( এক )
সম্পর্কের সাথে সম্বোধন কিংবা সম্বোধনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন ওতো-প্রোতোভাবে জড়িত। আকারে, ইঙ্গিতে, ভঙ্গিতে, স্বরে বা সুরে বিভিন্ন প্রকার সম্বোধনে তার রূপ শুধু বদলে বদলে যায়। সামান্য গাল ভরা একটা ডাক যেমন অনেক দূরকেও কাছে টেনে নেয়, আবার এটুকুরই অভাবে, কত সম্পর্ক হয়ত বা অকালে ঝরেও যায়। আসলে, যেভাবে যুগের পরিবর্তন হয়, ভাবাবেগ বোধহয় সেভাবে পরিবর্তন হয়না। কারণ কোন নির্দিষ্ট ভাষা বা শিক্ষাতো কখনও এর প্রতিবন্ধক হয়না। তাই যেকোন ভাবের প্রকাশেই সে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। হাসি আর কান্নার মতই সে সহজ ও স্বাভাবিক। হেসে গড়িয়ে পড়া, কি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার জন্য যেমন কারুককে শেখাতে হয়না, ঠিক তেমনই। যে ডাকে, আর যাকে ডাকে উভয়ের যোগা-যোগটাই যথেষ্ট। নয় কি?
তবে, স্বরযন্ত্রের নৈপুন্যে, বিধাতার তৈরী শ্রেষ্ঠ জীব, মানুষের এ ব্যাপারে একটা মস্ত সুবিধা আছে। এই যন্ত্রের নিপুণতায়, সে বিভিন্ন জনকে, বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন সুরে, ডেকে আনন্দ পায়। আর এটাতো খুবই স্বাভাবিক, যে যত আপন, যে যত কাছের, সে তাকে তত তুচ্ছাতি-তুচ্ছ নামে ডেকেই শান্তি পায়। যেমন বাবা-মা, তাদের অতি আদরের কোলের শিশুটিকে বুড়ি, পুঁটি, গবা, নেড়া এসব ডেকেই তৃপ্তি পায়।
( দুই )
আমার, সমস্যাটা কিন্তু এখানেই। আমি বুঝিনা ডাকে কি এসে যায়? বড় পিসিতো এখনও প্রায়ই দেখ না দেখ ঠাকুমাকে, দেখি বৌদি বলে ডাকে। আসলে পিসির ছোট বেলায় ঠাকুমাকে বৌদি ডাকার সংখ্যাটা ছিল এতই বেশী যে পিসির কান দুটো তাই বৌদি শুনে শুনে ওতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পিসির এই অদ্ভুত সম্বোধন নিয়ে কিন্তু কোনরকম অশান্তি নেই। বরং উপাদেয় হিসেবে হাসাহাসিই বেশী হয়। যত্ত সমস্যা কিনা আমার বেলায়?-------------
( তিন )
আঙ্কেলকে আমার ভালোলাগে। তার চাইতেও আসল কথা হোল আঙ্কলকে আমি খুব ভালোবাসি। সব কিছুর ওপর, আমাদের মধ্যে যে এক সুগভীর, নিবিড় সম্পর্ক বিরাজ করে, তা সামান্য এই ডাকাডাকির ব্যাপার দিয়ে কখনও মাপা যায়না। অথচ এরা, অর্থাৎ আমার মা, ঠাকুমা, এরা বোধহয় আমাদের এই সুস্থ সম্বন্ধটা আর টিকতে দেবে না।
চব্বিশ ঘন্টা সেই একই কথা, -"বাবা ডাকতে পার না?-----" আচ্ছা, কি হয়েছেটা কি? বাবা নাই বা ডাকলাম। তাই বলে কি আমি, আঙ্কেলকে বাবার চাইতে কম ভালবাসি? বরং বাবার চাইতেও অনেক, অনেক বেশী ভালবাসি। কতরকমভাবে যে এরা আমায় পরীক্ষা করে?-------- প্রতিদিন রাতে খাবার গুছিয়েই ঠাকুমা বলবে, ---------- "মেঘনাদ, বাবাকে খেতে ডাক।---------" আসলে ঠাকুমার মনোগত বাসনা সেই একটাই, অর্থাৎ আমি নীচ থেকে আশ-পাশ কাঁপিয়ে তারস্বরে, -"বাবা খেতে এস।