( এক )
----- নাঃ, আজ অফিসে গিয়েই দিন তিনেকের ছুটি নিয়ে নেব। যাওয়া আসা, তা বাদে একদিন থাকা। কাল সারা রাত্তির ওর মা , দু চোখের পাতা এক করেনি। খাওয়া-দাওয়াতো প্রায় একরকম ছেড়েই দিয়েছে। কি করব? পরপর তিন তিনখানা চিঠি দিলাম, একখানারও উত্তর নেই। প্রায় তিন মাস হোল মেয়েটা শ্বশুর বাড়ী গেছে, নতুন, কিজানি কেমন আছে? ওর মাকে আর কি বলব, এখন নিজেরই চিন্তা হচ্ছে। আর চিন্তা না বাড়িয়ে, ওর হাজার নির্দেশ মাথায় নিয়ে দুর্গা-দুর্গা বলে বেরিয়েই পড়লাম। সারা রাত ট্রেনে কাটিয়ে, সকাল নটার মধ্যেই পৌঁছে গেলেম মেয়ের বাড়ী।
মেয়েরা বোধহয় বহুদূর থেকেই বাবা-মায়ের গন্ধ পায়। গেটের সামনে পৌঁছতে না পৌঁছতেই মউ যে কোথা থেকে ছুটে এসে, আমায় দুহাতে জাপটে ধরল কেজানে? তারপর নিঃশব্দে আমার বুক ভিজিয়ে, নীরবে সব বুঝিয়ে, আমায় ভেতর ঘরে বসিয়ে চলে গেল। একা একা বসে বসে আমাদের মউ যে কবে এত বড় হয়ে গেল তাই ভাবছি। আর মনেরতো এই মজাটা বেশ ভালই জানা আছে, মানুষকে একা পেলেই, সে যে কত বড় দার্শনিক তা প্রমান করা। সেসব কথাই ভাবছি। ----- কে বলে, পরের জন্য মেয়ে মানুষ করা? নিজের সন্তান পরের হাতে দিলেও সে কখনও পর হয়না। মা-বাবাকে, মেয়েরা যে কত গভীরভাবে ভালবাসতে পারে, তাদের ভালবাসা যে কি অসীম, কি অনন্ত তা মেয়ে না থাকলে জানা হোতনা। এরকম মেয়ের বাবা হওয়ার জন্য আমি যেন এই পৃথিবীতে বারবার আসি।-------
( দুই )
বেশ কিছুক্ষন পর হেলতে-দুলতে বেয়ান এলেন। চিঠির কথা পাড়তেই একটু লজ্জিতভাবে জানালেন, শরীরটা ভাল না থাকায় উত্তর দিতে পারেননি। সে যাইহোক , ছেলের মায়ের এসব ত্রূটি অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তাই আর কথা না বাড়িয়ে, অতি বিনয়ের সাথে আমার আর্জি পেশ করলাম। -"ভাবছি মউকে এবার কিছুদিনের জন্য নিয়ে যাব।-" তা বুঝতেই পেরেছিলেন। তাই বললেন, "সে ভাল, নিয়ে যান। তবে দিন সাতেকের বেশী রাখবেন না।--------" আমার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হেসে উঠে বলি, -" সেকি? এতদূরে গিয়ে সাতদিন থাকলে হয় নাকি? ওর মাতো মাস খানেকের আগে ছাড়বেইনা। আমাদের দেশের জল-বায়ুর কেমন নামডাক আছে জানেনইতো। চলুননা, মউ এর সাথে আপনিও চলুন। দেখবেন কদিনেই শরীর মন কেমন সুস্থ হয়ে যাবে।-----------"
-"সে আশা আর নেই। তবে বুঝতেইতো পারছেন, মউ না হলে আমার সংসার একেবারে অচল।---"
---"সে কি কথা? মউ? মউ আবার সংসারের কি বোঝে?-"
-" কেন বুঝবেনা? শিখে, পড়ে কি আর কেউ সংসার করতে আসে? ও মেয়েরা জন্মেই শিখে নেয়।-------"
---"তা ভাল। তা ভাল। আসলে ওদের মাতো মেয়েদের দিয়ে কখনও কিছু করায়নি। তাই বলছিলাম আর কি ?---"
( তিন )
যাক অবশেষে জামাইর বাড়ীতে এক রাত কাটিয়ে , পরদিন মেয়ে নিয়ে রওনা হোলাম। বাড়ীতে বা রাস্তায় তেমন বিশেষ কিছু কথাই হয়নি। ট্রেনে উঠেও, দু-এক কথা বলেই, সেই যে আমার কোলে মাথাটা রেখে নিশ্চন্তে ঘুমিয়ে গেল, একেবারে স্টেশন এলে তবে ডেকে তুললাম। আসলে এতদিন পর আমার কোলটা খালি দেখে ও বোধহয় আর থাকতে পারছিলনা।
মেয়ে নিয়ে বাড়ীতে ফিরতেই ওর মায়ের সেকি আনন্দ। দুহাত বাড়িয়ে মেয়েকে বুকের মাঝে চেপে ধরে। বড় মেয়ে, মেজ মেয়ে ছোট বোন আসবে জেনে আগে থেকে এসেই বসে আছে। কিন্তু যার সমাগমে এত আনন্দ সে এত নীরব কেন?------ এত নিষ্প্রাণ কেন?
