
[এক]
[সোমবার বিকেল]
মোবাইল টা বাজছে। ঘড়ির দিকে তাকাল দিয়া। চার টা বাজে। নিজের ঘরের জানালা দিয়ে যেমন বাইরে তাকিয়েছিল, তেমনি করেই তাকিয়ে রইল ও। সুন্দরী এই মেয়েটা প্রায়ই সব সময় বিষন্ন থাকে, প্রায়ই এভাবে উদাস হয়ে দোতলার এই নিজের ঘরের জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় । দোতলা এ ঘরের জানালার বাইরে টা সুন্দর ,কিছু দুরেই একটা ছোট নদী । বাংলাদেশের আর সব নদীর মত করুন পরিনতি স্বীকার করে নিতে হচ্ছে এটাকেও। তবে বর্ষাকালে যখন অল্প স্রোতে কচুরিপানা ভেসে যায় বা শীত হেমন্তে যখন কচুরিপানার ফুলে নদীর পুরোটা ঢেকে যায় তখন অদ্ভুত সুন্দর লাগে। নদীর কষ্ট আর চোখে পরেনা।
নদীটা ঠিক আমার মত,ভাবে দিয়া। একটু একটু করে কষ্ট পেয়ে মরে যাচ্ছে। সুন্দর একটা নদী মরে যাচ্ছে। হঠাত করেই ও যেন নদীর কষ্টটা বুঝতে পারে। নদীটাকে নিজের অংশ বলে মনে হয়। কান্না পেয়ে গেল দিয়ার। কেন এমন হবে? কেন এমন হয়!
ফোনটা আবার বাজছে। চারটা এক ,জানে দিয়া। চারটা দুয়ে আবার বাজবে। চারটার সময় এই তিন বার ফোন আসার রুটিন আজ থেকে কয়েক মাস হল চলছে। এখন আর কল রিসিভ করে না সে। জানে কার ফোন। ছেলেটা তাদেরই ভার্সিটির।রাজু নাম ছেলেটার। এক ক্লাসেই পড়াশুনা করে। দেখতে ভদ্র ,মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেনা। ক্লাস শুরু হওয়ার এক কি দু’মিনিট আগে হাতে একটা বই নিয়ে ক্লাসে আসে। ক্লাস শেষ হলে চলে যায়। এর বাইরে কখনো দেখা যায়না কোথাও। ক্লাসের মেয়েরা বলে, একটা চশমা হলেই কানাবাবা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত!সেই ছেলে প্রায় ১ বছর ধরে বিকেল চারটায় তিন বার তাকে ফোন দেয়। কাওকে বলেনি ও। ইবু কে বলেছিলো। ইবু রেগে গিয়ে বলে , শালা একটা চামার। সবার সামনে এমন ভাব দেখায় যেন কত ভাল। আসলে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দিয়া হেসে বলেছিলো, কিযে বলিস, আমার কখনো ছেলেটা কে সে রকম মনে হয়নি।
ইবু রেগে গিয়ে বলে,তুই আমার চেয়ে বেশি বুঝিস?
- না ,মানে আমার সাথেতো কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি.........
