( এক )
আগে বা পরে কোনরকম ভূমিকা না করেই, রান্না ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কথাটা বলে যায়,
---- মা, শোনতো তোমার সাথে কিছু কথা আছে-- আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে,----- নাও, কি বলবে বল, ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছ।------
----- থাকুক কাজ, এতক্ষন পলা সামনে থাকাতে আমি চুপ করে ছিলাম। আচ্ছা মা, তুমি অনুর সাথে ওরকম ব্যাবহার করলে কি করে বলতো? তুমি ভুলে যেও না, ওকে কিন্তু আমরাই দেখে-শুনে বিয়ে দিয়েছি। ও নিজে দেখে বিয়ে করেনি।------
----তা সেটাও কি আমাদের অপরাধ? কেউ কি মানুষ খেয়ে দেখে নাকি? তা , ও, এতদিনেও মানুষটাকে একটু পাল্টাতে পারল না? এ কিরকম মেয়ে? আরও কিনা ভয়ে একেবারে গুটিয়ে থাকে।----------
----সবাই সব পারেনা মা, সবাই সব পারেনা। আর অনুতো জানই বরাবরই একটু ভীতু স্বভাবের। একটু বেশী ভাল মেয়ে। তুমি মা হয়েও সেটা বোঝ না?------
----বুঝি, বুঝি, সবই বুঝি। তোমার বোন তুমি সহ্য করবে, পলা কেন সহ্য করবে? ভবিষ্যতে এজন্য ও যে আমায় কথা শোনাবে না, তার কোন গ্যারান্টি আছে?------
---- নাঃ, পলা ওরকম মেয়েই নয়। ও অনুকে যথেষ্ট ভালবাসে। আর বিজনতো সত্যি-ই ভাল ছেলে মা? এই একটা ছাড়া ওর আর কি দোষ আছে বলতো?---------
----- তা সেই একটাইতো হয়েছে কাল। যার জন্য নিজের বাবা-মা পর্যন্ত ঘরে স্থান দিল না। তাকে অন্যে সহ্য করবে এটা তুমি আশা কর কি করে?------
---- যাক, যাক এ ব্যাপারে তোমাকে আর আমার কিছু বলার নেই। তবে আমার মনে হয় না, অনু আর এখানে আসবে বলে।-----------
----- না আসবে, না আসুক। যমের হাতেও যা, পরের ঘরেও তা।---- বলেই চোখে আঁচল চেপে চলে যান।
( দুই )
প্রথম যেদিন শ্বশুর মশাই ডেকে বললেন,-----বৌমা, বিজনকে একটু বুঝিয়ে বোল, এত রাত করে বাড়ী না ফিরতে। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এতজনের সংসার, বুঝতেই তো পারছ কখন , কে, কিভাবে নেয়। তুমিতো সবই বোঝ মা।----------
ওনার যুক্তি পূর্ণ কথায়, এতটাই মমত্ব বোধ ছিল যে, আমার সত্যিই খারাপ লাগেনি। কিন্তু যেদিন নিতু , গোরা ওর ছোট দুই ভাইও আমায় বলল যে,-------- কি বৌদি, দাদা কি এটাকে শুঁড়িখানা ভেবেছে নাকি? এভাবেতো এখানে থাকা চলবে না। মানে মানে ঝামেলা বাধাবার আগেই কেটে পড়তে বল।-----------
সেদিনই বুঝলাম, আমার এখানকার মেয়াদও ফুরিয়েছে। অথচ যার জন্যে এত সমস্যা, সে কোনদিন এসব ভ্রূক্ষেপই করলনা। আরও ভয়ঙ্কর হোল সেদিন, যেদিন ওই টুকু বাচ্চা ছেলে গুড্ডু পর্যন্ত ঘরে এসে, সেতুকে ওর জেঠু রাত্তিরে কিভাবে বাড়ী ফেরে সেটা দেখাল। এরপর সত্যিই আর ওখানে থাকা যায়না। এভাবে তো আমি ওদের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারিনা? সেই শুরু হোল আমার বাড়ী খোঁজা।
( তিন )
অতবড় সংসার, এতজন ভাই-বোনের মাঝ থেকে একা হয়ে এসে সেতুটা কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেল। অকারণে আজকাল খুব বায়না করে। আসলে বাচ্চা মানুষতো, সকলকে যেমন দেখে, তেমনই থাকতে চায়। ওতো এখনও বোঝে না আমাদের যে সব মানায় না।