( চার )
পরদিন বিকেলে, তিন মেয়েকে নিয়ে, ওদের মা, গোল হয়ে বসে গল্প করছে। আমিও ওদের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছি। কিন্তু মউ এর কোন কথা আমার কানে আসেনা। হঠৎ মন আর মোম, ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলে, ----- " কিরে মউ, তুই এত আস্তে আস্তে কথা বলছিস কেন? ভয় নেই, কোলকাতা থেকে তোর শাশুড়ী তোর কথা শুনতে পাবেনা।------"
ওর মাও বলে, হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি, --"তোর কি শরীর টরীর খারাপ নাকি, এরকম ফিসফিস করে কথা বলছিস কেন?-----" খুব ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দেয়,---------------" কোথায় আস্তে? ঠিকইতো বলছি।-"
-"তোকে কি আমরা আজ নতুন দেখছি? সত্যি করে বল তোর কি হয়েছে?-"
-"সত্যি করে বলছি, কিচ্ছু হয়নি মা। আসলে এতদিন কথা না বলে বলে গলাটা কেমন যেন বুজে গেছে।---"
-"তার মানে, ওরা তোর সাথে কেউ কথা বলেনা?-"
-" না, না, তানয়, তানয়। ওদের বাড়ীতে কেউই কারুর সাথে কথা বলেনা।-----"
-" ওমা, একি অবাক কান্ড? তা মানস? মানসও বলেনা?-"
-" ওতো সেই সকালে নার্সিং-হোমে যায়, তারপর হাসপাতাল, তারপর আরও নানান জাযগায় কাজ সেরে একেবারে রাত্তিরে বাড়ী ফেরে।-----"
-" তা তোর শাশুড়ী?-------------"
-" উনিতো রাত-দিন শুধু রেডিও শোনেন আর ঠাকুর পূজো করেন।-" ------------- " ভাসুর, দেওর?---------"
-"ভাসুর তার রাজনীতি নিয়েই সর্বক্ষন ব্যাস্ত। আর বেকার দেওর, খাওয়া আর শোওয়া ছাড়া ঘরেই ঢোকেনা? তবে শ্বশুর মানুষটা বেশ ভালই। সংসারের যাবতীয় বাইরের কাজ উনিই করেন। বাবার মত তাস খেলেন আর কখনও কখনও জোরে বেসুরে গান গেয়ে ওঠেন। আমার তখন বেশ মজা লাগে।----------- আর একটা আশ্চর্যের বিষয় কি জান মা, ওদের বাড়ীতে না, কারুককে খাওয়ার সাজিয়ে দিতে হয়না। যে যার খাওয়ার নিজেরাই বেড়ে খায়। কাজের
বৌ, আমায় সব দেখিয়ে শিখিয়ে দেয়, আমি সেই মত রান্না করে রেখেদি। যে যার সময় মতো নিয়ে খেয়ে নেয়।-----"
--" তুই রান্না করতে পারিস?--" চোখ ফেটে যেন জল আসে । আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ--------। আর পারেনা, কান্না চাপতে চাপতে মায়ের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে বলে,---------" জান মা, আমিতো প্রথম প্রথম ভাত বেড়ে খেতে জানতাম না। কাজের বৌ আমায় বেড়ে দিত।-"