- তাইলে লটকে পর,আর দেরি করিস না। মাল হাতছারা হয়ে যাবে......এত বুঝিস তো আমাকে জিজ্ঞেস করিস কেন? রেগে চলে যায় ইবু।
ইবু দিয়ার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। ওর নাম আসলে ইভা। দিয়া ডকে ইবু বলে ডাকে। ও একটু এরকমই। ছেলেদের দেখতে পারেনা। দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল ছেলেও ওর চোখে চরম খারাপ। ইবু যখন ছেলেদের নিয়ে কথা বলে তখন শালা সবচেয়ে ভদ্র সম্বোধন। বছর দু’য়েক আগে শিপন নামের একটা ছেলের সাথের ও একটা সম্পর্ক ছিলো,সেটা ভেংগে যাওয়ার পর থেকেই ও এমন হয়ে গেছে।
প্রথম কয়েক মাস দুই দিন এক নাম্বার থেকে ফোন দিত না ছেলেটা। তাই ও রিসিভ করতো। এখন মাসখানেক ধরে একই নাম্বার থেকে কল দিচ্ছে, বোধ হয় আর লুকিয়ে থাকতে চায় না।
আননোন নাম্বার দেখে প্রথমে ও ভাবতো অনুপ কল করেছে। পরিচিত হওয়ার পরথেকে এই সময়ই কল দিত অনুপ। অনুপের ভাল নাম অনুপম ঘোষ। হিন্দু ছেলে। একটা দেশে সংখ্যা লঘু হিসেবে আছে বলে সবাইকে সমঝে চলার অভ্যাস আছে ওর। কোন কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী ভাবতে পারে না। অনুপম ছেলেটার সাথে দিয়ার প্রথম দেখা হয় বড় ভাইয়ের বন্ধুর বিয়েতে। প্রথম দেখায় বিশেষ কিছু মনে হয়নি দিয়ার-আর দশটা সাধারন ছেলের মতই দেখতে । আর কখনোই হয়তো মনে হত না ,কিন্তু একদিন বিকেলে, রবিবার ,হ্যা রবিবারই ছিল দিনটা, দিয়া কে ফোন করল অনুপ। তার পর প্রায় প্রতিদিনই ফোন করতো। তারপর দিনে কয়েকবার। প্রথম প্রথম সহ্য করতে না পারলেও এক সময় দিয়া লক্ষ্য করলো, কেমন যেন অস্থিরতায় কাটে সারা দিন । কিছুই ভাল লাগেনা। সবসময় মোবাইল ফোনের আশেপাশে থাকে। বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে তার,কিসের জন্য কেন অপেক্ষা করে থাকে ও।
অনুপ ফোনে কথা বলতো প্রচুর। ধর্ম ,রাজনীতি,সাহিত্য ,খেলা কিছুই বাধ যেত না । এত সুন্দর করে কথা বলতো!! কিছু না জেনেও আটকাতো না। দিয়ার ভাল লাগত,কথা শেষ হয়ে গেলে ভাবত দুনিয়াতে কথা বলার মত বিষয় এত কম কেন ? এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন গুলো। মাঝে মাঝে কোন একদিন অনুপ ফোন করতনা, তখন এত বাজে লাগতো দিয়ার,মনে হতো সে মরে যাচ্ছে। ছেলেগুলো এত খামখেয়ালি কেন যে হয়? কি এমন হয়একটা ফোন দিলে। মনে মনে এমনি ভাবত আর বাথরুমে লুকিয়ে লুকিয়ে কাদত।
তারপর একদিন হঠাতই-
-দিয়া, আমি ভালবাসি তোমাকে।
দিয়া অবাক হয়নি । জানতো এটা আসছে। সে দিনের পর দিনজেনেছে এটা আসছে। সে এটার জন্য অপেক্ষা করেছে , জবাব কি হবে তা নিয়ে রাতের পর রাত ভেবেছে ।
-ইয়ে ...মানে ,দেখ অনুপ ,টের পেল দিয়া, কেমন যেন কাপছে সে ।কোথায় যেন গলে যাচ্ছে সে,এত সুখ কেন বেচেঁ থাকায়।
-কি? বল কিছু একটা। অনুপ তাড়া দেয়।
-না মানে এটা তো সম্ভব নয় তাইনা। তুমি আমি ......আলাদা ধর্ম।
-আমি চেঞ্জ করবো আমারটা! অনুপ বলে।
-তার পরও না। ফোন কেটে দেয় দিয়া।
কেমন একটা ভালগায় বিবশ হয়ে যায় ও। গ্রীস্মের ধুলোমাখা যে পৃথিবী বর্ষাতেই কর্দমাক্ত হয়ে যায়,শীতে হয় বিবর্ন,মানুষের চাপে ভারে যেটা ক্লেদাক্ত আজ সেটাই অনেক সুন্দর বলে মনে হল দিয়ার। এখন একটু সময় দরকার ওর। অনুপের সাথে পরেও কথা বলা যাবে। এখন এই সময় টাকে, জীবনের এই মুহুর্তটাকে উপভোগ করতে চায় ও। নিজের জন্য, শুধুই একা। এখন দিয়ার একটু সময় দরকার।
[দুই]
ওই রাজু ছেলেটা আবার ফোন করেছে। সাড়ে চারটা বাজে।এখন তো ফোন করার কথা না । ব্যাপার কি?