----মা জান, আমার বন্ধুরা না সবাই কি সুন্দর মামার বাড়ীর গল্প করে। আমি তখন চুপ করে থাকি । তুমিতো আর মামার বাড়ী যেতেই চাওনা। রিয়ারতো অনেক পুতুল আছে, ও বলেছিল আমায় দুটো পুতুল দেবে। ------- দাদু, ঠাকুরমার কাছেওতো যাওনা। কতদিন গুড্ডুটাকে দেখিনা। পিয়ার সাথেও খেলতে পারিনা। এবার পূজোর ছুটিতে যাবে মা, মামার বাড়ী?--------
---নাঃ, কেন, কি দরকার? আর তাছাড়া আমরা চলে গেলে বাবা কার কাছে থাকবে? বাবার বুঝি একা একা কষ্ট হয়না?---------------
----তা কেন? একা থাকবে কেন? বাবাওতো যাবে আমাদের সাথে।-----------
--- বাবার যে ছুটি নেই, বাবা কি করে যাবে?--------
কিছুক্ষন গুম মেরে চেয়ে থাকে। তারপর দুপ-দুপ করে যেতে যেতে বলে শুনি,
----শুধু বলে ছুটি নেই, ছুটি নেই। আমি জানি, জানিতো, বাবা কেন যাবে না?------------- ভয়ে ভেতরটা এতটুকু হয়ে যায়। সেতু এসব কি বলছে? ওকি তবে সব বোঝে? সব জানে? ভাল, বুঝুক, বুঝুক। এসব যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততই ওর মঙ্গল। আর বুঝবে নাই বা কেন? শ্বশুর বাড়ীর পাঠতো সেই কবেই চুকিয়ে এসেছি, এবার বাপের বাড়ীও উঠে গেল।
( চার )
মাঝরাত অবধি অপেক্ষা করেও যখন মানুষটা বাড়ী এলনা, তখন আর কারুর বাড়ী গিয়ে খোঁজ করারও সময় ছিল না। প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত, মা-মেয়ে দুজনে জানালার পর্দ্দা তুলে চেয়ে রইলাম। নিঝুম, নিস্তব্ধ রাত্রি। একে পৌষ মাস, তার ওপর ঘন , কাল অমাবস্যা। রাস্তা জন-মনিষ্যি শুন্য। কোথায় যাব, তাকে খুঁজতে? ঠিকানা বিহীন একটি মানুষ। মা-মেয়ের মুখে আর কথা সরে না। শুধু আকাশ পাতাল ভেবে চলে। ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়ে। শরীর এলিয়ে পড়ে। কোন দিনতো এমন হয়না। রাত করেই ফেরে। টলতে টলতেই ফেরে। তবুও ফেরে। আজ তবে কি হোল? ও কেন এলনা? তবে কি মানুষটা একেবারে হারিয়েই গেল?
কাক ডাকারও আগে, সূর্য্য ওঠারও আগে, কাল একটা শাল গায়ে জড়িয়ে, ঘন কুয়াশার ভেতর হাতড়ে হাতড়ে বেরিয়ে পড়ে অনু। পাড়ারই নেতা গোছের ছেলে গৌরবকে গিয়ে খবরটা জানিয়ে আসে। একটু ভোর হতেই হাসপাতাল থেকে একজন লোক এসে খবরটা দিয়ে যায়। মনে মনে যা আশঙ্কা করেছিল ঠিক তাই। বেসামাল অবস্থায় রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ীর ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যায়। পাশেই আর,জি কর এ নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ। এমন একজন রাস্তায় পড়ে থাকা লোকের জন্য কে-ই-বা রাত বিরেতে ছোটাছুটি করে খবর দেবে? হয়ত রাস্তাতেই বহুক্ষন পড়েছিল, নাকি হাসপাতালের মাটিতেই ফেলে রেখেছিল? কে জানে? কোন প্রমানতো নেই।
দিনের পর দিন অত্যাচারে শরীরটাতো এমনিতেই ঝাঝরা হয়ে গেছিল, তাই সামান্য একটু ধাক্কাতেই নিমেষে বেলুনের মত চুপসে গেল। এরকম যে একদিন হবে তাতো জানাই ছিল ------- কিন্তু সে দিনটি যে একদিন একদিন করে এত কাছে চলে এসেছে তাতো জানা ছিলনা। মা-মেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। পরিজন বা প্রিয়জন কবেই বা ছিল? আজও পাড়ার ছেলেরাই ভরসা। তাদের ওপরই সব ছেড়ে শোকে, দুঃখে, লজ্জায় শুধু শেষ টুকুর অপেক্ষা।
