( এক )
কৈশোর পেরিয়েই যে স্বাবলম্বীতা -------- যা মানুষকে অর্জ্জন করতে হয় না। প্রকৃতির নিয়মে আপনিই এসে যায়। কিন্তু কিছু কিছু স্বল্পায়ু স্ত্রীর স্বামীরা বোধহয় প্রৌঢ়ত্বে দ্বিতীয়বার স্বাবলম্বী হয়। স্বামীর ছত্র-ছায়ায় দাঁড়িয়ে, স্ত্রী যে শক্ত ভূমি গঢ়ে তোলে, তার অবর্তমানে, সেই ভূমিতেই তখন একাকী দাঁড়ান বড় কঠিন হয়ে পড়ে।
তিলে তিলে গড়া সংসারে, পলে পলে কত নিয়মেরই না বাধ্য বাধকতা, না জেনেই দিন কেটে গেছে। হারিয়ে কিছুই যায়না, সবই রয়ে গেছে আমাদেরই মাঝে। তবে এতদিনতো খুঁজিনি কিছুই, না চাইতেই পেয়ে গেছি, ------- আজও পাই, তবে আগে খুঁজে নিতে হয়।
( দুই )
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে, আমার শ্বশুর-মশাই তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন। সেই থেকেই পিতা-পুত্রের এই সংসার। মেয়ে-মানুষ বলতে একমাত্র মিনতি-দি। অবশ্য মিনতি-দিই এ বাড়ীর প্রকৃত অভিভাবক।
আমার স্বামীর জন্মেরও আগে, আমার শ্বশুর যখন তাঁর পরিবার নিয়ে, নতুন কর্মস্থলে যান, তখনই আমার দিদি-শাশুড়ী নাকি মিনতি-দিকে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন। শুনেছি আমার শাশুড়ী ছিলেন অপূর্ব্ব সুন্দরী। তিনি নাকি ছেলেকে বলেছিলেন,----- "তোকে বিশ্বাস নেই, তুই যা কাজ পাগল মানুষ, হয়ত আমার বৌকে একা ফেলে কোথায় কোথায় চলে যাবি। তার চাইতে বরং মিনতিকে তোদের সাথেই নিয়ে যা। আমার একার আর কতটুকু দরকার? ----" সেই থেকেই মিনতি-দি এখানে।
---------------- কালের স্রোতে সুখ-দুঃখ সমান ভাবে বয়ে চলে। কোন বিপদ যেমন পারেনা এর গতি রোধ করতে, তেমন কোন উচ্ছাসও পারেনা একে ধরে রাখতে। ----------
( তিন )
এরকমই এক পুরুষ প্রধান সংসারে আমি এসেছিলাম বধূ বেশে। একজন উন্নত মনস্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারা যে জীবনের কতখানি প্রাপ্তি ----- তা এ সংসারে না এলে আমার অজানাই থেকে যেত। মিনতি-দির পরিচালনায় এবং আমার আন্তরিকতা দিয়ে, তাদের সেবা-যত্নে ভরিয়ে তুলতে চেষ্টা করি। আশ্চর্যের বিষয়, এই দুই অসম-বয়সী পুরুষের মধ্যে সুখী হওয়ার প্রবনতা এতই বেশী যে, অতি অল্পেই, আমি এ সংসারে একজন যশস্বী হয়ে উঠি। ছোট্ট এই সুখের সংসার দিনে দিনে যেন আরও রঙ্গীন হয়ে উঠতে চায়। ঘর আলো করা সন্তান বুকে নিয়ে আমি তাঁদের কাছে হয়ে উঠি আরও রমনীয়।
------- ঋষির আগমন, সকলের আনন্দের মাত্রা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। বাবার মত ছেলেও মিনতি-দির কোলেই বেড়ে উঠল আর দাদুর উষ্ণ পরশে ভরে রইল।
( চার )