-হ্যালো।
-হ্যালো দিয়া, আমি কি বলছি তুমি মনযোগ দিয়ে শুন।
-হ্যা ,শুনছি ,বলুন।
-তুমি জান,কাল আমাদের ভার্সিটি থেকে দেওয়া আমেরিকান স্কলারশীপ টার ভাইবা সাড়ে দশটায়।
-জানি।
-আমি ঠিক দশটা থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো বটতলায়। তুমি না আসলে সাড়া দিন।
-শুনলাম ,এখন রেখে দেই?
-দেখ দিয়া, আমি কিন্তু সিরিয়াস।
ফোন রেখে দিল দিয়া। সব ছেলেই মেয়েদের কাছে একই কথা বলে। এমন কথা অনুপও বলেছিল,ভালবাসি বলার পরদিন।
-দেখ দিয়া,আজ আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো বিকেলে, বটতলায়। তুমি যদি না আসো তবে কাল আমি এক্সাম দিব না।
দিয়া জানত পরদিন অনুপের বি এস সি ফাইনাল এক্সাম । তাই ও আর না করতে পারিনে । পরদিন গিয়েছিল বটতলায়। দিয়া জানত একদিন না একদিন ও অনুপের কাছে যাবেই । দিয়া জানে অনুপকে ভাসবাসে ও।
দিয়া আর অনুপের প্রেম টিকল না বেশি দিন। কেমন করে জানি দিয়ার মা টের পেয়ে গেলেন। একদিন বাসায় দিয়া টের পেল সব কিছু কেমন যেন । বাতাসেও গুমোট একটা ভাব।মাকে দেখেই দিয়া বুঝল,মা জানে,মা সব জানে। ভয়ে চুপসে গেল দিয়া।মাকে জন্মের মত ভয় করে ও। তবু রাতে মা যখন তার রুমে এল তখন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেও।
তাই মা যখন জিজ্ঞেস করলেন,এসব কি হচ্ছে দিয়া?
স্বাভাবিক থাকার প্রানপ্রন চেষ্টায় দিয়া বলেছিলো,কি হচ্ছে মা। খারাপ কি ছু নাকি?
রাগে ফেটে পরলেন মা,চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বললেন, ন্যাকামো করোনা। বদ মেয়ে ,তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি। সেদিনও দুধের বাচ্চা ছিলে তুমি,আর আজ তুমি একটা হিন্দু.........একটা হিন্দু ছেলের সাথে নিজেকে জড়াতে পারলে। আমাদের কথা একবারো চিন্তা করলে না। বলেই মা কেদে দিলেন। সারা জীবন মাকে কঠিন মহিলা হিসেবেই দেখে এসেছে দিয়া। মাকে কাদতে দেখে তাই ওর সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল।
-সরি মা ,ভুল হয়েছে আমার।কাদতে কাদতে বলে দিয়া।
-তুই প্রতিজ্ঞা কর ,আর কখনো যাবিনা ঐ ছেলের সাথে।
-যাবনা,মা।
-আমার মাথা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
এতক্ষনে কাঠ হয়ে যায় দিয়া। মা কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি কি অনুপ কে ছাড়া থাকতে পারবো? দ্বিদায় পরে যায় দিয়া। মাকে কথা দেওয়া আর মাথা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করা দুটি ভিন্ন জিনিস বলে মনে হয় দিয়ার।
-কি হল,প্রতিজ্ঞা কর।
মায়ের মাথা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করে দিয়া। সাথে সাথে পাপবোধ আর নিদারুন অপরাধ বোধ তাকে চেপে ধরে। মায়ের কথা মত যন্ত্রের মত অনুপ কে যোগাযোগ করতে মানা করে। তবু মাঝে মাঝে অনুপ ফোন করলে মায়ের কথা মত খারাপ ব্যবহার করে আর সময় পেলে বসে বসে কাদে। কয়েক দিন পরে ভার্সিটিতে গিয়ে দেখে সব বদলে গেছে। সবাই কেমন যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। পরিচিত মানুষ গুলো এমন অপরিচিত হল কি করে?