- " এই শব্দ তিনটে বলে হাঁক পাড়ি। তাহলেই কিন্তু সব সমস্যার সমাধান। আর আমিও তেমনটি, যেই না বলে অমনি এক-ছুট্টে চলে যাই সোজা ছাদে। যেখানে আঙ্কেল মাদুর পেতে রোজ শুয়ে থাকে। আগে যখন আরও ছোট ছিলাম তখন গিয়েই খেলা, গল্প, কথা, নানান কিছু নিয়ে মেতে যেতাম। এখন বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ওসব হুটি-পুটি আর মানায় না। তাই গিয়েই চুপটি করে আঙ্কেলের বুকের মধ্যে মুখটি গুঁজে শুয়ে পড়ি। আমি জানি, আঙ্কেলও প্রতিদিন এই ছোঁওয়া টুকুর অপেক্ষাতেই চোখ বুজে থাকে। আঙ্কেল বোঝে,
--------- বাবাতো অনেক দূর থেকেও ডাকা যায়, কাছ থেকেও ডাকা যায়। ভালবেসেও ডাকা যায়, ভাল না বেসেও ডাকা যায়। কিন্তু বুকের ভেতর মুখ গুঁজে, নিঃশ্বাস পুঁতে সেভাবে কি ডাকা যায়? তারপর আস্তে আস্তে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কত কি বলে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পূর্ব জন্মের মিলন ছাড়া এ আকর্ষণ অসম্ভব। এ প্রেমতো এক জনমে সৃষ্টি হয়নি। জন্মে জন্মে আমাদের মধ্যে সঞ্চিত যে স্বর্গীয় ভালবাসা তা কি দেখা যায়? না দেখান যায়? ------------ তা এরা বুঝতেও পারে না। শুধুভাবে বাবা না ডাকলেই বুঝি ভালবাসা হোল না। আরে মাত্র সাত বছর বয়সে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। ওইটুকু বয়সে তাকে কতটুকু চিনেছি? কতটুকু পেয়েছি? কতটুকু দেখেছি? যে হারিয়েছি বলব? সত্যিকারের পিতৃহারাতো হব আমি, সেদিন ---------- যেদিন আঙ্কেলকেও হারাব। সে উপলব্ধি এদের কোথায়? রাত-দিন, সেই একই বুলি, -----" বাবা ডাকতে কি অপমান হয়? বাবা ডাকতে কি অপমান হয়? ------------ " হাসিও পায়। মাও দেখি সেদিন ঠাকুমাকে নালিশ জানাচ্ছে। -------------- " দেখেছ মা, কেমন ঢেঁটা ছেলে? আমরা এত করে বলে বলেও কি পেরেছি আজ পর্যন্ত ওর মুখে এই শব্দটা বার করতে?----------"
( চার )
আসলে এসবই হোল লোকলজ্জা। তুমি নিজের চোখে নিজেকে দেখতে পাবেনা। লোকের চোখে তোমায় নিজেকে দেখতে হবে। লোকে যদি তোমায় ভাল বলে, তবেই তুমি ভাল। আরে যে নিজের কাছে ভাল, সেতো সবার কাছেই ভাল। এসব হীনমন্যতা। এসব হীনমন্যতা। সবই বুঝি । কিন্তু কি করব? ওই শব্দটা যে আমার আর মুখে আসেনা।
এমনওতো হতে পারে, শিশু মনের ওপর অতি প্রিয় জনের হারিয়ে যাওয়া, হয়ত এমন এক ভীতির সৃষ্টি করেছিল যে, আজও ওই শব্দটা আমার গলা পর্যন্ত এসেই আটকে যায়? --বাবা-- ডাকতে আমার বড় কষ্ট হয়। ওই শব্দটা আমি যেন আর ডাকতে পারিনা, ----- ডাকতে চাইনা। অথচ এরা সেটা কেউ বোঝেনা।
তাবলে কি, আঙ্কেলকে আমি কম ভালবাসি? বরং বাবার চাইতে ঢের ঢের বেশি ভালবাসি। দশ বছর বয়সে, একটা ছেলের মধ্যে যে বিচক্ষন অনুভূতির ক্রিয়া করে, তা ব্যাক্ত করা বড় কঠিন। বাবাতো আমায় মাত্র সাতটা বছর পেয়েছে। নেহাতই শিশুকাল। শুধুই হেসেছি, খেলেছি আর আব্দার করেছি। আর আঙ্কেল? ----------- আঙ্কেল আমার সঙ্গে আঠারো, আঠারোটা বছর কাটিয়ে দিল, শুধু বন্ধুর মত ------ সন্তানের মত --------- অভিভাবকের মত। আমার চোখে এক মহান আদর্শ। ভগবান যেন আমাদের দুজনকে যোগ করার জন্যই, সংসারে এই নিদারুণ বিয়োগটা ঘটিয়েছিলেন। আমরা যেন একই গ্রন্থির দুটি বিন্দু,