পারি-পার্শিক অবস্থা দেখে দেখে, শ্বশুর বাড়ী সম্বন্ধে এতদিন আমার খুব একটা ভাল ধারনা ছিল না। কিন্তু নিজের জীবনে তা ক্রমশ ভুল প্রমানিত করে, আমায় নতুন করে শিক্ষা দিল। কখনই অধিকারের অপব্যবহার করে, অন্যের স্বধীনতা হরণ করা তাদের কারুরই কাম্য ছিলনা। ফলে মুক্ত বিহঙ্গের মত আমিও তাদের ওপর ডানা মেলে ধরেছি। নতুন জীবন বা ভিন্ন পরিবেশ , আমার নিয়মের বিশেষ কোন ব্যাতিক্রম ঘটায়নি। আমি গান গাইতাম, বিয়ের পরেও এরজন্য রীতিমত তালিম ও রেওয়াজের কোন ব্যবস্থার কোনরকম কার্পণ্য হয়নি। সুষ্ঠুভাবে, সুনন্দরমত সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এর মধ্যে সারাদিন সংসারের টুকটাক কাজও করে গেছি। সকাল বা বিকেলে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেই, উনি ঋষিকে আগলিয়ে রেখেছেন, যাতে আমার সাধনায় কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
একজন পুরুষ মানুষ, যে কিভাবে সংসারটাকে আগলে রেখেছিলেন তা সত্যিই দেখার মত। আসলে এটা পুরুষ বা নারী বলে কোন কথাই নয়। এ হচ্ছে অন্তরের উদারতা। যা মানুষকে শুধু সুখের সাগরে ভাসিয়ে রাখতেই জানে। যে মুক্তি নিজে উপভোগ করেছেন, তাই বিলিয়ে দিয়েছেন দু-হাত উজাঢ় করে। ফলে কারুর কাছেই অতিরিক্ত হয়ে যাননি। ক্ষমতা অনুযায়ী সবার কথা ভেবেছেন। ----- ঋষির পাঁচ বছর বয়স থেকেতো, শিশুর মত , সর্ব্বক্ষন ওর সঙ্গীই হয়ে গেলেন। আবার আমায়ও বলতেন, ----" বৌমা, ঋষিতো মানুষই হয়ে গেল, এবার তুমি বরং এম,এ তাও কমপ্লিট করে নাও।------"
এত সুখ আমি বোধহয় কখনও মনের অজান্তেও কামনা করিনি। সামান্য একটু উদারতা, একটু কর্তব্যবোধ যে মানুষকে কত সমৃদ্ধ করে তোলে, তা ওনাকে দেখে আমি শিখেছি।
( পাঁচ )
কিন্তু এত সুখেও আমি কাঁদি। না, না আমি কাঁদিনা, আমার অন্তর কাঁদে। বুকের ভেতরটা কোথায় যেন রিণরিণ করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। ----- অতি প্রিয় দুই সহোদরার জন্য। ----------- আমার বড়দি ছিল অত্যন্ত মেধাবী ও নিরীহ প্রকৃতির। তার একটাই দোষ ছিল, সে পড়শোনাটা করতে একটু বেশীই ভালবাসত। এর জন্য ওর শ্বশুর বাড়ী থেকে আমার বাবা-মাকে কম কথা শুনতে হয়নি। কারন বাপের বাড়ী থেকে নিয়ে আসা ডিগ্রি, সেতো কেবল পুত্রের ও বংশের মর্য্যাদা বৃদ্ধির জন্য। তারপর তার আর কি প্রয়োজন?
-------- আর ছোট বোন ছিল, একজন উঁচু মাপের শিল্পী সত্ত্বার অঝিকারী। খুব ভাল আঁকতে পারত। বিয়ের পর পরই তার সেই রঙ, তুলি সব শিকেয় উঠল। একমাত্র লক্ষী-পূজোর দিনই, আলপনা দেওয়ার জন্য, বৌ এর সেই গুনের কথা কারুর বা স্মরণ হোত। ------- এর বেশী আর কি চাও?