-"কেন, তোর শাশুড়ীকে ডাকতে পারিসনা?----"ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলেন, -"আমায় আর কিছু জিজ্ঞেস কোরনা, তোমার যেভাবে সুবিধে সেভাবেই কর।---"
-"ও মাগো, একি অনাসৃষ্টির কথাগো? এমন কথাতো আমি বাপের জন্মেও শুনিনি।-----------------"
( পাঁচ )
সাথে সাথে যত রোষ গিয়ে পড়ে, স্বামীর ওপর। এই মানুষটা, এই মানুষটা, যত নষ্টের গোড়া। সারাটা জীবন আমায়, বন্ধু বন্ধু করে জ্বলিয়েও ওর শখ মেটেনি, এবার আমার মেয়ের সর্বনাশ করে যদি ওর আশ মেটে। আমি বারবার বলেছি, বন্ধুর কথা শুনে ওরকম নেচোনা , নেচোনা। একবার অন্তত নিজের, চোখে গিয়ে দেখে এসো। তা সে কি চোটপাট। আরও বলে কিনা,----" দেবু কি আমায় মিথ্যে বলবে? দেবুর মামীমার খুড়তুতো ভাই। ডাক্তার ছেলে। খুব ভাল ছেলে। রোজগারপাতিও ভাল। আবার কি?-----"
--"কেন? আমার মেয়ে কি জলে পড়েছিল? রূপে-গুনে আমার মেয়েই বা কম কিসে? দাঁড়াও না, তোমার ওই দেবুকে একবার কাছে পাই, তারপর কি ব্যাবস্থা করি দেখো?---"
--" না, না, মা তুমি ওরকম করছ কেন? ওরাতো আমায় কোন কষ্ট দেয়না।-----"
--" চুপ কর। আমি সব বুঝেছি। ওরা তোকে জ্বালিয়ে মারবেনা, পুড়িয়ে মারবেনা, বিষ খাইয়েও মারবেনা। ওরা তোকে একটু একটু করে টিপে টিপে মারবে।---"
( ছয় )
বাবার ওরকম কালিমাখা মুখ আমি কখনও দেখিনি। নিমেষে বাবা যেন কেমন হয়ে গেল। আমাদের বাড়ীতে বাবার একটাই কাজ, রাত-দিন আমাদের নিয়ে হৈ-চৈ করা, মজা করা আর মায়ের ধমক খাওয়া। আমরা তিন বোনই বাবা অন্ত প্রান। মাকে আমরা সকলেই একটু সমীহ করে চলি। তবে মাও যদি বাবার মত ওরকম হুজুগে হোত, তাহলে সত্যিই আমাদের লেখা-পড়া হোত কিনা সন্দেহ আছে। মার শাসন ছিল বলেই যেটুকু হয়েছে। বাবার কাছেতো আমাদের শুধুই স্ফূর্তি আর আব্দার।
শীতের দিনে , অফিস থেকে বাবা ঘরে ঢুকেই বলত,---------"আহারে এই শীতে বাইরে বসে পড়া যায? যা, যা মশারির ভেতরে ঢুকে ভাল করে লেপটা গায় দিয়ে বোস।---" আবার গরম কালেও সেই একই কথা, -" এত গরমে এরকম ঘেমে-নেয়ে কি পড়া যায়?-----" বলেই ভিজে গামছা দিয়ে আমাদের মুখ মুছিয়ে দিত। মা, এসব শুনে বলত, -"হ্যাঁ, হ্যাঁ যত শীত-গ্রীষ্মতো শুধু তোমার মেয়েদেরই গায়ে লাগে, যত্তসব আদিখ্যেতা।-" হাসতে হাসতে বাবা, মায়ের মুখটাও মুছিয়ে দিত।
