একটি জিডি ( সাধারন ডায়রী) মানেই একটি লাশ। গত দু’মাস ধরে ঝিনাইদহে চলছে গুম-খুনের এমনই নিয়ম। প্রথমে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ । এরপর থানায় গেলে আর খুজে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের। পুলিশও অস্বীকার করছে। এরপর কিছুদিন পর পুলিশ স্বজনদের কাছে আসে ,তাদের দিয়ে জিডির কেপিতে সই-স্বাক্ষর নেয়। পরের দিন প্রকাশ্যে তুলে নেয়া ভিকটিমের লাশ মেলে বনে-জঙ্গলে,মাঠে-ঘাটে কিংবা খালে বিলে।
জোমায়াত-শিবির কিংবা সাধারন কেউ গুম হয়ে যাওয়ার পরে জিডির আতঙ্কে ভোগে স্বজনরা। এই বুঝি পুলিশ জিডি করতে এলো,এই বুঝি তাদের সন্তানদের লাশ দেখার সময় হয়ে গেল- এভাবেই জানালো ঝিনাইদহের সাধারন মানুষ। জেলাজুড়ে আতঙ্কে আর ক্ষোভে ফুসছে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। গত ২১ এপ্রিল সোহানের লাশ পাওয়ার আগের দিনও স্থানীয় পুলিশ সোহানের ‘নিখোজঁ ’ হওয়ার জিডির কপিতে পুলিশই ‘ স্বপ্রনোদিত’ হয়ে জিডিস কপিতে স্বাক্ষর নিয়ে যায় সোহানের বাবা-মায়ের কাছে থেকে। এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে কোন কতা বলতে রাজি হননি স্থানীয় পুলিশ সুপার ।
এলাকাবাসী জানায় , পুলিশের এমন কর্মকান্ডে জেলাজুড়ে ক্ষোভে ফুসছে মানুষ। গুম-খুনের রাজ্য হয়ে ওঠেছে এলাকাটি।
পুলিশের ‘স্বপ্রনোদিত জিডি’মানেই একটি লাশ !
আতঙ্কের জনপদ ঝিনাইদহ। এক সময়ের চরমপন্থী অধ্যুষিত এই এলাকার মানুষ এখন অপহরণ ও গুম আতঙ্কে ভুগছেন। একের পর এক অপহরণ ও গুমের শিকার হচ্ছেন মানুষ। এর মধ্যে অনেকে রয়েছেন ছাত্র। সর্বশেষ গতকাল লিমন নামের এক ছাত্র অপহৃত হয়েছেন কালিগঞ্জ থেকে। এর আগের দিন সোহানুর রহমান নামের এক ছাত্রের লাশ উদ্ধার হয়েছে চুয়াডাঙ্গা থেকে। ডিবি পরিচয়ে গত ১০ এপ্রিল কালিগঞ্জ থেকে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো দুর্ব্ত্তৃরা। গত তিন বছরে এই জনপদে ২৮ জন মানুষ অপহরণ ও হত্যা বা গুমের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে গতকাল সকালে অপহৃত কলেজ ছাত্র লিমন দুপুরের পর হাত-পা বাধা অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে।
সর্বশেষ গত বৃহষ্পতিবার কালীগঞ্জ মেইন বাসস্ট্যান্ড থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে মাহবুব হাসান লিমন (১৮) নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ৪০ মিনিট ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। চার ঘন্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লিমনকে হাত পা বাধা অবস্থায় ঝিনাইদহ শহর থেকে উদ্ধার করা হয়। মাহবুব হাসান লিমন জানান, বৃহষ্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি মাহাতাব উদ্দীন ডিগ্রী কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে বের হন। তিনি শহরের নীমতলা ব্রীজের উপর পৌঁছালে একটি সাদা মাইক্রো তাকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। এদিকে লিমনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছালে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থী বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। পরে তারা রাস্তায় নেমে রাস্তা আটকে দেয়।
লিমন শহীদ নুর আলী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল। বৃহষ্পতিবার তার বায়োলজি পরীক্ষা ছিল। অপহরণ হওয়ার কারণে সে আজকের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। সে কালীগঞ্জ শহরের সান্ত্বনা ক্লিনিকের মালিক গোলাম রব্বানির ছেলে।
উদ্ধার হওয়ার পরে লিমন বলেছে, আমাকে পুলিশের পরিচয় দিয়ে মাইক্রোতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর চোখ বেধে ফেলে। তবে আমার জ্ঞান ছিল। তারা আমাকে কথা বলতে নিষেধ করে। এরপর ঝিনাইদহের চাকলাপাড়ায় ফেলে রেখে যায়। কালীগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমি শুনেছি ঝিনাইদহে অজ্ঞান অবস্থায় লিমনকে পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ এ ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলে তিনি জানান।