( পাঁচ )
গৌরবের ব্যাস্থামত, পাড়ার ছেলেরাই ম্যাটাডোরে করে দেহ নিয়ে এল। লম্বা টানা বারান্দায়, যত্ন করে শুইয়ে, মাথা পর্যন্ত সাদা চাদরটা টেনে দিল------ দুদিকে, দু-দরজা ফাঁক করে, পর্দাটাকে যতটা সম্ভব আঁকড়ে ধরে মা-মেয়ে দুজনে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল। পাশেই দাঁড়ান ছেলের দলের থেকে একজন এসে, আস্তে করে মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিল।
--স্ত্রী-কন্যা, কেউই ঝাঁপিয়ে পড়লনা বা চেঁচিয়ে বিলাপ করল না। মুখ বুজে, সমস্ত কষ্ট বুকে চেপে শুধু চেয়ে রইল মুখপানে।------- শোকের যে কোন ব্যাখ্যা হয়না। বিশেষ করে সেই শোক যদি হয় কোন লজ্জার উৎস। তখন মানুষ নিজেই নিজকে সংযত করে। লজ্জা! বড় লজ্জা! একজন ভদ্রলোক যখন মাতাল, বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় পড়ে শেষ বিদায় নেয়, তখন তার নিকট জনেরা বোধহয় শেষ শোকটুকু জানাবার অধিকারও এমনি করেই হারিয়ে ফেলে। তবুও চোখের ধারা বাঁধ মানেনা। অঝোর ধারায় বুক ভেসে যায়। দু-একজন প্রতিবেশিনী এসে পাশে দাঁড়ায়। কোন সান্ত্বনা বা দুঃখ প্রকাশ কিছুরই প্রয়োজন হয়না।-------- নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে বাবার মুখটির দিকে। স্ত্রীর অবনত দৃষ্টি ঘিরে রাখে স্বামীর নিথর দেহটিকে।
দুটো বড় নীল রঙের মাছি বারবার উড়ে-উড়ে এসে বসে, বাবার মুখের ওপর। সেতুর মনে হয়, মাছি দুটো যেন সে আর তার মা। তাদের হয়ে বারবার গিয়ে বাবাকে আদর জানিয়ে আসে। নিস্তব্ধ পরিবেশ। সময় এগিয়ে যায়, চারপাশ ভীড় হয়ে যায়। যে, যার মত আসে যায়। এতগুলো স্থির দৃষ্টির সামনে নিজেকে কেমন বিহ্বল লাগে। একপা, দুপা করে নিজেই এগিয়ে যায়, পাশটিতে গিয়ে বসে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে অতি যত্নে মুখটা ভাল করে মুছিয়ে, চোখের পাতা দুটো নাবিয়ে দেয়। কানের কাছে মুখটি নাবিয়ে কি যেন বলে। হয়ত কিছু বলার ছিল, এতদিনেও যা বলা হয়নি। তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে উঠে দাঁড়ায়। পাশেই দাঁড়ান মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। বুকে করে ঘরে নিয়ে যায়। ----------- চিরস্থির, চিরনিদ্রা। একটি মৃত্যু নিমেষেই কত দূরে সরিয়ে দেয় আপনজনকে।
( ছয় )
বিশাল পরিবার থেকে ছিন্ন হয়ে আসা তিন জনের সংসার। ছোট হতে হতে আরও ছোট হয়ে গেল। যার জন্য সকলকে ছেড়ে, সবার থেকে আলাদা হয়ে, সংসার সমুদ্রে একটি দ্বীপ তৈরী করলাম, সেই আজ সবার আগে সকলকে ছেড়ে চলে গেল। ------ দিনগুলো মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। কারণ দিনের বেলা ওর মত ভালো মানুষ আর কজনাই বা হয়। ওর যত হুজ্জোত-তো ছিল রাতের বেলা। রাতের এই হুজ্জোতের জন্যইতো বাবা-মা, ভাই-বোন সকলে দূরে সরিয়ে দিল। পারিনি শুধু আমিই।------ এত দিনের সঙ্গী, কত স্মৃতি, কত কথা, কতনা খেয়ালীপানা সব, সব নষ্ট করে দিল এই এক বদ নেশা। অনেক, অনেক চেষ্টা করেছি কিছুতেই ছাড়াতে পারিনি। এ যেন ওর একেবারে রক্তে মিশে গেছিল। আপাদ-মস্তক ভালো মানুষ। অথচ দিন শেষে সেই একই ছবি। কোন রকম অস্বাভাবিক আচরণ বা খেউর খিস্তি কিছু ছিল না। কেবল একই নিয়মে আধবোজা চোখ দুটো লাল করে, ভারী ভারী পায়ে রিকশাওয়ালা গেট পর্যন্ত ধরে ধরে দিয়ে যেত। বাকিটুকু আগে আমিই ধরে নিয়ে যেতাম। শেষের দিকে আমি আর বইতে পারতাম না, তাই সেতুই ঘরে দিয়ে যেত।