বাবার জুতোর মসমস শব্দের অপেক্ষায় আমাদের কান খাড়া হয়ে থাকত। বাবাকে দেখলেই আমাদের রূপ পল্টে যেত। তখন আর আমাদের পায় কে? ছোট থেকে আমার আর একটা বদ অভ্যেস ছিল, ঘুমোনের আগে পা টিপে দেওয়া। রোজ যত রাত্তিরই হোকনা কেন, বাবা এসে একবার আমার পা টিপে না দিলে আমার ঘুমই আসতনা। মা, দেখলেই বলত, -------------" যত্তসব বাজে অভ্যেস করাচ্ছ। মেয়ে মানুষ, কোথায়, কার সংসারে গিয়ে পড়বে, তখন কষ্ট হবে।---------"
আসলে মা সত্যিকারের জীবনটাকে চিনতে পেরেছিল। তবে বাবার মত এমন প্রানবন্ত মানুষ আছে বলেইনা, মানুষ এত দুঃখে এখনও হাসতে জানে। এমন কোন ছুটির দিন যেত না, যেদিন বাবার দু-একজন বন্ধু আমাদের বাড়ীতে খেতনা। মাও মার, ক্ষমতা অনুযায়ী সকলকে আপ্যায়ন করত। আমাদের বাড়ীতে এলে, সকলেই খুব খুশি হোত। আমাদের বাড়ী ছিল যেন একটা আনন্দ-নিকেতন। মায়ের ওপরটা ছিল ঠিক যতটা কঠিন, ভেতরটা ঠিক ততটাই নরম। আর বাবা? বাবাতো আমাদের পরম বন্ধু। " বারণ " বলে কোন শব্দ বাবার জানাই ছিলনা। ------------ আর এদের? এদের কারুর কোন বন্ধু নেই, বেড়ান নেই, আলাপ নেই, আলোচনা নেই। ------------সুখ নেই, দুঃখ নেই। শুধু মুখ বুজে দম বন্ধ করা এক জীবন।
( সাত )
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে রাত্রি। একইভাবে আমার দিন আসে , দিন যায়। এই এক ঘেয়ে জীবনের গ্লানি যেন আমার সজীবতাকে সম্পূর্ন শুষে নিয়েছে। --------------------- অস্বাভাবিক গভীর অন্তঃদৃষ্টি, যা হৃদয়ের তলদেশ পর্যন্ত ছুঁয়ে যেত, কিন্তু সেটা যতখানি বিশ্লেষণাত্মক ছিল, ততখানি বোধহয় আবেগ-প্রবন ছিলনা। --------------- সে অনুভূতি ছিল, এতই নগ্ন, যা ভাষা দিয়ে আমরা কেউ, কোনদিন, কারুককে বোঝাতে পারিনি। সদা-সর্বদা দুজনে দুজনকে এড়িয়ে শুধু রাস্তা করে দিয়েছি। কখনও কেউ, করুর পথ অবরোধ করে দাঁড়াইনি। পরতে, পরতে শুধু জটিলতার মশলাই মিশিয়েছি।
এটা আজ আর নতুন কিছু নয়। যা কোনদিনই ছিলনা, আজ তা শুধু নেই,------- নেই,-------- নেই। কিন্তু, কিন্তু কি প্রয়োজন ছিল এতখানি সহ্য করার? এতগুলো বছর শুধু একে অপরের অপরিহার্য হয়েই কাটিয়ে দিলাম। আচ্ছা, সত্যিই কি আমরা একে অপরের অপরিহার্য ছিলাম? না, সমাজ, সংসার , লোক-লজ্জার ভয়ে শিথিল বন্ধনকেও, শক্ত গিঁটে রূপান্তরিত করলাম।----------- যা আজ আর খোলা যায়না, কিন্তু ছেঁড়াতো যায়!
