( এক )
---আচ্ছা আম্মা, তুমি সব সময় ওরকম সেলুন সেলুন বল কেন গো?----
---কেন? সেলুনকে সেলুন বলবনাতো কি বলব?------
---কেন? বিউটি-পার্লার বলতে পারনা?----
-------কাজতো সেই একই।---------
----আচ্ছা আম্মা, তুমি কখনও বিউটি-পার্লারে গিয়ে চুল ছেঁটেছ?-
----নাঃ, আমাদের ছোট বেলায় এসবের নামই শুনিনি। আর তাছাড়া প্রতি রোববার আমাদের বাড়ীতে নাপিত আসত। তাকে অবশ্য কেউ নাপিত বলতনা, বলত ঠাকুর এয়েছে। আমাদের পাড়ায় তার আবার খুব খাতির ছিল। ছেলে, বুড়ো, বাচ্চা সবাই তাকে ডাকত আনন্দদা বলে। বাড়ীর পুরুষ মানুষদের চুল দাড়ি কাটত, মাঝে মাঝে ঠাকুরমা আর বাচ্চাদের নখ কেটে দিত। মা ষষ্ঠীর কৃপায় সারা বাড়ীতে বাচ্চা-কাচ্চাতো নেহাৎ কম ছিলনা? আর আমাদেরতো বার মাসে তের পার্বনের মত ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩০০ দিনই মাথা নেড়া থাকত । আমার মা-বাবার মাথা মুড়ানোর ব্যাপারে প্রবল বিশ্বাস ছিল। বলতেন, ছেলেবেলায় যত বেশী মাথা কামান হবে, তত নাকি চুল ঘন আর কাল হবে। নেড়া হওয়ার পর আবার কবিরাজী ভৃঙ্গরাজ তেল ঘষেঘষে মাথায় মাখান হত। অবশ্য তার ফল যে কেমন, তাতো এই বয়সেও বুঝতে পারিস। তোদের মত এখনও একটা ক্যাপসুল দিয়ে মাথা ধুতে পারিনা।-------বাব্বাঃ, আম্মার চুলের জন্য কি গর্ব্ব, দেখ মা।------------
-----মনে আছে? তোর সেই মিষ্টি দিদার কথা, মনে আছে? আমি আর ওতো যমজ ছিলাম, তাই দুজনে খুব ভাবও ছিল। সব সময় দুজনে একসাথে স্কুল যাওয়া, খেলতে যাওয়া, এক মূহূর্তের জন্যও একজন আর একজনকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। প্রায় বারো-মাস আমাদের ওরকম তেল চকচকে মাথা দেখে, পাড়ার দুষ্টু ছেলেগুলো কি বিরক্তিটাই না করত। যেতে আসতেই, দেখ না দেখ মাথায় চাঁটি মেরে পালিয়ে যেত। কি আর করব? বাড়ী ফিরে মায়ের ওপর যত রাগ দেখাতাম। শেষ পর্যন্ত পাড়ায় আমাদের নামই হয়ে গেল ----ডুগি-তবলা--- । দূর থেকে আমাদের দুজনকে দেখলেই, ডুগি-তবলা, ডুগি-তবলা বলে গলা ছেড়ে গান জুড়ে দিত। তবে এই নাম করণের ফলে আমাদের একটা মস্ত উপকার হয়েছিল, এই যে, তারপর থেকে আমাদের আর কোনদিন সেই ঠাকুরের সামনে বসতে হয়নি।
( দুই )
আম্মার এসব ছোট বেলার গল্প শুনতে আমার খুব ভাল লাগে। আর আম্মা বলেও বেশ রসিয়ে রসিয়ে।
-----জানিস, সেদিন তোর ছোট-পিসি এসেছিল মিমিকে নিয়ে। এসেই বলে কি, -"মা, মিমির চুলটা একটু -"লি"- থেকে কাটিয়ে আসি।----- আমিও ওমনি ধমকিয়ে বলি, ----------------কি? ওই টুকু দুধের মেয়ের, পঁচিশ টাকা খরচা করে "লি" থেকে চুল না কাটালে কি হয়? তোমরা মায়েরাই হয়েছ যত্তসব বাজে জিনিস শেখাবার মাষ্টার। এরজন্য পরে পস্তাতে হবে জেনে রেখ। যাও, বাড়ীর পেছনে শরতের কাছ থেকে দু টাকা দিয়ে চুল কাটিয়ে এস।----------
তোর পিসিতো জানিসই এখনও আমায় কেমন ভয় পায়। তাই ইচ্ছে না থাকলেও শরতের কাছেই নিয়ে যায়। ওরে বাব্বা, ওইটুকু পুঁচকে মেয়ের সেকি দাপানো। বলে কিনা --------------তোমাদের এখানকার বিউটি-পার্লার বাজে। চেয়ারের হাতলের ওপর আবার একটা কাঠ পেতে বসতে হয়। একটাও আয়না নেই। বিচ্ছিরি দেখতে একটা লোক চুল ছাঁটে। আর কক্ষনো তোমাদের এখানে আসব না।-------
-----ঠিকইতো, তুমি কেন ওকে শরতের কাছে পাঠালে? দেখবে মিমি আর কোন দিন আমাদের বাড়ী আসবে না।--
---না আসবে, না আসুক। তাই বলে টাকা-পয়সার ওরকম নয়-ছয় আমি একদম সহ্য করতে পারিনা।---------
( তিন )
বাবা-মা অফিস চলে গেলে, আম্মা আমায় স্কুল থেকে নিয়ে আসে। তারপর সারাদিন আমি আর আম্মা শুধু বাড়ীতে। আমার সব চেয়ে ভাল লাগা সময়। দুপুর বেলা আম্মার বুকের কাছটিতে শুয়েই বলি ------নাও শুরু কর -----
---কি? কি আবার শুরু করব?----
------কেন, তোমার গল্প?------