( সাত )
সূর্যের আলোর ছটায় যে দিন আমাদের শুরু হোত, সূর্য ডোবার সাথে সাথে সেই একই দিন কেন, ঘরময় এমন বিষাদ ছড়িয়ে দিত? মাঝে মাঝে মাত্রার বাইরে গেলেই যত গন্ডগোল বাধত। ভেউ ভেউ করে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিত। প্রায় প্রতি রাত্রেই বাবা, একবার করে প্রতিজ্ঞা করত, কাল থেকে আর এ জিনিষ ছোঁবেই না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাবার সেই কাল-দিনটি আমাদের আর দেখা হোল না। তবে এটা ছাড়তে না পারার জন্য যে বাবার ভেতরে খুব দুঃখ ছিল সেটা বুঝতে পারতাম। কারণ একটা কথা বাবাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, ------ বুঝলে অনু, এই তুমি, তুমিই আমার এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। আচ্ছা, দিনের পর দিন, তুমি আমায় কি করে সহ্য কর বলতো? তোমার মত এমন একজন সুন্দরী, গুনী মহিলার জীবনে কত পাওয়ার ছিল। কি? কি পেলে তুমি আমার কাছে?------- --- বুঝেছি, বুঝেছি এখন চল, চলতো।--------
---- না,না সত্যি বলছি। এই তোমায় ছুঁয়ে বলছি। তুমি ভাবছ আমার নেশা হয়েছে? বল, বল ঠিক কিনা? যে সময় কাছের মানুষটি আরও কাছের, ঠিক সেই সময়েই আমরা সব চাইতে দূরের। কেন? কেন অনু এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেললে বলতো?--------------
----- কে বলল দূরের? এইতো আমি তোমার পাশেই রয়েছি।----
---সত্যি, অনু, তুমি মহীয়সী। তোমার তুলনা শুধু তুমিই।----
এরকম কত দিনের কত কথাইতো মনে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কিন্তু সেই মানুষটিই নিপাট ভাল মানুষ। তার মত ভাল মানুষ একটি বই দুটি হয়না। কারুর সাথে কোন রকম বিবাদ নেই, মন কষাকষি নেই। দিব্যি সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে. সকাল নটার ভেতর বাবা প্রায় সংসারের বেশিরভাগ কাজই সেরে ফেলতেন।
সবার আগে ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে, বাজার করা, দুধ আনা, তাড়াতাড়ি মায়ের হাতে হাতে একটু সাহায্য করা, চটপট এঘর ওঘর একটু পরিপাটি করে দেওয়া, মানে মায়ের জন্য একমাত্র রান্না ছাড়া আর বাকি কিছুই থাকত না। ওঃ সব চাইতে বড় কাজ ঠাকুর দেওয়া সেটাতো বাবার দেওয়া চাই-ই। তরপর বাপ-মেয়ে এক রিকশায় চেপে বেরিয়ে পড়তাম।
আমাকে স্কুলে নাবিয়ে, বাবা চলে যেতেন স্টেশনের দিকে এই ছিল আমাদের নিত্য দিনের রুটিন----- কোথায় অশান্তি? বিন্দুমাত্র দুঃখওতো কোথাও দেখিনা। তবুও কেন যে এমন হয়? কেন যে হয় তাই-ই তো বোঝা গেলনা। যতক্ষন বাবা বাড়ীতে থাকত, হাসি-কথা-গান দিয়ে একাই সকলকে মাতিয়ে রাখত। ছুটির দিন-গুলো ছিল আরও আনন্দের অথচ সূর্য ডোবার সাথে সাথেই সেই একই মানুষ কেন যে এত পাল্টে যেত? আমার ভালো লাগেনা, ভালো লাগেনা। আমার বড় কষ্ট হয়। আমার বাবার জন্য কষ্ট হয়, মায়ের জন্য কষ্ট হয়।