ইব্রাহিম ‘আব্দ আল-হালাওয়ানি সাধারণ কোন লোক নন। কঠোর নৈতিকতার অধীকারী হওয়াতে জীবনে তিনি কখনও মিথ্যা বলেন নি, নিরীহ সাদামাটা বা কারো ক্ষতিকরতে পারে এমন যে কোন ধরনের মিথ্যে থেকে সবসময় তিনি দূরে থেকেছেন। সব ধরনের হিংসা-বিদ্বেষ আর দ্বিমুখিতা তিনি সাংঘাতিক ঘৃণা করেন, এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোন স্বাভাবিক বাদরামিও তিনি মোটেই গ্রাহ্য করেন না। এসব তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে।
যখনই কিছু একটা গড়মিল আন্দাজ করতে পারে, বা অনৈতিক কিছু চোখে পড়ে তখনই তার চোখ জোড়া জ্বলেতে থাকে, ঘাড়েররগ ফুলে ওঠে, এবং গলারস্বর বদলে সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ হয়ে ওঠে।
ছোটবেলার শিক্ষাদীক্ষাই তাকে এমন আচরণে অভ্যস্থকরে তুলেছে। তার বাবা, হাজ ‘আব্দ আল-হালঅওয়ানি শারকুইয়া প্রভিন্সের অনেক জমিজিরাতের মালিক এবং একই সঙ্গে তিনি সৎ আর পুণ্যবান ব্যাক্তিও। ইব্রাহিমের দশবছর বয়েসে তিনি মারা যান। তবে বাবার সেই চমৎকার স্মৃতি সে সবসময় বয়ে বেড়াচ্ছে, বাবার বন্ধু বা পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলেই সেগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সবাই তার বাবার প্রতি সম্মান জানিয়ে, তার গুনগানের কথা বলে। সেগুলো শুনে ইব্রহিমের মনের ভেতরে বাবার ছবিটা আরো আলোক, উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, যেন সে ঈশ্বর প্রেরিত কোন পবিত্র পুরুষ।
সম্ভবত ইব্রাহিম ‘আব্দ আল-‘আল’র বিধবা স্ত্রী, ইব্রাহিমের মা-ও, ছেলেকে উন্নত নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সন্ন্যাসিনীর মতো জীবন যাপন শুরু করেন, ইব্রাহিম সহ অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সেবা করতে শুরু করেন। তাদেরকে সব ধরনের স্নেহ, মায়া, মমতা আর ভালোভাসা দিয়ে বড়করে তুলতে থাকেন।
ভেতর ভেতর ইব্রহিম টেরপায় বাবা ব্যাক্তিত্বের অনেক কিছুই তার মাঝে ফুটে উঠেছে। এমনকি গ্রাম ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পরও সেটা অব্যহত থাকে। ঘটনাক্রমে সরকারের কৃষিমন্ত্রণালয়ে তার চাকুরি হয়। তার কঠোর নৈতিকতার কারণে সহকর্মীরা তাকে “শেখ ইব্রাহিম” নামে ডাকতে শুরু করে।
তার বয়স যখন পঁচিশ, তখন থেকেই তার মা বিয়ের জন্য তাকে চাপ দিতে শুরু করে। নিজেকে সে বোঝায়, মা-ই তার জীবনের একমাত্র নারী হওয়া উচিত-একথা ভেবে সে তাতে কোন আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু শেষে মায়ের তোড়জোড়ের কাছে হারমানে, বিষয়টি নিয়ে মায়ের সঙ্গে আর তর্কে জড়াবার ইচ্ছে তার নেই। অন্যদিকে মা’র বিশ্বাস ছেলে তাকে সুখী করতে চায় বলেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।