----আমার আর কত গলপ আছে রে?--------
----আছে, আছে আমি জানি, তোমার ঝুড়িতে এখনও অনেক গল্প আছে।--------
আজ তাহলে একটা নতুন ঘটনার কথা বলি শোন। তোমাদের এখন যেমন নিত্য নতুন অনুষ্ঠানে, এই যেমন নব-বর্ষে আবার নিউ-ইয়ারে, দুর্গা পূজা, কালী পূজা, সরস্বতী পূজা, আবার জন্মদিন এরকম যে কোন পর্ব্বেই নতুন জামা হয়। হয়তো? ------ হ্যাঁ-------------
আমাদের ওরকম সব পর্ব্বেই নতুন জামা হোতনা। বছরে শুধু সেই একবার দুর্গা পূজার সময়, সারা বছরের ঋতুর কথা মাথায় রেখে জামা বানান হত। অবশ্য একেক জনের তিন-চারটে করে জামা, প্যান্ট, যাবতীয় সব এমনকি এক জোড়া করে জুতো মোজাও হত। আসলে আমার বাবাতো পূজোর সময় বোনাস পেতেন, তাই সে টাকাটা দিয়ে সারা বছরের সবার পোষাক-পরিচ্ছদ তৈরী করে দিতেন। প্রতিটি বিষয়েই বাবা প্রচন্ড নিয়ম, শ্বঙ্খলা মেনে চলা পছন্দ করতেন।
ফলে আমরা মাসের প্রথমেও কখনও পোলাও কোর্মা খাইনি ঠিকই, আবার মাসের শেষেও ডাল-ভাত খাইনি। সব সময়েই মাছের ঝোল-ভাত জুটেছে। তোমাদেরতো এখন নিত্য নতুন আইটেম না হলে মুখেই রোচেনা। না কি কথা হচ্ছিল যেন?-----
ওইতো পূজোর জামা, পূজোর জামা।--------
----হ্যাঁ, পূজোর প্রায় মাসখানেক আগেই, বাবা একদিন দর্জি সেন কাকুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ীতে উপস্থিত হতেন। আমরা জেঠতুতো, খুড়তুতো মিলেতো অনেক ভাই-বোন ছিলাম। সকলকে সারি সারি দাঁড় করিয়ে, একের পর এক,- শুরু হোত বিভিন্ন ডিজাইনের জামার মাপ নেওয়া। বাবা ডিজাইনের বই খুলে, পছন্দ মত ডিজাইন বলে দিতেন। সে আমলেও, ইংলিশ-প্যাটার্ণের ডিজাইনই বাবা বেশী পছন্দ করতেন। আমাদেরতো তখন অত ইংলিশ বাংলা নিয়ে চিন্তা ছিলনা। কিন্তু আমাদের ভীষণ রাগ হোত কারণ আমরা এ ব্যাপারে কোন কথাই বলতে পারতাম না। আমাদের কথা কেউ গ্রাহ্যই করত না। যদিবা সাহস করে, কেউ একটু নিজেদের মতামত পেশ করতে চেষ্টা করত, ওমনি সাথে সাথে সেটা নাকচ হয়ে যেত। ফলে নতুন জামার মাপ দিয়েই সবার মুখ হয়ে যেত গোমড়া।
তারপর কাপড়ের পরিমান জেনে, দোকান থেকে কাপড় কিনে, সেটা সোজা চলে যেত দর্জির কাছে। কিরকম ছিট, কেমন রঙ কিছুই আমাদের জানার উপায় ছিল না। পূজোর ঠিক দু দিন আগে, জামার বিরাট বান্ডিল নিয়ে বাবা বাড়ী আসতেন।
আবার সেই সারি সারি দাঁড় করিয়ে একটা একটা করে পরিয়ে দেখা হোত, সব ঠিক হোল কিনা। আমাদের হারিয়ে যাওয়া পুরোন দুঃখ আবার চাগাড় দিয়ে উঠত। কারুরই ঠিক মন মত হোত না। তবে কোন দুঃখই আমাদের বেশীক্ষন কাবু করতে পারত না। একটু পরেই সব ভুলে যেতাম।
----আমিও তো ভুলে যাই, না আম্মা?----
----কোথায় ভুলে যাও? সেদিন রাস্তার মাঝে, আইস-ক্রীম না কিনে দেওয়ায়, আমায় কেমন নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে ছিলে মনে আছে?-------
--------ওতো মাত্র একদিন। আচ্ছা, তারপর কি বল--------
---যাইহোক, পূজোর দিন, কিন্তু কারুর আর কিচ্ছুটি মনেও থাকত না। মা সকাল সকাল চান করিয়ে, সাজিয়ে, গুছিয়ে দিতেন। দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা কেউ জানতামই না। সারাদিন বাড়ীর সামনের প্যান্ডেলেই বন্ধুদের সাথে খেলা করে কেটে যেত। তখন জামা পছন্দ অপছন্দের কথা খেয়ালই থাকত না। কখনও কোন বন্ধুর মা, যখন কাছে ডেকে, জামা ধরে বলতেন, বাঃ, কি সুন্দর দেখাচ্ছে।----- তখন বুঝতাম, না আমার বাবার পছন্দ বেশ ভালই । সেই ছিট, সেই ডিজাইনি তখন সবচেয়ে বেশী ভাল লাগত।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, পরের বছরও পূজোর সময় আমরা ঠিক সেই একই ঘটনা ঘটাতাম।
-----আমার তো ঘরে একটা বোনও নেই, পাড়ায় একটা বন্ধুও নেই।-----------
------তোমার যে আমি আছি সোনা----------------"
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১১ সকাল ১০:৩০