লেখালেখি একজন আত্মবিধ্বংসী মানুষের কাছে কতটা পরিশ্রমের ব্যাপার সেটা আমি জানি। যখন কিছুই করতে ইচ্ছে করে না, তখন কলম টেনে লেখো- ভাবলেও হাসি পায়।
আমরা বলতে খুব ভালবাসি- আমাদের সবার 'ভাল্লাগেনা' রোগ আছে।
এইটা ভাল্লাগেনা।
অইটা ভাল্লাগেনা।
কিচ্ছু ভাল্লাগেনা।
কিন্তু আসলে ভাল লাগা আর না লাগার পাশাপাশি আরেকটা জায়গাও আছে। সেটা হোলো শূন্যতা। অতল অভিশপ্ত গহ্বর। নীটশের 'অ্যাবিস'। এই শূন্যতায় যারা পড়ে যায়, তারা কিছু অনুভব করতে পারে না। ধনাত্মক ঋণাত্মক কোন আবেগেই কিছু যায় আসে না। তবু যেহেতু মানব মাত্রই সমাজের অংশীদার, তাই তারা সামাজিক আবেগ নকল করতে শিখে যায়। হাসির জায়গায় হাসো, নগন্য ব্যাপারে উৎসাহ দেখানোর ভান করে যাও, ভদ্রতা বজায় রাখ।
এই শূন্য গহ্বর মানুষকে ঘিরে ফেলে, রক্তে-কোষে মিশে গিয়ে একটা অবাস্তব বিষাদের জগত সৃষ্টি করে যেখানে কোন ঈশ্বর নেই, কোন নিয়ম নেই, কোন পরম সত্য নেই, কোন বাঁচার কারণ নেই। আসলে এই জিনিসটা অদ্ভুত, খুব অদ্ভুত। আমরা কেন বেঁচে আছি?
আপনি কেন বেঁচে আছেন? কি লাভ? দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে? প্রিয় মানুষের প্রতি কর্তব্য আছে বলে?
যদি এমন হয়, দুনিয়ার একটি মানুষও বেঁচে থাকার জন্যে আপনার ওপরে নির্ভরশীল নয়? হয়তো অনেকে কষ্ট পাবে, দুই একজন ভেঙে পড়বে, কিন্তু, দিনশেষে, আপনার মৃত্যুতে কারো জীবন নষ্ট হয়ে যাবে না- এমন হলে?
কিংবা প্রিয় মানুষের কথা বলি। যদি এমন হয়, প্রিয় মানুষেরা কেউ বেঁচে নেই? তখন?
তখন বেঁচে থাকার কারণ কি হতে পারে?
কোন কারণই নেই। হতাশের কাছে ধর্ম-কর্ম সব বাজে কথা। খোঁড়া যুক্তি। আসলে জীবনকে উপভোগ করা খুব একটা কঠিন কিছু না। পরিশ্রম করলেই তৃপ্তি মেলে। যারা দিনরাত খাটে, খায়, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে বাঁচে- সুখি তারাই। বিষাদ আঁকড়ে ধরে তাঁদের, যারা বসে বসে ভাবে আর মাথা থাপড়ায়।
আমাদের সমাজ আত্মহত্যাকে খারাপ চোখে দেখে। আমি মনে করি এটা একটা ভ্যালিড অপশন হওয়া উচিত। আঠারো বছর বয়স হলে প্রত্যেক মানুষকে একটা পরীক্ষার মুখোমুখি করা হোক। তাঁকে আত্মহত্যার সুযোগ দেওয়া হবে। করলে তো হলই, জনসংখ্যা কমল, কিন্তু যদি সে কাজটা না করে, তবে শপথ করবে যে বাকি জীবনে আর কখনো আত্মহত্যার কথা ভাববে না।
কত টিনেজ বাচ্চারা আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আমার খারাপ লাগে খবরগুলো শুনলে। আর কতবার শুনব হারপিক বা ইঁদুরের বিষ বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে পোলাপান। হাতের শিরা কেটে কেবল রক্তক্ষরণ হয়েছে, হাতের নার্ভ নষ্ট হয়ে গেছে; কিন্তু তবু বেঁচে আছে। দালান থেকে লাফ দিয়েছে, পঙ্গু হয়ে গেছে, মরেনি। ফাঁসি নিয়েছে, দড়ি ছিঁড়েছে বা কড়িকাঠ ভেঙে গেছে, মরেনি।
মধ্যবয়েসিরাও চেষ্টা করেন। 'মিডলাইফ ক্রাইসিস' বলে না? বাজার করতে গিয়ে রাস্তায় ট্রাকের সামনে বা ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন। দুই একজন মরেন। বাকিরা পঙ্গুত্বের বর পান।