রীতিমত শাশুড়ী ননদ পরিবৃত হয়েও, সারাটা জীবন কি শাস্তিই না এরা ভোগ করেছে। সামান্য বাবা-মাকে দেখতে আসার অধিকারটুকুও এদের ছিলনা। কারণ তাঁদের চিন্তায় বউ মানেই, বাড়ীর এক বিশ্বস্ত প্রহরী ও একজন নিরলস কর্মী। অন্তরের ক্ষুদ্রতা প্রকাশের এর চাইতে বীভৎস রূপ আর কি-ই-বা হতে পারে আমার জানা নেই।
এসব নারীরাই , আবার যখন দেখি , স্বোচ্চার হয়ে ওঠে নারী মুক্তির আন্দোলনে, তখন জানতে ইচ্ছে হয়, ------ নারী, তোমায় শৃঙ্খলিতই বা করল কে?------------ আর মুক্তিই বা দেবে কে? ? ?
কতজন? কতজন নারী পারেন, অপর একটি নারীকে মুক্তির স্বাদ দিতে? ঘরে ঘরে আজ নারী দ্বারাই, নারী অধিক নির্যাতিতা। এত যে বধূ হত্যা, বধূ নির্যাতন। এর পেছনেও কি নেই কোন সম-গোত্রের ইন্ধন যোগানোর প্রচেষ্টা? তবে? তবে আজ তার নিজেরই গড়া সেই খোলস ভাঙ্গার খেলা কেন? কেন? কেন ? নিরন্তর গোষ্ঠী-যুদ্ধেই যারা ব্যাস্ত, প্রতিপক্ষ তাদের আর কতটুকু হরণ করতে পারে? মাঝে মাঝে, এদের দেখে আমার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, -" নারী, তুমি জাগো, জাগো। আর কতকাল? কতকাল, নিজের রক্ত নিজে পান করবে? ? ?"
( ছয় )
আমার ছেলে ঋষি তখন ক্লাস টুতে পড়ে, সবে ওকে পড়াতে বসিয়ে, আমি একটু হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি। হঠাৎ ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি বেশ কড়া সুরেই বকে উঠি। ------ " কি হোল, তুমি আবার পড়া থেকে উঠে এলে কেন?----" আমার আঁচলে মুখ লুকিয়ে, আধো আধো সুরে বলে, -----" তোমায় দেখতে।----"
সেদিনের কথা আমি কোনদিন ভুলবনা। পাশেই কোথাও ছিলেন আমার শ্বশুর মশাই। কি অপূর্ব্ব শান্ত ভাবে আমায় বোঝালেন, -----" ওরকম করে ওকে বোকনা বৌমা। ওকে দেখতেও শিখতে দাও। যে হাত দুটো ওর জন্য দিবা-রাত্র এত পরিশ্রম করছে, তার মুখটাও একটু দেখতে শিখুক। এসব জিনিষ ছোট থেকে না শিখলে বড় হয়ে আর শেখা হয়না। জীবনে এর প্রয়োজনও অনেকখানি। ------- ববিও (আমার স্বামী) ঠিক ওর মতই ছিল। ওর মা ছিল ওর বন্ধুর মত। সব কথা মাকে বলা চাই-ই। আমার সাথেও হৃদ্যতা কম ছিলনা। তবে আমিতো কাজের চাপে, বাইরে বাইরেই বেশী থাকতাম। তাই মাকে নিয়েই গড়ে উঠেছিল ওর পৃথিবী।-"
( সাত )
মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে , ববি ওর মাকে হারিয়েছিল। এমন অতর্কিত আক্রমনে আমরা দুজন যেন বাজ পড়া মানুষের মত স্থির হয়ে গেছিলাম। মাত্র কয়েক ঘন্টার প্রচন্ড জ্বরে, ডাক্তার কিছু বোঝার আগেই ও আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ওর ভেতর যে কি হয়েছিল , কেউ বুঝতেই পারলনা। দিব্যি ভাল মানুষ, কোন রোগের লক্ষণ নেই, আচমকা আমাদের একা ফেলে রেখে কোথায় যে সে পালিয়ে গেল? মৃত্যুরও তো একটা প্রস্তুতি থাকে, কি বল? অথচ ওর মৃত্যু এতই অস্বাভাবিক ছিল যে, আমাদের কান্নার বোধটুকুও ছিলনা। কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। সেই সময় দুঃখের থেকেও বেশী হয়েছিল অভিমান, প্রচন্ড অভিমান। বহুদিন আমরা দুজন কেউ করো সাথে কথা বলতে পারিনি। প্রতি মূহূর্তেই মনে হয়েছে, কেন? কেন ও চলে গেল?