মা-ই তার জন্য কনে পছন্দ করে, তার খালা শুবার পাশের ফ্ল্যাটের কায়রোর একমেয়ে থাকে। খালার বাসায় যাবার পর মা তাকে বেশ কয়েকবার দেখেছে এবং মেয়েটার অসাধারণ রূপ-যৌবন দেখে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মেয়াটার মায়ের গুনেও তিনি মুগ্ধ, এই মহিলা ছেলে ইব্রাহিমের জন্য ভালো একজন শ্বাশুড়ি হবেন সেটা তিনি খুব বুঝতে পারেন।
সবকিছুর আয়োজন চলতে থাকে, এবং বাগদানের উপহার১ কেনার জন্য একদিন সকালে ইব্রাহিম সঙ্গে হবুবধু এবং শ্বাশুড়িকে নিয়ে স্বর্ণাকারের বাজারে যায়। সেখানকার বিখ্যাত একটা স্বর্ণকারর দোকানে ঢুকতে-- দোকানী তাদের দেখেই আসার কারণ বুঝতে পারে। স্বর্ণ, হিরা, পান্না দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাবার আগপর্যন্ত তারা একে একে সেখানে বিভিন্ন ধরনের আংটি, কানের দুল আর পোশাকের পিন দেখতে থাকে।
সম্ভাব্য কনে কিছুটা অস্বস্থিতে ভুগছে বলে মনে হয়, এবং গহনা দেখার সময় তার হাত সামান্য কাঁপতে থাকে; কিন্তু সে তার এই অস্বস্থি নিজের জড়োসড়ো লজ্জা দিয়ে আড়াল করতে সক্ষম হয়। তার পছন্দ সম্পর্কে সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। ইব্রাহিমের উপরেই সে পছন্দের ভার অর্পণ করে।
কনের মা বার বার করে সেসবের দাম জানতে চেয়ে নিজের সত্যিকার আচরণ প্রকাশ করে। সে জানায় ভাবী জামাই খুব দামি উপহার কিনুক সেটা তিনি চান না। তার এমন ব্যাবহার ইব্রাহিমকে ব্যাকুল করে। এতে আরো বেশী উৎসাহ নিয়ে সে তাকে ঐকান্তিক স্বরে বলে, দামটা আসলে কোন বিষয় নয়, তার মেয়ের উপযুক্ত জিনিস খুঁজে বের করাই আসলে খুব শক্তকাজ বলে মনে হচ্ছে।
এমন হৃদয়গ্রাহী কথাবার্তার সময় অবাক করা একটা ঘটনা ঘটে। হঠাৎ-ই স্বর্ণকার এসে দাবীকরে তাদের যে গহনা গুলো দেখতে দেয়া হয়েছে সেখান থেকে একটা সোনার ব্রেসলেট খোয়া গেছে। তাদের সবাই তাতে একেবারে চুপ হয়ে যায়।
ইব্রাহিম প্রথমে স্বর্ণাকারের কথা ঠিক ধরতে পারে না।
“মনে হয় আপনার হাত থেকে পড়েগিয়ে থাকতে পারে,” সে মজা করে বলে। “একটু ভালো করে দেখুন।”
“স্যার,” জবাবে স্বর্ণকার বলে, “আপনাদের কথা বলার সময় আমি খুবকরে খুঁজে দেখেছি। আপনাকে থামতে দেখেই এখন সেটা বলছি।”
“আপনি আসলে বোঝাতে চাইছেন সেটা খুলে বলুন ?” কি ঘটেছে সেটা শুরু থেকে বুঝতে চেষ্টা করে আবারও ইব্রাহিম জিজ্ঞেস করে।
“দেবার সময় এখানে বিশটা ব্রেসলেট ছিল, আর এখন আছে ঊনিশটা।”
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,” ইব্রাহিম বলে।
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন,” স্বর্ণকার দৃঢ়স্বরে বলে, “তাহলে আপনাকে এখন সেটা খুঁজে দেখতে বলতে পারি। হতে পারে আপনার পাজামার পায়ের দিকের ভাঁজে সেটা পড়ে আটকে থাকতে পারে। নতুবা আপনার সঙ্গে আসা মহিলাদের কেউ ভুলকরে হ্যান্ড ব্যাগে রেখে দিতে পারে।
ইব্রাহিমের চোখ রাগে চক চক করতে থাকে এবং গলার শিরা ফেঁপে ওঠে।
“আপনি ঠিক কী ইঙ্গিত করছেন ?” সে চিৎকার করে ওঠে।
“স্যার—”
“আপনি আমাদের দোষ দিচ্ছেন, দেন নি ? আপনি ! আপনার চাইতে আমাদের সম্মান অনেক বেশী, আপনার বাবার থেকেও বেশী, আর তার আগে আপনার বংশে আর যে যে ছিলো তাদের সবার থেকেও বেশী !”