-------- মাকে ওপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যেতনা। কিন্তু ভেতরটা মায়ের একদম ক্ষয়ে গেছিল। কত রাত্তির যে মা আমার পাশে শুয়ে জেগে কাটিয়েছে সে কেবল আমিই জানি। ভেতরের এতবড় চাপা দুঃখ, কখনও কারুককে বুঝতে দেননি। যার জন্য মা, শ্বশুর বাড়ী, বাপের বাড়ী সকলকে ত্যাগ করেছেন। এমনকি পাড়া প্রতিবেশীদের থেকেও নিজেকে এক ঘরে করে রেখেছেন। তবুও কারুর বিরুদ্ধে মুখ ফুটে কোনদিন দুঃখ করতে শুনিনি। সবই কেমন ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে, নিশ্চিন্ত হয়েছিল। বরং বাবা মাঝেমাঝে এই নিয়ে দুঃখ করলে, মা কেমন সব হেসেই উড়িয়ে দিত। ----------------- সেদিনের কথা-গুলোতো যেন আজও আমার কানে বাজে। ইদানিং বাবার শরীরটা একটু খারাপই যাচ্ছিল। তাই বোধহয় ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ও উঁকি দিচ্ছিল। ছুটির দিন আমি খেয়ে উঠে গেছি। মা-বাবা তখনও ওঠেনি, গল্প করতে করতে খাচ্ছে। বাবা বেশ মন থেকেই মাকে বলে শুনি, ---------- দেখ অনু, আমি যখন থাকব না, তোমরা আমার কোন অভাবই বোধ করবে না, বল? হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, তাই না? সারাটা জীবন তোমাদের কত কষ্টই না দিলাম।---------- অন্তরে মা আসলে খুব রসিক ছিল। মাও হাসতে হাসতে বলে শুনি, -"নাঃ, ঠিক হোলনা।-"
-"কেন? কি ঠিক হোলনা? একটার অভাব হবে। -------"
-"কি? কি বলতো?-"
-"কে? কে তাহলে প্রতি রাতে ঢুলতে ঢুলতে আমায় জড়িয়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করবে বল?-" বাবা-মায়ের দম ফাটা হাসিতে আমি ছুটে যাই। বাবা বলে, -"দেখলি সেতু , দেখলি, তোর মায়ের কথা শুনলি? এই মহিলাই, এই মহিলাই আমায় নেশাটা ছাড়তে দিলনা বুঝলি?----------" আমি একটু গম্ভীর হয়ে বলি, -" এত করে বোঝেচ্ছ, তবুও বুঝব না?-"
-"নাঃ দেখিস, কাল থেকে আমি আর এ জিনিস ছোঁবই না।-"
-"কাল কেন? আজ কি দোষ করল বাবা?-"------ মা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে বলে, -" কাল বোধহয় দিন-টিন ভালো আছে নাগো?-"-------------- বলে বাবার দিকে তাকায়। বাবা কেমন করুণ ভাবে আমাদের দিকে চেয়ে থাকে । আজও চোখ বুজলেই আমি যেন বাবার সেই চোখ দুটো দেখতে পাই।
( আট )
জানি না, আমি জানিনা, কবে থেকে বাবা এর শিকার হয়েছিল? যার জন্য বাবা প্রাণ দিয়ে গেল, তবুও নেশা ছাড়তে পারল না। মা, এমনিতেই মিতভাষী। পরিস্থিতি, পরিবেশ হয়ত তার বাকিটুকুও কেড়ে নিয়েছিল। জ্ঞান হওয়া অবধি বাবার অপেক্ষায় থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছি। মা-ও তাই-ই চাইত। তাই সকালে উঠতে হবে বলে, তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দিত। বড় হওয়ার সাথে সাথে আর কোন প্রশ্নেরই প্রয়োজন হয়নি। ইচ্ছে করেই নিজেকে আড়াল করেছি। আর এখনতো অনেকই বড়, সবই বুঝি ---------- কি গভীর, আন্তরিক ভালবাসা দিয়ে যে বাবা মাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাই-ই ভাবি। আমার বাবার হয়ত অনেক কিছুই ছিল না, তবে আমার বাবার মত এমন বুক ভরা ভালবাসা বোধহয় কারুর থাকে না। ইচ্ছে হয় চীৎকার করে বাবাকে ডাকি। বলি,-------" বাবা তুমি এসো, তুমি এসো। আবার এসো। সুস্থ হয়ে এসো----" পারিনা, পারিনা, আমি পারিনা। গলা আটকে যায়। বড় ব্যথা। বড় ব্যথা।