"--------- আমাদের অস্তিত্ব আলাদা, কিন্তু সত্ত্বা এক ,
----------- রক্ত আলাদা , তবে রং এক,
-------------জীবন আলাদা, তবুও সুখ এক, যন্ত্রণা এক ------"
( পাঁচ )
আঙ্কেল তার সুক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে আমার কষ্টটা এত সুন্দর উপলব্ধি করতে পারে যে, আমাকে কিছু বলতেই হয়না। সেই ছোট্ট বেলার থেকেই দেখেছি, ঘরে ঢুকে, আঙ্কেলের প্রথম কথাই ছিল, ----- " হ্যালো বিগ, বস।-----" সত্যিকারের বড় হওয়ার পর সেটা হয়ে গেল শুধুই - বস - তারপর সাইকেল চাপা, দোলনায় দোলা। আরও একটু বড় হয়ে বাগানে ক্রিকেট খেলা, আরও কত কি। এই সবের জন্য আমি যে কেমন চাতক পাখীর মত মুখিয়ে থাকতাম তাতো তোমরা সবাই জানো।
তখন মা, ঠাকুমা কারুরই আমার প্রয়োজন হোত না। তোমরাইতো বলতে, নীল ওর আঙ্কেলকেই সব চাইতে বেশী ভালবাসে। তবে? তবে তোমাদেরই মধ্যে আজ এত দ্বিধা কেন? আজ হঠাৎ কি আমার সমস্ত ভালবাসা একেবারে কর্পূরের মত উবে গেল? --------------- যে দিন চোখ খুলে দেখতে শিখেছি, দৃষ্টি দিয়ে ধরতে শিখেছি, সে দিন থেকেইতো তোমরা চার জন সদা সর্বক্ষন আমায় ঘিরে রয়েছ। সারা দিন মা, ঠাকুমার কোলে আদর খেয়েছি, সময়ে অসময়ে বাবাকে দেখেছি আর নিয়ম করে প্রতিদিন অফিস ফেরৎ আঙ্কেলকে পেয়েছি। ঘরে ঢুকেই আঙ্কেলের -" হ্যালো, বিগ বস---" শোনার জন্যে কান পেতে রয়েছি। তারপর কত খেলা, কত মজার মধ্যে যে সময়টা কেটে যেত। ফিরে যাওয়ার সময় টা-টা শুনলেই মুখটা ভার হয়ে যেত। আবার পরের দিনের অপেক্ষায়।
তাই বলে, বাড়ীতে আমার, ভালবাসার কোন কমতি ছিল যে তা কিন্তু নয়। এক কথায় মা, বাবা, ঠাকুমা সকলেরই আমি চোখের মনি। আমাকে ছাড়া কারুর কোন চিন্তাই নেই। ঘরে-বাইরে আমার ইচ্ছাকে সকলে সব সময় এত বেশী গুরুত্ব দিয়েছে যে, আমি নিজেকে বেশ একটা দামী মানুষ হিসেবেই ভাবতে শিখেছি।
বাবা ডাকে আকাশ,-,
- মা ডাকে নীল,-
- ঠাকুমা ডাকে মেঘনাদ। সকলেই যেন সেই মহাশূণ্যের মাঝেই পূর্ণতা খুঁজে নেয়। অবশ্য এরও একটা কারণ আছে।-----------
( ছয় )
আমার বাবা ছিলেন পাইলট। তাই বহু দিন পর্যন্ত, মায়ের শরীরে আমি, নীরবে - নিভৃতে, আড়ালে - আনন্দে, চেতনে - স্পন্দনে আকাশে দুলেছি। তাই আমিই নীল ----- আমিই আকাশ ----- আমিই মেঘনাদ।
আমার বয়স যখন সাত বছর কয়েক মাস, এক প্লেন ক্র্যাশে আমার বাবা মারা যান। বয়স কম হলেও আমার কিন্তু এখনও সব কেমন পরিষ্কার মনে আছে। এত অল্প বয়সে বাবাকে, হারিয়ে আমি যেন কদিনেই অনেক বড় হয়ে গেলাম। আমার মনে পড়ে না, কোন দিন মা-ঠাকুমাকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করে বিরক্তি করেছি বলে।