আগেতো খোলা যেত। কেন খুলে দিলেনা? কেন এভাবে কষ্ট পেলে, কষ্ট দিলে? ------- প্রতিবেশী বল, আত্মীয় বল, পরিজন বল, সকলেই একদিন দুঃখ করত, একমাস সহানুভূতি দেখাত, বড়জোর এক বছর সমালোচনা করত, এর বেশিতো আর কিছু নয়? কিন্তু আমি? আমিযে আমায়, আজীবন দেখব মানস? আমি, আমার সম্বন্ধে আজ কি ভাবব? ব্যার্থ?--------প্রতারিত?--------- না অবহেলিত? -------
( আট )
এসবই আমার মনের চিন্তা। জানিনা ওর মনেও ঠিক একই ভাবনা হয় কিনা? পরিচয় করেতো আমরা, কাছে আসিনি, কাছে এসে তবে পরিচিত হয়েছি। এক সাধারন ঘরের অতি সাধারন মেয়ে আমি। তাই আর দশ জনের মতই একজন হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। তার বেশি আর কিছুই নয়। যৌবনের যে ক্ষুব্ধ অভিমান, দুজনকে জুড়তে দিলনা, জুড়াতে দিলনা, তাই-ই পড়ন্ত বেলায় এসে হিসেব মেলায়। মেলেনা, মেলেনা, হিসেব মেলেনা।---------
ছুটির দিন, চায়ের পেয়ালা নিয়ে ওর পাশটিতে গিয়ে বসি। দেখি, চুপচাপ চা খেতেখেতে বই পড়ে যায়। আজ দশটা দিন ছেলেটাও কাছে নেই, একটু কথা বললেও মনটা হালকা হয়। ও যেন কেমন, কিছুই যেন বোঝেনা। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে, বাড়িতে এসে আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। কোনদিনই আমায় বুঝল না। ভেতরটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে একেবারে ভেঙ্গে যেতে চায়। পিকুরও নিশ্চয়ই আমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে? এই প্রথম আমাদের ছেড়ে একা এতদূরে আছে। কিজানি , কেমন আছে?
------- পিকু, তুই ছাড়া আমি যে বড় একারে পিকু। সারাটা দিনতো কেবল তোরই জন্য নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছি। মাত্র দুটো বছর নয়রে পিকু, সাতশ তিরিশটা দিন। আমি পাথর হয়ে যাবরে পিকু, পাথর হয়ে যাব। তবু , তবু তুই মানুষ হ, বড় হ, মাথা উঁচু করে দাঁড়া, এটাইতো চেয়েছি এতদিন। ভাল লাগেনা, ভাল লাগেনা, কিচ্ছু ভাল লাগেনা। কোন চেতনাই যেন আর কাজ করেনা। ভেতরটা শুধু হু-হু করে কেঁদে মরে।
( নয় )
হঠাৎ ওর চাপা কণ্ঠস্বর কানে এসে ধাক্কা মারে,--------
-"তুমি , কি আমায় কিছু বলবে?---"
--"নাঃ, তোমায় আবার কি বলব?----"
-" পিকুটা চলে গেল, তোমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝি।-"- -" তুমি বোঝ? ------ কেন? কেন বুঝব না?-----------------
-"চলে গেল নয়, চলেই গেল। আমি জানি ও আর কোনদিনই আমাদের মাঝে ফিরে আসবেনা।----"
-"কেন, দু বছর পরইতো ওর ফিরে আসার কথা ।-"
-" ও এমনি বলতে হয় তাই বলেছে । আর এটাইতো স্বাভাবিক। ওর মতো ছেলে দেখে, তবুও এতটা বছর আমাদের সঙ্গ দিয়েছে। এই-ই যথেষ্ট। আর পারছিলনা। তাই নীরবে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিল।------"
-"কিন্তু কেন? ওকেতো আমরা কখনও কষ্টে রাখিনি। সাধ্যমত ওর প্রয়োজন মিটিয়েছি। ভুলেও কখনও একটা কটূ কথা বলিনি। কোন ব্যাপারে কখনও নিষেধ করিনি। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেইতো বাঁচতে দিয়েছি।-------------"