আত্মীয়-স্বজনরা সব, যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম সেরে, একে একে যে যার বাড়ী ফিরে গেল। ববি সর্ব্বক্ষন ওর ঘরে মুখ গুঁজে বসে থাকে। আর আমি যেন একটা বদ্ধ উন্মাদের মত কেবল ছুটে বেড়াই। এক মূহূর্তও কোথাও তিষ্ঠোতে পারিনা। করো সাথে দু-দন্ড দাঁড়িয়ে একটু কথা বলতে পারিনা। দিবা-রাত যেন এক তীর বেঁধা পাখীর মত ছটফট করছি। তবে সেই সময় মিনদি-দি আমাদের জন্য যা করেছেন, তার ঋণ আমরা জীবনে শোধ করতে পারবনা।---------------- শেষে মিনতি-দিই একদিন খুব কড়া করে আমায় বললেন, -"কি ব্যাপার , এভাবে আর কতদিন চলবে? ছেলেটাওতো এবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। ওর দিকেও একটু তাকানো প্রয়োজন। সে কথা কি খেয়াল আছে?---------------"
( আট )
মিনতি দির কথায় আমি চেতনা ফিরে পাই। আস্তে আস্তে আবার সব গুটিয়ে আনি। তারপর একদিন ববিকে ডেকে বললাম, ----" চল, আমরা কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে ফ্রেস হয়ে আসি। তারপর শুরু হবে তোর পড়া আর আমার কাজ । দেখবি আমিও সব পারি। -"
বেশ কিছুদিন এদিক-ওদিক ঘুরে আমরা বাবা ও ছেলে যেন দুই বন্ধুর মত এক মেসে এসে উঠলাম। জানিনা আমি ওর অভাব কতটা মোচন করতে পেরেছি, তবে ববি যেন আমায় একেবারে নতুন করে গড়ে তুলল।
------ কেবল মাত্র সেই একদিনই কথা প্রসঙ্গে, উনি ওনার আক্ষেপের কথা আমায় শুনিয়ে ছিলেন। তার প্রকাশভঙ্গীও ছিল এতই দৃপ্ত ও সাবলীল যে কখনই কোন বুড়ো-হাবা বৃদ্ধের কাহিনী শুনছি বলে মনেই হয়নি।
মনে মনে ভাবি, কি অভিজাত অভিমান,, এ এমনই দুরন্ত চাপা অভিমান, যা প্রকাশেও বুঝিবা, হালকা হয়ে যায়।
( নয় )
বয়সের ভারে অবনত অথচ চেতনায় প্রসারিত। সকলের প্রতি সমান, সজাগ দৃষ্টি ------- ওনাকে আমার কাছে দেবতূল্য করে রেখেছেন। এতটুকু কঠিন কথা বা বাঁকা চাহনি আমায় কখনও বুঝতে হয়নি। সন্তানের প্রতি একই সাথে স্নেহ ও সন্মান বিলিয়ে দিয়েছেন।----- -- - "ক্রমশঃ আমাকে শিশু করে, কবে থেকে যেন ববিই আমার অভিভাবক হয়ে গেল। সর্ব্বদা আমার প্রতি এক প্রচ্ছন্ন, সজাগ দৃষ্টি , আমায় কর্মহীন করে বসিয়ে রাখেনি। নানা রকম সামাজিক দায়-দায়িত্ব দিয়ে আমায় সংসারে আরও আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে দিল। এছাড়াও টাকা পয়সা সংক্রান্ত সব ভার আমার ওপর চাপিয়ে, আমায় একেবারে চাঙ্গা করে রাখতে চাইল। আসলে ওতো প্রচন্ড বুদ্ধিমান ছেলে, এই বয়সেই, জীবনের এই সার তত্ত্বটুকু ও বুঝে ফেলেছে যে সংসারে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের দ্বারাই সম্পর্কের ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। পরস্পরের কাছে এই প্রয়োজন যতই কমে আসে, সম্পূর্ণ সম্পর্ক বিনষ্ট না হলেও, কিছুটা হালকা বোধহয় আপনা থেকেই হয়ে যায়। -------------"
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৩৯