বাবা যেদিনই অন্য কোথাও ফ্লাইট নিয়ে গিয়ে আটকে পড়তেন, সেদিন ওখানেই থেকে যেতেন। যত রাত্তিরই হোক, বাবা আমাকে একবার ফোনে না ডেকে ঘুমোতেন না। সেদিনও যখন বাড়ীর সকলে এদিক-ওদিক ছিল, আমি কিন্তু বাবার ডাকার অপেক্ষায় ফোনের পাশটিতেই বসে খেলা করছিলুম। হঠাৎ ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠতেই আমি লাফিয়ে গিয়ে ধরি -------------
-------------কে যেন অত্যন্ত গুরু-গম্ভীর গলায়, মিসেস বর্মনের খোঁজ করেন। মা পাশেই ছিলেন, হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে কথা শুনতে শুনতে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়েন। ঠাকুমা কিছুই বুঝতে না পেরে, ফোনটা তুলে নিয়েই এক ভয়ণ্কর আর্তনাদ করে ওঠেন।
( সাত )
ক্রমশ বাড়ী ভর্তি হয়ে যায় লোকে। আলমারির কোনটিতে চুপটি করে বসে আমি শুধু চেয়ে থাকি। সবাই ফিস ফিস করে কি সব আলোচনা করে আর আমার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকায়। সে যে কি ভয়াবহ দিন আমি কাটিয়েছি, তা কেউ জানে না। ----- এরকমই এক সুন্দর, সুখের, আনন্দের ও ভালবাসার সংসার ছেড়ে বাবা আমার চলে গেল।
পর দিন সকাল থেকেই আমার ধূম জ্বর। একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বেশ কিছুদিন পর সুস্থ হই। মুখ বুজে এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াই। মা দেখি সব সময় কেমন আচ্ছন্ন হয়েই পড়ে থাকে। ঠাকুমা মাথাই তুলতে পারেনা। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীতে ঠাসা বাড়ী। কোথাও একটু একা থাকতে পারিনা। সকলের ওই মায়ামাখান দৃষ্টি দেখে আরও বিরক্তি লাগে। সেই সময়, বাবা ও মার সব চাইতে প্রিয় বন্ধু আঙ্কেল, আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে, তার বাড়ীতে নিয়ে যান। দুদিন পরই বাড়ী ফিরে আসি। মা, ঠাকুমা চুপচাপ যে যার ঘরে। আমি আমার মত। একা একা ঘুরি ফিরি আর কখনও মা, কখনও ঠাকুমার পাশটিতে গিয়ে শুয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে সকলেই ঝেড়ে উঠতে চেষ্টা করে। আমাকে নিয়ে দুজনেই খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আমাকে খাওয়ান, চান করান, পড়ান এসবই তাদের একটু একটু করে থিতু হতে সাহায্য করে। আঙ্কেল আগের মতই প্রতিদিন বিকেলে আসে। কিছুক্ষন থাকে, সব খবরা খবর নেয় তারপর আমায় পড়তে বলে চলে যায়।
অন ডিউটি বাবা, মারা যাওয়ায়, মায়ের কাজের ব্যাপারেও অনেক অফার আসে। শুনেছি আমার মা নাকি আগে এয়ার-হোস্টেসের পদে চাকুরী করতেন। ফলে তারা মাকে আবার সেই পদেই যোগ দিতে বলেন। মার পক্ষে তা সম্ভব হয়না। মা বলেন, ------ এই আকাশের প্রতিটা বিন্দুতে, প্রতিটা কোনে আমাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দীর্ঘ দিন আমরা দুজনে এই শূন্যে ভেসে বেড়িয়েছি। আজ যে আমার পাখনা ভেঙ্গে গেছে, আমি আর কোনদিন উড়তে পারবনা। কাজ আমায় করতেই হবে। আপনারা আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী, যেকোন কাজ দিন আমি তাতেই রাজী।-----------