ইবু এসে খোলাসা করে সব,
-কি হয়েছে তোর অনুপের সাথে।
-কেন?
- অনুপ কে তুই কি সব মেসেজ পাঠিয়েছিলি সব নানা জনের কাছে ফাস করে দিয়েছে অনুপ। ফোনে তোর কথা রেকর্ড করে রেখেছিল এখন সবাইকে বাজিয়ে শুনাচ্ছে। আর নানান বাজে কথা ছড়াচ্ছে। তোর সাথে নাকি তার এই হয়েছে,সেই হয়েছে। নানান রসালো কথা বার্তা।
সারা গা ঠান্ডা হয়ে গেল দিয়ার । কি করছে এসব অনুপ। তার সাথে কি এমন হয়েছে অনুপের। অনুপ পারলো তার নামে এমন কুৎসা রটাতে। তাকে না ভালবাসতো অনুপ? কয়েক দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় বারের মত দিয়ার জীবনটা উলটা পালটা হয়ে গেল।
[তিন]
[মঙ্গল বার ,বিকেল তিনটা]
আজ বিকেলটা অনেক সুন্দর হবে ,নিজের রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে ভাবল দিয়া। প্রতিদিন ই এমন ভাবে কিন্তু অনুপ ওরকম করার পর থেকে দিয়ার জন্য সুন্দর বিকেল কখনো আসে নি। প্রতিদিন একই রকম ক্লান্ত আর জন্ডিস আক্রান্ত হলদে বিকেল। হলুদ রঙ দিয়ার অপছন্দ। কেবল হলুদ নয় ,লাল,নীল এমনকি সাদা সব রঙই দিয়ার অপছন্দ। ওর বিষন্ন ভুবনে সবকিছুই রংহীন।
-কিরে ফোনটা ধরিস না কেন? দরজার ওপাশ থেকে বিরক্ত স্বরে বলেন মা,সেই কখন থেকে বাজছে।
ফোনটা হাতে নিল দিয়া। ওর থিসিস সুপারভাইজার।
-হ্যালো,দিয়া।
-জ্বি ,স্যার।
-তারাতারি ক্যাম্পাসে চলে এসোতো। তারাতারি।
-কেন,স্যার।
-আর বলোনা,আমেরিকান স্কলারশীপ টার জন্য আমরা দশজনে ভাইবা তে ডেকেছিলাম। এর মধ্যে রাজু ছেলেটা আসেনি।
একটা বিট মিস করলো দিয়া।
স্যার বলেচলছেন,কি বোকা দেখ , মোবাইল পর্যন্ত অফ করে রেখেছে। অথচ এই ছেলেটার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ছিল। যাই হোক এতে ভালই হয়েছে তোমার জন্য। তোমার পেপার আমি দেখেছি। তুমি তারাতারি চলে এসো। ২০ মিনিটের মধ্যে। মনে রেখ এমন সুযোগ কিন্তু আর পাবেনা।
-জ্বি স্যার।
ফোন রেখে দিল দিয়া। কেমন যেন লাগছে ওর, ভেতর থেকে কি যেন বের হয়ে আসতে চাইছে। আয়নাতে নিজেকে একবার দেখেনিয়ে ঝড়ের বেগে ঘরথেকে বেরিয়ে এল। পেছন থেকে মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছিস?
-কাজ আছে মা। ঘুরে মাকে জড়িয়ে ধরে আবার ছুটল।
হাতে কিছু ফুল নিয়ে ,একটা রিক্সা করে দিয়া যখন বটতলার পৌছালো রাজু তখনো সেখানে অপেক্ষা করছিলো। দিয়া কে দেখে রাজু হাসলো একটু। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে দিয়া মনে মনে বললো,আজ তোমাকে ক্ষমা করলাম অনুপ,আজ তুমি মরে গেলে!!