( এক )
আচ্ছা এটা ধাঁধার জন্য তৈরী হলে কেমন হয়? ভারী মজার জিনিস। দেখাও যায়না, ছোঁয়াও যায় না, অথচ আছে। একেবারে স্বাধীন সত্বায় সে আছে নির্ভীকভাবে । ঈশ্বরের মত তাকে অনুভব কর। বায়ুর মত তাকে উপভোগ কর। তবু চোখে ধরা দেবে না।
( দুই )
ক্ষমতালুপ্ত এই শরীরটা, যখনই বিশ্রাম চায়, সে এসে তার কাজ বুঝে নেয়। এ যেন একজন আর একজনের পরিপূরক। দুজনে একসাথে পরিশ্রম করতে চায় না। শরীরের সম্পূর্ণ বিশ্রামেই হয় তার প্রকৃত জাগরণ। চালসে চোখ, তাই আলসে হয়ে, পর্দা টেনে, মনকে কাজ বুঝিয়ে গুটিগুটি পাততাড়ি দেয়। উদ্দেশ্যহীন এই যাত্রাপথে, সামনে এগোতে তার বড় ভয়। তাই কেবলই পেছনে গড়িয়ে যায়। মনের অতলে তলিয়ে যাওয়া কত স্মৃতি, কুড়িয়ে আনে তার কুঠুরি থেকে। সেসব টের পাই, যখন শরীরটা তলিয়ে গিয়ে, আলগা এই মনটা, হালকা হয়ে ভেসে ওঠে। এ যেন নাম না জানা দুটি ফুল, শেষ ও শুরু দিয়ে যার জীবন পরিক্রমা। দিনান্তে দেখতে বড় ভাল লাগে। সবই কেমন সুন্দর, অভাবনীয় বলে মনে হয়। অথচ সেই সময় এগুলো ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক। তার বিশেষ কোন গুরুত্ব ছিল বলেতো মনে হয়না। -------------- আজ তার হাতছানিই বুঝিয়ে দেয়, তার গুরুত্ব ছিল কতখানি। ---
( তিন )
এ যে শুধুমাত্র দেখা নয়। এ যে ফিরে ফিরে দেখা। জীবনের সব দেখাই কি আর ফিরে দেখার মত হয়? সেরকমই কিছু যখন ফিরে দেখি, তখন সেটা একটা আলাদা মাত্রা পায়। মন তার অত্যন্ত দ্রুত গতিতে, বর্তমানকে ফিকে করে দিয়ে, কোথায় যে হারিয়ে যায় কেউ জানে না। তবে একটা যায়গায় গিয়ে, বোধহয় সকলেই একইভাবে ধরা পড়ে ------- নিজের ছেলে-বেলায়।
অনেক ভাই-বোন থাকলে, কতখানি অসুবিধে হয় জানিনা, তবে সুবিধে হয় অনেকখানি। সবচাইতে মস্ত সুবিধে হোল, সর্ব্বক্ষনের সঙ্গীর অভাব হয়না। আমরা নিজেরা পাঁচ ভাই-বোন ছিলাম। তাছাড়া তুতো ভাই-বোনের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিলনা। ফলে সর্বদা বাড়ীর ভেতর আনন্দে এমন মশগুল হয়ে থাকতাম যে বাইরের আকর্ষণ খুব কমই অনুভব করতাম। ---যদিও অত্যন্ত কঠোর নিয়ম, শৃঙ্খলা মধ্যেই আমাদের মানুষ হতে হয়েছে। তবুও এতজন ভাই-বোন মিলে সব সময় হৈ-চৈ আর খেলা-ধূলা নিয়েই মেতে ছিলাম। এক বিকেল ছাড়া আমাদের বন্ধু-বান্ধবের বিশেষ প্রয়োজনই হোত না। তাছাড়া ওইটুকু সময় ছাড়া আমাদের বাড়ীর বাইরে বেরোবার হুকুমও ছিলনা।
( চার )
সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুল যাওয়া, তারপর স্কুল থেকে ফিরেই শুরু হোত আমাদের শক্তির পরীক্ষা। মা একলা কিছুতেই আমাদের সামলাতে পারতেন না। যতক্ষন না বাবা বা কাকা কেউ বাড়ীতে ফিরতেন, ততক্ষন আমরা একরকম যুদ্ধই চালিয়ে যেতাম। বাবাকে দেখলেই সাথেসাথে ভাল মানুষটি সেজে, স্নান, খাওয়া সেরে যে যার নির্দ্দিষ্ট যায়গায় চলে যেতাম। সেখানেও কি শান্তি আছে আমাদের? চুপটি করে, ঘাপটি মেরে, দীনুর অপেক্ষায় মায়ের পাশটিতে শুয়ে থাকতাম।