( নয় )
---মা, তুমি দিয়ার বিয়েতে যাবেনা?---
এখনও তো বলেনি। ওই মানুষটার ভয়েইতো এতদিন কেউ, কাছেই আসেনি। সে ভয়তো এখন আর নেই। ভয় কাটলেই তবে না মানুষ কাছে আসে?----- যদি ডাকে যেতেই হবে। আমার দেওরের মেয়ের বিয়ে, ডাকলে যাবনা, সে কি হয়?---
--- জানিস দিয়াকে না তোর বাবা খুব ভালবাসত। দিয়াটাও ছিল ওর খুব ন্যাওটা। তোর মনে নেই? আমরা যখন এ বাড়ী চলে এলাম দিয়ার সে কি কান্না। কেঁদে কেঁদে মেয়ে একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অবশ্য তুইও তখন ছোট, তোর মনে না থাকারই কথা।-------
--- মা জান, আমার একটা কথা ভাবলে কেমন অবাক লাগে, ------- আর যে যাই ভাবুক, ঠাকুরমা-দাদুও কি করে পারল ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিতে?------
---- ওনাদের কি দোষ? ওনারা বৃদ্ধ মানুষ। সংসারে একসাথে থাকতে গেলে, সকলের সুবিধা অসুবিধাই-তো দেখতে হয়।------
---- তুমি কি বাবাকে প্রথম থেকেই এরকম দেখেছিলে?-----
----- নারে, মা, সেরকম কিছুতো মনে পড়ে না। নাকি সাদাসিধে মেয়ে আমি, হয়ত সেসব কিছু বুঝতেই পারিনি। আমাদের বাড়ীতেতো কখনও এসব দেখিনি। তবে, একটা জিনিস আমার খুবই অবাক করত।-------- কি?---------
----- তোর বাবার সাথেনা, ওর মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ কথা বলত না। এ রহস্য আমার অজানাই রয়ে গেল।--------
------ কেন? এ ব্যাপারে তুমি বাবাকে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করনি?----------
----- ও আর কি বলবে? ওরতো সেই একই কথা, আমি খারাপ তাই কথা বলেনা।------
( দশ )
সেতু, চলে গেল পড়াতে, কয়েকটা টিউশনি করে। না হলে চালাবই বা কি করে? অফিস থেকে থোক কিছু পাওয়া গেছে। তাই জমা রেখে, ইন্টারেস্টে কোন রকমে মা-মেয়ের চলে যায়। আমিও যে কিছু করতে পারিনা, তা নয়। কত কিছুইতো করার ছিল। কিন্তু কেমন যেন হাত-পা আর চলেনা। সেতুও চায়না আমি কিছু করি। মায়ের জন্য ওর বড় চিন্তা। আমি ছাড়া ওর আছেটাই বা কে? পড়া-শোনাতে ভাল ছিল। অনেক আশাও ছিল---------- কিছুই পূর্ণ হোলনা। এখন চাকরির চেষ্টা করছে। দেখি কি হয়। আর যাই হোক, মায়ের মত কপাল যেন না হয়
------- মায়েরাইতো ছিল মেয়ে, মেয়েরাইতো হয় মা। মায়েদের কন্যাকাল যদি সুস্থ ও সুন্দর হয়, তবে তাদের কন্যারা কখনই বৈষম্যের বলি হতে পারে না।-------------- বড় একা লাগে , সব কেমন ফাঁকা মনে হয়।
চারপাশের শূন্যতা যেন আমায় গ্রাস করে নিতে চায়। সবাই তোমায় ত্যাগ করলেও আমি কিন্তু তোমার পাশেই ছিলাম বিজন। তোমার ছায়ায় একটা সুখী ঘর বাঁধার বড় সাধ ছিল। সব ছেড়ে, সকলকে ছেড়ে, মাথা উঁচু করে শুধু তোমাকে, তোমাকে নিয়ে আমি বাঁচতে চেয়েছিলান। পারলাম না, আমি পারলাম না। আমি হেরে গেলাম বিজন, আমি হেরে গেলাম। -----------দুঃখ শুধু একটাই, আমি শুধু তোমার কাছেই হেরে গেলাম নয়, সবার চোখে অত্যন্ত ছোট হয়ে গেলাম। -----------তবুও বলি, এসো, আবার এসো।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১১ সকাল ১১:৪২