-"হ্যাঁ, সবই দিয়েছ, সবই করেছ, শুধু একটি ছাড়া। প্রয়োজন মিটিয়েছ, মিলিয়েছ কি তার সাথে কিঞ্চিত আন্তরিকতা? কটূ কথা হয়ত শোনেনি, মিষ্টি করেওতো কখনও কাছে ডাকনি। এসবই তোমার অক্ষমতা, যা পারেনি ওর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে।------------ এখন বড় হয়েছে, সবই বোঝে। মা-বাবার এই নীরব, নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক হয়ত ওকে আঘাত করে। এতো খুবই স্বাভাবিক মানস, যে কেউ আমাদের মাঝে দুদিন কাটালেই বুঝতে পারত, একোন সহজ, স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নয়। ও আমাদের সব চাইতে আপন, তাই ওকে যেটা নাড়া দিয়েছে , অপরের হলে সেটাই কৌতূহল জাগাত।
------"আচ্ছা মানস, তুমি কি শুধুই একজন ডাক্তার? যে শরীর নিয়ে তুমি এত কাটা-ছেঁড়া কর, তার ভেতরেও যে একটা ছোট্ট নরম মন লুকিয়ে থাকে তা কি তুমি জান?-------"
( দশ )
এতদিনের চেনা ওর চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত ভঙ্গিতে, যেন একটা দানবের আর্তনাদ করে ফেটে পড়তে চায়,---------------------"না, না, আমি জানিনা, জানিনা। জানতে চাই-ও না। ডাক্তার হয়ে আমি জন্মাইনি আর জন্মেই আমি ডাক্তার হইনি। আমিও একদিন শিশু ছিলাম, আমারও একটা শিশু মন ছিল। সেই শিশু মনের কোন স্মৃতিই তেমন সুখের বা স্মরণের নয়। --------------দেখ মউ, জীবনে সব অভিজ্ঞতা, সকলের সমান হয়না। আমার মত অসুস্থ পরিবেশে তোমাদের নিঃশ্বাস নিতে হয়নি, তাই সবার মাঝে থেকেও আমি বড় একা! বড় একা! আজ আমার অন্তর্মুখী স্বভাবই বল, কি বাস্তববোধের অভাবই বল, কি স্বার্থপরতাই বল ---------- এসবের জন্য দায়ী কে? আমার সংসার, আমার সংসার। "
-" পারলামনা মানস, পারলাম না। তোমার এই কোলটানা যুক্তি আমি মেনে নিতে পারলামনা। সংসারে সকলে সমান উপযুক্ত হতে পারেনা। এটা নিশ্চয়ই কোন অপরাধ নয়? নিজের গুনে বল, চেষ্টায় বল, তুমি তা পেরেছিলে। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলে, সে তোমারই গৌরব, মানস। যারা তা পারেনি, তাদের প্রতি কি তোমার কোন কর্তব্যই ছিলনা।? একমাত্র ভরণ-পোষণ ছাড়া তুমি তাদের প্রতি আর কি করেছ বল? --------- মানস, তুমি যাদের শুধু প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছিলে, তারা সকলে কিন্তু তোমার দিকে চেয়েছিল একটু মনে-প্রানে বাঁচতে।
আর তুমি? তোমার অহংবোধ? শুধু নিজেকে দেখেছে, নিজেকে চিনেছে। কি? কি লাভ হোল এতখানি আত্ম-সচেতন হয়ে? চলে গেল। চলে গেল। সকলে চলে গেল। বড় ভাই রাজনীতিতেই ভেসে গেল। বেকার ছোট ভাই, বেকারত্বের যন্ত্রনা নিয়ে একদিন হারিয়েই গেল। তোমার শেষ শিকার শুধু আমি পড়ে আছি বুক চিতিয়ে।------------
( এগার )
কিন্তু আমার সংসার, আমার সংসারতো আমার কাছে এর বেশি কিছু চায়নি? কেউ কোনদিন আমায় আদর করে কাছে ডাকেনি। আপন করে কথা বলেনি। তাই তোমার ডাকেও আমি সাড়া দিতে পারিনি। তবে মউ, তুমি কষ্ট পাও এ আমি কখনও চাইনি।
--"কষ্ট? তাও ভালবেসে দাওনি। তাই নিজেকে বড় খেলো মনে হয়েছে।---"
---"তুমি শিক্ষিত, বুদ্ধিমতি। সবার ওপরে সুস্থ পরিবেশে প্রতিপালিত। সুতরাং এ ধরনের প্রশ্নের যে একদিন আমায় সন্মুখীন হতে হবে এ আমি জানতাম।--"
---"সেই প্রতি-পালনের মূল্যই বা আমি কতটুকু দিয়েছি, মানস? যে বুকের রক্ত জল করে তারা আমায় এত বড় করেছে, তাদের প্রতি কি আমার কোন কর্তব্যই ছিলনা? আজ এসব কথা মনে হলে নিজেকেই ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়।------ কন্যা হিসেবে আমি ব্যার্থ,
--জায়া হিসেবে ততোধিক,
--- অন্তত জননী হিসেবেওতো সার্থক হতে পারতাম?--------
-"বুকের ভেতর যে ঠান্ডা লড়াই এতদিন, এভাবে পুষে রেখেছ, তা এভাবে এতদিন কেন আমায় বলনি?---"
--" কি করে বলব? সে অবকাশ তোমার কোথা?
