গালিগালাজ শোনা গেল]
সুনীল বিরক্তমুখে আপত্তি জানালেন, 'আমি তো ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েইছি এর মধ্যে। হাজারখানেক লাইক পড়েছে। শেয়ার করেছে চুয়ান্ন জন। আরো এত ঝামেলার কি দরকার?'
আদাচো সংশোধন করে দিল, 'বাহান্ন জন শেয়ার করেছে। আর স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তনুকে নিয়ে, ওটা পাব্লিক ভুলে গেছে। এটা নতুন ইস্যু।'
শেঠ সুন্দরী এমনিতে সভাজুড়ে নিরব থাকেন আর ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস খ্যালেন, কিন্তু এখন তিনি কথাটা ধরে ফেললেন, বললেন, 'তা বুঝলাম, কিন্তু নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন? এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশ তো ঠিক পথেই চলছে, জিডিপি বাড়ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের কষ্ট নেই, মানুষ সুখে শান্তিতে নিরাপদে আছে। নিরাপত্তা নিয়া তুমি কি কোন সন্দেহে ভুগছ?
মইনুদ্দি যোগ করল, 'তাইলে সন্দেহ নিরাময় কইরা দেই?'
আদাচো জিব কেটে বলল, 'না না, কি যে বলেন, আসলে সেমিনারের বিষয়টা জুতের হয় নি। বিষয় হোক- 'সামাজিক জীবনে রামদার উপযোগিতা'- তাহলে কেমন হয়? পারলে মইনুদ্দি সাব তাঁর পরিচিত কসাইকে নিয়ে আসবেন, তিনি বক্তব্য দেবেন।'
তখনি কারেন্ট চলে গেল। সভাপতির স্ত্রী এসে দুটো মোমবাতি আর একটা পাখা দিয়ে গেলেন, আর বিরক্ত মুখে জামাইকে অ্যাডাল্ট ডায়াপার পরিয়ে দিলেন।
রুমাল বের করে হাজি শিকদার ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, 'তোমরা কি যে কও আমি বুঝি না। সেমিনার করে কি লাভ? ভাল বুদ্ধি দেই- ওয়াজের ব্যবস্থা করো। জবরদস্ত ওয়াজ কইরা মানুষের দিলের ভিতরে আল্লার ভয় ঢুকায়া দেয়া লাগব। পশ্চিমা দেশগুলা, ইহুদি নাসারা এরা হইল দাজ্জাল। মানুষের দিলে ভয় কমে গেছে, আর ফাঁক দিয়া ঢুকছে দাজ্জাল। এরা কম্প্যুটার দিয়া ব্লগ দিয়া মানুষরে নাস্তিক বানায়া দিতাছে, এক পুরুষের দৃষ্টি আরেক পুরুষের পিছে টাইনা নাপাক বানায়া দিতাছে। এইগুলা থামান লাগব।'
মইনুদ্দি সায় দিল, 'হুজুর খাঁটি কথা বলছেন। দাজ্জালের এত খ্রাপ প্রভাব, আমি পাঁচ অক্ত নামায পড়ি, তাও এখন কচি পুলা দেখলে জাইঙ্গা টাইট লাগে। আমার তখন খ্যাতার তলে গিয়া ফরেন ভিড্যু দেখা লাগে। চিন্তা করেন!'
শেঠ সুন্দরী মর্মাহত মুখে বললেন, 'এরাই তো দেশ জনগণের শত্রু।'
আদাচো বলল, 'কোপাকুপির সাথে কানেকশন টেনে একটা সুশীল ওয়াজের ব্যবস্থা অবশ্য করা যায়। হাজি শিকদার কিছু বক্তার ব্যবস্থা করলেন, আর আমি কয়েকটা টিভি চ্যানেলকে জানিয়ে রাখলাম। অনুষ্ঠানে আমাদের সকল সদস্য উপস্থিত থাকবেন। সরাসরি সম্প্রচার হবে। সভাপতি কি বলেন?'
আক্রাম সাবের পেট এবারে নীল তিমির ডাক নকল করল, তিনি কাপড়ের নিচে পড়া অ্যাডাল্ট ডায়াপারটা হাত দিয়ে পরীক্ষা করে হতাশ গলায় বললেন, 'হয়ে গেছে।'
সুনীল হাসান নাক গলালেন, 'আরে না না, হয়ে গেছে বললেই হল নাকি? ওয়াযের মধ্যে সুশীলতা আনা লাগবে না? এক কাজ করেন, ওয়াযের সময় স্টেজের একপাশে স্বল্পবসনা চিয়ারলিডার রেখে দিবেন। এরা কথায় কথায় প্রতিধ্বনি করে নাচবে আর লাফাবে।'
আদাচো বলল, 'কিরকম? উদাহরণ দিন তো?'
সুনীল বোঝালেন, 'ধরো, ওয়াজের সময় হুজুর বললেন, 'কোপাকুপি করে বে-ঈমানরা', নর্তকীরা সমস্বরে বলবে- বেঈমান বেঈমান বেইইইইইমাননন! আর তালে তালে নাচবে। তারপর হুজুর বলবেন, 'একমাত্র দাজ্জাল প্রকৃত বেঈমান', ওরা বলবে, পাপি পাপি পাআআআআআপি! শেষে হুজুর সিদ্ধান্ত দিবেন, 'সুতরাং দাজ্জালই কুপাকুপির জন্যে দায়ী, এই দাজ্জালই হইল এখনকার ইহুদি নাসারা আর ব্লগ-কম্পুটারঅলা মানুষেরা', আর চিয়ারলিডাররা সুর করে গাইবে, 'এক দুই এক দুই তিন, সবাই দাজ্জাল ুদে দিন'। বুঝলা?