এসব হল তৎক্ষণাৎ চিন্তার ফসল। সোজা বাংলায়- বলদামি। আত্মহত্যা একটি সরল স্বাভাবিক ক্রিয়া যা সম্পাদন করা উচিত কমপক্ষে এক মাস ভেবে। ঠাণ্ডা মাথায়। এটি হল স্বাধীনতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। আমার অস্তিত্ব থাকবে কি না থাকবে সেটা ঠিক করার সিদ্ধান্তটা একমাত্র আমারি। এই মহান সিদ্ধান্ত না ভেবে নেওয়ার চেয়ে বড় অপমান আর নাই।
এই নিয়ে একটা গাইডলাইন থাকা উচিত। ফুটপাতে বিক্রি হবে এরকম চটি বই। রংচঙে কভারে লেখা থাকবে-- 'পাঁচ মিনিটে সুইসাইড- ১০০% গ্যারান্টি!'। সেখানে লাইনগুলো থাকবে এরকম-
১। দড়ি
ওজন ৬০-৯০ কেজির মধ্যে থাকলে সিলিং-ফ্যানের হুকে দড়ি বিষ গিট্টু দিয়ে ঝুলে পড়ুন। যা যা লাগবে- কমপক্ষে এক আঙুল মোটা দড়ি
একটা চেয়ারম্যান চেয়ার
সিলিং-ফ্যানের হুক
অক্ষত গলা
সম্ভাব্য সময়- দেড় মিনিট।
২। লম্ফন
কমপক্ষে চারতলা উচ্চতা থেকে মাথা নিচে দিয়া লাফ দেবেন। বেশি উঁচু বিল্ডিঙয়ে যাওয়ার দরকার নেই, মানুষজন সন্দেহ করে। পরিত্যক্ত বিল্ডিং থেকে লাফ দেওয়া ভাল। লাফ দিয়ে আরেকজনের ঘাড়ের উপরে যেন না পড়েন সেই দিকে লক্ষ্য রাখবেন।
সম্ভাব্য সময়- সর্বোচ্চ ৪-৫ সেকেন্ড।
৩। বিষ
এক শিশি সায়ানাইড খান। কেমিস্ট দিতে চাবে না, ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হবে।
সম্ভাব্য সময়- তরল সায়ানাইড হইলে ১৫-২০ সেকেন্ড। আর পাউডার সায়ানাইডে সময় নির্ভর করে মানের ওপরে, যেমন পাউডারে ছাতা পড়ে গেলে মরতে অনেকক্ষণ লাগে। মরার আগে ডায়রিয়া হইতে পারে। অ্যাডাল্ট ডায়পার পরে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে আত্মহত্যা করাটাই আমার কাছে পছন্দ না। কিন্তু যারা ভেবেচিন্তে আত্মহত্যা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বলার কিছু নাই। জীবন তাঁদের, বাঁচবেন না মরবেন- সিদ্ধান্তও তাঁদের হওয়া উচিত।
আমি বিশ্বাস করি- মানুষ যদি জীবনের সাধারণ আনন্দগুলোকে পাশ কাটিয়ে কেবল মাত্র জীবনের অর্থ বা সার্থকতা নিয়ে ভাবত- তাহলে আমাদের এতো সাধের মানব সভ্যতা ধসে পড়ত। দলে দলে আত্মহত্যা করত অসুখি মানুষেরা, আমরা সাবধানে গলা কাটতাম প্রিয়জনের; যাতে এই অসহ্য অস্তিত্ব থেকে মুক্তি মেলে, তারপর রক্তাক্ত হাতে ক্ষুর নিয়ে চালাতাম নিজের গলায়।
কিল ইওর ডারলিংস।
কিল ইওর জয়।
ক্লিওপেট্রা ইজ ডেড।
গো স্যাক ট্রয়।
লেখালেখি নিয়ে ভাবছিলাম। কেন লিখি? আমার লেখা আবর্জনা এটা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। অন্ততঃ পাঠক হিসেবে আমি ভাল খারাপ বুঝি, আর নিজের লেখা পড়তে গেলে নিজেরি বিরক্তি ধরে যায়। তবু কেন লিখি?
বুকের ভেতর জমে থাকা অন্ধকার কলমের কালিতে মিশিয়ে কাগজে ঢালব বলে? কি লাভ?
লাভ খুজেই বা কি লাভ?
যখন জীবনের অর্থ নেই ভেবে হাসছি, তখন লেখালেখির পেছনে মহৎ কোন অর্থ থাকবে সেটাই বা ভাবি কি করে? পুড়ুক পুড়ুক সব।
সূর্যের শবে সব রোদ জড়িয়ে দিলাম
বিদায়, বিদায়।