------------ আমাদের দীনু ছিল দেখতে অনেকটা ঠিক দৈত্যের মত। একমাথা কালো, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া, কোঁকড়া চুল। ছোট্ট একটা ধূতিকে ল্যাংগোটের মত করে পরত, ঠিক যেন বজরং-বলি হনুমান। সারা শরীর ছিল একেবারে তেল চকচকে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কখনও তার গায়ে জামা দেখিনি। মা, দীনুর জন্য চূড়ো করে এক থালা ভাত, সব রকম সব্জী , ডাল এক যায়গায় ঢাকা দিয়ে রেখে আসতে। কি এক বিশেষ কায়দায় দীনু যে বাইরে থেকেই দরজা খুলে ভেতরে আসত জানিনা। এসেই আগে খেতে বসত। যেই না দীনুর আওয়াজ শোনা অমনি চুপিচুপি, গুটিগুটি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়তাম। ওর খাওয়া দেখাও যেন আমাদের মস্ত এক কাজ। দীনু খুব কাঁচা লঙ্কা খেত। আমাদের সবার হাত থেকে লঙ্কা নিয়ে, বেশ মজা করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে দেখাত। আমরা চোখ গোল-গোল করে বলতাম,-------- তোমার ঝাল লাগছে না?------ ও মাথা নাড়তে নাড়তে হেসে একেবারে গড়িয়ে পড়ত আর বলত,---- নাঃ মিষ্টি অছি, মিষ্টি অছি।-------------
তারপর মূহূর্তের মধ্যেই এক কাঁড়ি বাসন মেজে, এক বালতি কাপড় কেচে, সব তারে মেলে, যাওয়ার সময় দুহাত ওপরে তুলে, -- ও মোর জগন্নাথ, ও মোর জগন্নাথ -- বলে গলা ছেড়ে গান করে, ধেই ধেই করে নাচ দেখিয়েই ছুট্টে পালিয়ে যেত। আমাদের উচ্ছাসের মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। ফলে মা, নিয়ে গিয়ে স্কুলের কাজ করাতে বসাতেন।
( পাঁচ )
যেই না বিকেল হওয়া , অমনি খেলার মাঠে দে ছুট, ছুট। আবার সন্ধ্যে হতে না হতেই বাড়ীতে এসে হাত-মুখ ধুয়ে, কিছু খেয়ে, বাবা ফেরার আগেই পড়তে বসা চাই-ই। সে পড়ার পদ্ধতিও ছিল এক অভিনব। সবার মধ্যিখানে একটা লণ্ঠন জ্বেলে, আমরা পাঁচজন গোল হয়ে বসতাম। পড়ার মূল বিষয় বস্তু ছিল কে কত চীৎকার করে পড়তে পারে। কার মাথায় কতটা ঢুকল বা কে কতটা বুঝল সেসব দেখার প্রয়োজন নেই। পরিত্রাহি চীৎকার দিয়ে আমরা পড়া মুখস্ত করতাম। আমাদের চিল চীৎকারে, আশে পাশে কেউ কারুর কথা পর্যন্ত শুনতে পেত না। আমার মনে হয়, সেই বয়সে আমাদের কেন পড়তে হয়, এর প্রতিবাদ স্বরূপই বোধহয় আমরা ওরকম চেঁচাতাম। যাতে আমাদের আর কোনদিন কেউ পড়তে না বলে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এমনই যে এই কথাটি কেউ কোনদিন মুখেও আনেনি। কেবল মাত্র মা, মাঝে মাঝে এসে বলতেন,----- "অত চেঁচাচ্ছ কেন? একটু আস্তে পড়না।---------"
( ছয় )
আবার এই পড়া চলা-কালীনই নিজেদের মধ্যে চলত হাতাহাতি। এ ওকে চিমটি কাটছে, কে কার বই বন্ধ করে দিচ্ছে, কেউ হয়ত লণ্ঠনে ছেঁকা দিয়ে দিচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন কলা-কৌশল চালিয়ে, পড়তে পড়তে একেবারে ক্লান্ত হয়ে, একসময় আমাদের খাবারের ডাক পড়ত। প্রতিদিন যথারীতি সেই একই নিয়মে, এ ওকে টপকে, ল্যাং মেরে, চুল টেনে সবাই সব্বার আগে গিয়ে খেতে বসতাম। সেখানে কিন্তু আর কোনরকম বিশৃঙ্খলা চলত না। কারণ প্রচন্ড বদ-মেজাজী আমাদের বড় কাকা, শুধু আমাদের মারের অপেক্ষায় বিশাল এক ছড়ি নিয়ে সেখানে বিরাজ করতেন।