মাত্র একদিন আগে গত ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা থেকে উদ্ধার হয়েছে ওই একই কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র সোহানুর রহমানের (১৬) লাশ। সে কালিগঞ্জ ঈশ্বররা গ্রামের মহসিন আলীর ছেলে। পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সোহান কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো না। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গত ১০ এপ্রিল বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় সোহানকে। এরপর তার বাবা-মা সাংবাদিক সম্মেলন করে সোহানকে ফেরত দাবি করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয়। সোহানের বাবা-মা বলেছেন, তাদের সন্তান কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো না। চলতি মাসে আরো দুইজন অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এরা হলেন, আবুজর গিফারী ও শামিম হোসেন। গিফারী কালিগঞ্জের চাপালী গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে। চাপালী গ্রামের জামতলা থেকে গত ১৮ মার্চ ডিবি পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। ১৩ এপ্রিল যশোরের হৈবতপুর বিরামপুর শ্মশান থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। ২৪ মার্চ কালিগঞ্জের বাকুলিয়া গ্রাম থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে অপহৃত হন শামিম হোসেন। ১৩ এপ্রিল গিফারীর লাশের সঙ্গে একই স্থান থেকে তার লাশও উদ্ধার হয়। শামিম বাকুলিয়া গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে। তার দু’জন শিবিরের কর্মী ছিলো বলে জানা গেছে।
এছাড়া ঝিনাইদহে আরো যারা অপহরণ, হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন তারা হলেন, বিএনপি কর্মী রফিকুল ইসলাম, সন্ত্রাসী ঘটনায় অভিযুক্ত ইউসুফ আলী বিশ্বাস, উজ্জল হোসেন, আসাদুল ইসলাম ও মফিজুল হক, জামায়াতের কোটচাদপুর উপজেলার অর্থ সম্পাদক এনামুল হক বিশ্বাস, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জামায়াত নেতা হাফেজ আবুল কালাম, চরমপন্থী দলের সদস্য বলে পরিচিত হাদিউজ্জামান হাদি, সোহাগ সরদার, ডাকাত সন্দেহে মইনুদ্দীন, বিএনপি নেতার ছেলে গোলাম আজম ওরফে পলাশ, সাধারণ পরিবারের সন্তান দুলাল হোসেন, যুবদল কর্মী মিরাজুল ইসলাম মিজা, ব্যবসায়ী তৈমুর রহমান তুরান, চরমপন্থী সন্দেহে ছব্দুল হোসেন, আওয়ামী লীগ কর্মী এনামুল হোসেন, বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম রবি, সন্ত্রাসী বলে পরিচিত শরিফুল ইসলাম নজু, শিক্ষক ও জামায়াত কর্মী আবু হুরাইয়া, শিবির কর্মী হাফেজ জসিম উদ্দিন। অপহরণের পর গুম রয়েছেন- আইউব, আজাদ হোসেন ও মোফাজ্জল। এই তিনজন চরমপন্থী দলের সদস্য বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এছাড়া ২০১৫ সালের ১৬ মে কোটচাঁদপুরের ফাদিলপুর গ্রাম থেকে একটি লাশ উদ্ধার হয়, ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই শৈলকুপার ত্রিবেনীতে একটি, ১৬ জুলাই ঝিনাইদহের ফুরসন্দি থেকে একটি, ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর শৈলকুপার কমল নগর থেকে একটি, ১৬ নভেম্বর ঝিনাইদহের বঙ্কিয়া গ্রাম থেকে একটি এবং ২৬ জুলাই শৈলকুপার রতনহাট থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। যাদের পরিচয় আজো মেলেনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, একের পর এক অপহরণ, হত্যা, লাশ উদ্ধার ও গুমের ঘটনায় ঝিনাইদহের পুরো জনপদ এখন চরম আতঙ্কে। অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালিগঞ্জের একাধিক ব্যক্তি জানান, সন্ধ্যার পর কোন কোন এলাকায় মানুষ আর ঘরের বাইরে বের হয় না। মানুষ চরম ভয়ের মধ্যে আছে। যারা স্বজন হারিয়েছেন তারাও এখন খুবই আতঙ্কে। একটি সূত্র জানায়, সোহানুর রহমান অপহৃত হওয়ার পরে তারা অনেকের কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। মাত্র ১৬ বছরের এক কিশোর অপহৃত হওয়ার পরে তার লাশ উদ্ধার হয়েছে অন্য জেলা থেকে। প্রায় প্রতিটি ঘটনার পরই থানায় সাধারণ ডায়েরী হয়েছে। কিন্তু এরপরই মিলেছে লাশ। এব্যাপারে কথা বলতে ঝিনাইদহের এসপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হচ্ছে এসব ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত নয়। তবে কে বা কারা জড়িত সে বিষয়টিও এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হচ্ছে না। এমনকি, থানায় সাধারণ ডায়েরী করা হলেও তার তদন্ত হয় না।