সেই থেকেই মা, এই স্কুলের শিক্ষিকা পদে যোগ দিলেন। আমি আর মা একই সাথে স্কুলে যাই, বাড়ী ফিরি। কাজের মধ্যে থেকে মাও একটু স্বভাবিক হতে পরছে। ঠাকুমা, আগের চাইতে অনেক নরম হয়ে গেছে। এক মূহূর্তও আমাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। ------ আঙ্কেলের কর্তব্যে কোন ত্রূটি নেই। মা, ঠাকুমাতো আঙ্কেলের সাথে পরামর্শ না করে কোন কাজই করতে পারে না।
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। আমি, ঠাকুমা, মা গরমের ছুটিতে বেশ কিছুদিন, পুরীতে কাটিয়ে এলাম। আমার ঠাকুমা কিছুদিন আগের মানুষ হলেও, প্রচন্ড প্র্যাক্টিক্যাল। একদিন মাকে ডেকে বললেন, ----- "বৌমা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ----- " মার পিছু পিছু আমিও ঠাকুমার পাশটিতে গিয়ে বসি। বেশ কিছুক্ষন সময় নিয়ে, মাথা নুইয়ে মাকে বলেন, ----- " বৌমা, খোকাকে ছেড়ে, আমরা কেমন একটা বছর কাটিয়ে দিলাম? একি কখনও ভাবতে পেরেছি? সবইতো মানুষকে সহ্য করতে হয়। সুখ যখন বইতে পারি, শোকও তেমন সইতে হয়। স্বামী শোক, সন্তান শোক, পিতৃশোক কোনটা, কোনটা কম বল? ------ নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস। এই একটা বছর আমি শুধু দাঁতে দাঁত এঁটে, বুকে পাথর চেপে বসে আছি। তোমার এই কচি বয়স, আমি চাই তুমি আবার বিয়ে কর। মেঘনাদের জন্য তুমি ভেবনা। আমার সবইতো ওর। তোমার যাকে পছন্দ, যেভাবে পছন্দ, আমি সবেই রাজী। আলাদা থাকতে চাও, একসাথে থাকতে চাও, তোমার যেমন ইচ্ছে আমায় জানাও। অল্প বয়স, এমন আগুনের মত রূপ নিয়ে সমাজ তোমায় ভদ্রভাবে বাঁচতে দেবেনা। মেঘনাদ এখনও ছোট আছে, ওর পক্ষেও এটা শুভই হবে। তোমার একটা ব্যাবস্থা না করা পর্যন্ত, আমি যে খোকার কাছেও যেতে পারব না বৌমা। জীবনের দীর্ঘপথ তোমায় এখনও চলতে হবে। -----"
বলেই ঠাকুমা কেমন অস্থির হয়ে পড়েন। বাবা চলে যাওয়ার পরও কোন দিন ঠাকুমাকে এমন প্রলাপ বকে আমি কাঁদতে শুনিনি। মাকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে চলে, ---- "তুমি আমায় ভুল বুঝোনা। আমি মা হয়ে, কি করে তোমার এই যন্ত্রণা সহ্য করি? তুমি যে আমার রাকা। আমার খোকার ছায়া। -----"
আমার যখন দশ বছর বয়স, তখন থেকে দেখলাম, আঙ্কেল আর আগের মত রোজ রোজ বাড়ী ফিরে যায়না। আমাদের সাথেই সব সময় থাকে। আমারতো খুবই মজা। আমার প্রিয়, সব চাইতে প্রিয়, আঙ্কেলকে সব সময় কাছে পাই। বাড়ী যেন আবার সেই আগের নিয়মে চলতে শুরু করে। ক্রমশ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে যাই।
এখনতো অনেকই বড় হয়েছি, সবই বুঝতে শিখেছি। সত্যিই আঙ্কেলকে কি কারুর সঙ্গে তুলনা করা চলে? একটি মানুষ, যে কিনা নিজেকে উজাড় করে তিন, তিনটে বুভুক্ষু হৃদয়ের ক্ষুধা মিটিয়েছে। এত বড় মহান ব্যক্তিত্বকে আমি অবহেলা করব কোন শক্তিতে?
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৪১