সুতরাং সুবোধ বালক বালিকার ন্যায়, খাওয়ার পর্ব্ব সমাধান করে, যে যার যায়গায় গিয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়তাম। এই রুটিনের বাইরে এক পাও চলেছি বলেতো মনে পড়ে না।
( সাত )
-------- একমাত্র আমাদের সেই ফুলু-মামা ছাড়া। সে যে কি মজা, কি মজা তা আর কি বলব? সেই ছোট্ট বেলায়, ফুলুমামা ছিলেন আমাদের সব বাচ্চাদেরই একজন বয়স্ক পরম বন্ধু। ওরকম আমুদে, মজাদার মানুষ আমি আজও চোখে দেখিনি-------- আমাদের ফুলুমামার একটা মস্ত নেশা ছিল ফটো তোলা। কবে, কোন ছোট বেলায়, একবার নাকি পঞ্চাশ পয়সার লটারির টিকিট কেটে, একটা ক্যামেরা প্রাইজ পেয়েছিলেন। সেই থেকেই ওনার নেশা হয়ে যায় ফটো তোলা। তবে ওনার ফটো তোলারও একটা বিশেষত্ব ছিল। উনি ছবি তুলতেন শুধুই বাচ্চাদের। পাড়ায়তো এন্ডি-গেন্ডি প্রচুর বাচ্চা ছিল, কেবলমাত্র তাদের। সেটাও আবার সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে নয়।
এই যেমন, কারুর দুধের দাঁত পড়ে ফোকলা হয়ে গেল, সেই ফোকলা মুখে হেসে ফটো তুলতে হবে। ---- আবার কারুর মাথা নেড়া হোল, সেই তেল চকচকে মাথায় ভেল না বেঁধে ছবি তুলতে হবে। এছাড়াও আরও কত ভঙ্গিমা যে ছিল, সুন্দর চোখকে ট্যারা করে, মা কালীর মত জিব বার করে, দুহাতে লম্বা করে দুকান ধরে,------ এরকম বিভিন্ন সব কায়দা আমাদের ছবি তোলার জন্য বরাদ্দ ছিল। একবারতো আমার ছোট ভাই এর হাত ভেঙ্গে গেল, হাত প্লাস্টার করা হোল, ফুলুমামা সাত তাড়াতাড়ি সেই ছবি ধরে রাখলেন। আর দোলের দিনের সেই রং মাখা মুখতো তোলা চাই-ই। সত্যি বলতে কি এরজন্যে আমাদের কোন দুঃখও ছিলনা। বরং এজন্য আমরা খুবই উৎসুক ছিলাম। ফুলুমামাকে দেখলেই ছবি তোলার জন্যে ঝুলে পড়তাম। কারণ সেই বয়সে একমাত্র ফুলুমামা ছাড়া আর কেই বা আমাদের ছবি তুলেছে? ছবি তৈরী হয়ে এলে, সবার বাড়ী গিয়ে গিয়ে, ছবি দেখিয়ে আর এক প্রস্ত হাসি। ----------- সে এক নির্ভেজাল আনন্দের দিন গেছে।
( আট )
একমাত্র বড়দা, আমাদের চাইতে একটু বড় হওয়ায়, ওর কোন ছবি তোলা হয়নি। সেজন্য ওর একটা মস্ত কাজ ছিল, এসব আ্যলবামে ভাল করে গুছিয়ে রাখা আর লোক সমাগমে সেসব প্রকাশ করে, হাসির যোগান দেওয়া। তবে এজন্যও কোনদিন রাগ বা দুঃখ কিছুই হয়নি।------ তবে সত্যি সত্যি-ই একদিন খুব লজ্জা হয়েছিল। যখন বড়দা, আমার সদ্য সদ্য বিয়ের পর, আমার ছোট দেওর আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এলে, তাকে সেই আ্যলবামটা দেখিয়েছিল।
আমি কিছুই জানিনা, হঠাৎ আমার দেওর বলে, -" বৌদি, শোন শোন।-" আমি ওর কাছে এগিয়ে যাই, ও আমার চুলটা টেনে বলে, -" দেখিতো সত্যি কিনা? -" আমি বলি, ---------- সে কি কেন?-"
-"নাঃ, বিয়ের আগেতো দেখছি, শুধুই নেড়া মাথা। তাই ভাবলাম অত বড় চুল আবার কবে গজাল?- " বলেই দুজনে হাসতে হাসতে আমার সামনে আ্যলবামটা খুলে ধরে । সেই একদিন, শুধু সেই একদিনই মনে হয়েছিল, কেন যে মরতে ফুলুমামা এই ক্যামেরাটা প্রাইজ পেয়েছিল?
আজ কিন্তু মনে হয় , ভাগ্যিস পেয়েছিল, তাইনা নিজেকে আবার ফিরে পেলাম।-------------
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:২৯