মইনুদ্দি যোগ করল, 'আর ওয়াইফাই জোনের ব্যবস্থা করেন। দুই ঘন্টা পর পর 'ধর্মীয় টাইম-আউট' দেওয়া হবে, এই সময়ে মানুষ হুজুর/নর্তকীগো সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপ্লডাইবো। আমাদের সমিতির একেবারে ম্যাক্সিমাম মিডিয়া কাভারেজ হইয়া যাইব।'
আদাচো কিছুক্ষণ বলদ হয়ে তাকিয়ে থাকল দুজনের দিকে, তারপর বলল, ব্রিলিয়ান্ট! তাহলে আমি সব ব্যবস্থা করছি। আগামি সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হবে সুশীল ওয়াজ মাহফিল, ফিচারিং চিয়ারলিডারস!
বাকি সবাই এই নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করবে, ঠিক এই সময়ে আক্রাম সাহেবের গোঙরানি আবার ভয়ানকভাবে বেড়ে যায়। তিনি গায়ের ওপরের কাঁথা-লুঙ্গি ছুঁড়ে মেরে ফেলে দিয়ে শ্লীল-অশ্লীল ভঙ্গিমায় পেট ধরে গড়ানি দিতে থাকেন। কাত হয়ে পড়া মদের ব্যারেলের মতো। বিছানার এই মাথা থেকে ওই মাথা। ওই মাথা থেকে এই মাথা। তৃতীয় গড়ানির সময় তিনি ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যান।
মেঝেতে পড়ার সাথে সাথে তাঁর দুই উরুর মাঝখানের রোমশ মধ্যাঞ্চলটি ছোটোখাটো বিস্ফোরণের শব্দ তুলে ফেটে যায়, সে জায়গা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে রক্তমাখা একটি কুৎসিত ক্ষুদ্রাকার শাদা প্রাণী বেরিয়ে এসে ফ্যাসফ্যাস করে হাঁপাতে থাকে।
শেঠ সুন্দরী মোবাইলের স্ক্রিন থেকে মুখ না তুলেই বলেন, 'শালার, কেবল একটা ভিলেজে অ্যাটাক দিলাম, এইসময় কি ঝামেলা! জিনিসটা কি?'
মইনুদ্দি বলেন, 'নিশ্চিত সরকারবিরোধী চক্রান্ত!'
হাজি শিকদার বলেন, 'দাজ্জালের পয়দা!'
সুনীল বলেন, 'আসলে এইটা নিয়া আমাদের গভীর গবেষণা করতে হবে।'
আদাচো কোন কথা না বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে জিনিসটার দিকে। জিনিসটা আর কিছুক্ষণ হাঁপায়, তারপর নিজের পশ্চাৎদেশের ফাটল থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে আদাচোর দিকে বাড়িয়ে ধরে। আদাচো ইতস্ততঃ করে কাগজটা হাতে নেয়। সেখানে মতিউর রহমান নিজামির ফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় জিভ কিঞ্চিত বের করে মুখ নীল হয়ে যাওয়া একটা ছবি ছাপানো, তাঁর নিচে কমিক স্যানস ফন্টে লেখা- 'এই অবিচার আল্লা সইবে না'।
আদাচো অস্ফুট গলায় বলল, 'হুয়াত দা ফাক?!'
আক্রাম সাব এতক্ষণ কাত হয়ে পড়ে ছিলেন, [বাকিরা ভেবেছিল তিনি অক্কা পেয়েছেন] এখন তিনি সোজা হয়ে বসেন। উরুর রক্তাক্ত ফাঁকে কাঁথা গুঁজে দিতে দিতে তিনি বলেন, 'ভয় পেয়ো না আদাচুর। অনেক ত্যাগ এবং সাধনার পর আমি জন্ম দিয়েছি একে, এটি আমাদের সমিতির মাস্কট!'
মইনুদ্দি বলে, 'মাসকট মানে?'
আক্রাম সাব বহুকষ্টে হাসেন, 'মাসকট, মানে আমাদের প্রতীক। জাতির বিবেকের প্রতীক। আমরা জাতি হিসেবে কতটা সফলভাবে মানবতা রক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছি, তাঁর সাক্ষাৎ প্রতীক এই সুন্দর প্রাণীটি। এখন একটু বিশ্রী দেখাচ্ছে হয়তো, সমস্যা নেই। রক্ত মুছে গোসল দিলেই আর চেনার উপায় থাকবে না।'
শেঠ সুন্দরী আর হাজিসাব দুজনেই সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। শেঠ সুন্দরী এক দৃষ্টি দেখে বলেন, 'ভেরি কিউট!', হাজিসাব বলেন, 'মাশা আল্লাহ!'
আদাচো চোখের পূর্বতন হুয়াত-দা-ফাকীয় দৃষ্টি ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতস্থ হয়ে বলে, 'গ্রেট। তাহলে এটাকেও সুশীল ওয়াজে যোগ করে দেই? পোস্টারে থাকবে বামে হুজুরের ছবি, ডানে চিয়ারলিডারের রঙ্গিন ছবি, সবার নিচে এইটার ছবি। বড় অক্ষরে শিরোনাম হবে- "সুশীল ওয়াজ!!! ফিচারিং চিয়ারলিডারস উইথ জাতির বিবেক!'' আর তার নিচে হ্যাশট্যাগ, #আম্রা_বিবেকবান। কেমন হয়?'
আক্রাম সাব নিজেকে বিছানায় টেনে তুলে দাঁত ঝিকিয়ে হাসলেন, 'দারুণ হয় আদাচুর। দাআ-রুণ!'
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৬ রাত ৩:৩৬