----- যে মনের মিল ছিলনা,
----- শরীরের মিলন ছিলনা,
------- ঠোঁটে ভাষা ছিলনা,
----- চোখে স্বপণ ছিলনা. শুধু চারপাশে এক অদৃশ্য প্রাচীর দিয়ে আমায় ঘিরে রেখেছিলে। কোনদিনতো টোকা মেরে ছুঁয়েও দেখনি, একি রক্ত-মাংসের মানুষ?--------"
--"আমি যা পারিনি, তুমিতো তা পেরেছিলে, তবে তুমি কেন হেরে যাবে?---"
--"এ তুমি কি বলছ? স্বামী-সন্তানের মাঝে হার-জিতের কোন শব্দই নেই। এদের কাছে হেরে গিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, জয় করে তা হারিয়ে যায়।
দিনের পর দিন ও স্ব-চোক্ষে দেখেছে , তোমার আমার অবস্থান। প্রথমত বয়স হয়েছে, দ্বিতীয়ত আজকালকার ছেলে, এরা আমাদের মত তিলতিল করে মরেনা। যা চায়, তা পাওয়ার জন্যই চায়। যা বলে, তাই-ই করে। জীবনটা উপভোগ করার প্রবণতা এদের প্রবল। যা হয়ত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিরও আশঙ্কা হয়ে দাঁড়ায়।
---"আজ বুঝতে পারি সুখের সঙ্গা যে জানেনে, সে কি করে সুখী করবে অপরকে? এ অসম্ভব, অসম্ভব।----
---এতদিন দেখেছি, চিনেছি, বুঝেছি। সাতপাকের বাঁধনে আজও কাছেই আছি, তবে অনেক , অনেক দূরে সরে গেছি, মানস। আমার ত্রূটি-হীন সংসার চালনায় তুমি আজ ভীত, তাই পারনা ক্ষনেকের তরেও, মুখোমুখি হতে।----"
( বার )
---একটা কথা আমার কি মনে হয় জান, যে কোন মানুষের জীবনে, তার মায়ের ভূমিকা সব চাইতে ওপরে। মায়ের পরিচালনাতেই একটি সুস্থ, সুন্দর , সুসন্তান গড়ে ওঠে। আমরা ছোট বেলা থেকে কখনও মায়ের কাছে সে শিক্ষা পাইনি। নীতিবোধ বল, কর্তব্যবোধ বল, সবার ওপরে ছিল হিংসাবোধ আর স্বার্থপরতাবোধ। এই সব উপলব্ধি গুলোই, উনি আমাদের ভেতরে এমন নিপুণভাবে চারিয়ে দিয়েছিলেন যে, প্রৌঢ়ত্বেও তা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দেখছ না, আমরা এতজন ভাই-বোন, অথচ বছরান্তে কেউ কারুর একবার খোঁজ পর্যন্ত করিনা। প্রতিটি ভাই-বোনই যেন একেকটা স্বার্থপরের ডিম। যে হিংসা আগে অপরকে করেছি, তাই-ই আজ শেষে নিজেকে করছি। -------- তবে তুমিতো সেরকম মা নও, দেখবে তোমার সন্তান ভালই হবে। অজান্তে আমার দেওয়া সকল ব্যাথা, সহস্রগুন সুখ হয়ে তোমার ওপর ঝরে পড়ুক।-------
--------- তোমার বোলনা, বল, ও আমাদেরই সন্তান। মা-বাবার সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক সন্তানের ওপর সব চাইতে বড় প্রভাব ফেলে। যে সুখ তুমি আমায় দিতে পারনি, তা আমি ওর ওপর দাবি করব কোন অধিকারে, মানস?-----------
------- তুমিতো জান, আমার দিদার, একমাত্র মেয়ে আমার মা ছাড়া এ সংসারে আর কেউ ছিলনা। আমার বাবা-মাও অত্যন্ত শ্রদ্ধা-সন্মান, আদর-ভালবাসা দিয়ে দিদাকে কাছে রেখেছিলেন, তবুও দিদা যে কেন প্রয়ই একটা কথা বলতেন?
-"সকালের অন্নে যার ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়না,
------ বিকেলের ভাতে তার খিদে মেটেনা।---------
তখন কথাটির গুরুত্ব বুঝিনি, তবে আজ বুঝি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:০০