ইব্রাহিম ভেবেছিল তার এমন শক্ত কথাবার্তায় সমস্যাটার ইতি ঘটবে। এধরনের শূন্যগর্ভ নালিশ খুবই পৈশাচিক। অন্তত তার মতো সম্মান জনক একজন ব্যাক্তির জন্য, সে ইব্রাহিম ‘আব্দ আল-হালাওয়ানি’র ছেলে, যার কথা আজো ঘরে ঘরে আলোচিত হয়, এবং সঙ্গে আসা মহিলাদের একজন তার ভাবী-বধূ অন্যজন তার মা। কি করে তারা তাদের এতোটা ছোট ভাবতে পারলো ? এটা অবিশ্বাস্য !
আর এই বোকাটা, এখন তাদের সবাইকে সন্দেহ করছে। তার চেহারা নির্মমভাবে কুঁচকে আসে।
“আমারা এখানে চারজনই আছি,” সে ভ্রূকুটি করে বলে। “ব্রেসলেটটা আমাদের কারো কাছেই আছে।”
“আর সেই শুকরটা আসলে তুই নিজে বদমাস !” ইব্রাহিম উত্তেজিত কণ্ঠে বলে।
স্বর্নকারের গলার স্বর বরফের চাইতে শীতল হয়েযায়।
“আমি কোন ঝামেলা চাই না,” সে বলে। “কিন্তু আমাকে তল্লাশি করতে না দিলে সেই কাজটা পুলিশ এসেই করবে।”
“পুলিশ !” ইব্রাহিম চিৎকার করে ওঠে। “তুই কি জানিস আমি কে ?”
“বিশ্বের সবচাইতে সম্মানিত লোক, সেটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু এখন এর কোন বিকল্প নেই। আমরা আপনাকে তল্লাশি করবো নয়তো সেই কাজটা পুলিশ এসে করবে।”
ভাবী-বধূ কাঁদতে শুরু করে, আর তার মা রাগে সমানে গর্জাতে থাকে।
“আমিই পুলিশ ডাকবো,” ইব্রাহিম আরো জোরে বলে। “তো’কে ধরিয়ে দিতে !”
কনে মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে।
“ওদেরকে আমাদের ওপর তালাশকরে দেখতে দিলেই তো,” আতঙ্কে তিনি বলেন, “সব কিছু একেবারে মিটে যায়।”
“প্রশ্নই ওঠে না, মা।”
“কোন চিন্তা করো না, বাবা,” সে বলে। “আগের সব কিছু ভুলে যাও আর ওদের কাজটা করতে দাও।”
“আমাদে এখানে একটা যুবতী মেয়ে আছে,” স্বর্ণকার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে। “উপরে নিয়েগিয়ে সে মহিলাদের তল্লাশি করে দেখতে পারে।”
“তাড়াতাড়ি আমাদের তল্লাশি করে দেখুন,” ভাবী-বধূ কান্নাভেঁজাকণ্ঠে বলে। “যত তাড়াতাড়ি পারা যায়”।
সবাই ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে আছে—সেই একমাত্র ব্যাক্তি যে এধরনের তলাশের বিরোধী। সে মারাত্নক উদ্বিগ্ন বোধ করতে থাকে, তার ভাবী-বধূ আর তার মা তাকে ভুল বুঝতে পারে।
“ঠিক আছে,” সে রাগিস্বরে ফিসফিসকরে বলে। “আসুন আমাকে তল্লাশি করুন। স্রস্টার ওপর আমার পুরোপুরি আস্থা আছে।”
মহিলা কর্মচারী কতৃক তল্লাশির জন্য ভাবী-বধূ তার মায়ের সঙ্গে ওপরে যায়, সেসময় স্বর্ণকার ইব্রাহিমকে তল্লাশি করে দেখে। তাদের কারো কাছেই ব্রেসলেটটা পাওয়া যায় না। হঠাৎ মহিলা কর্মচারীটি স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে মেঝেতে ঝুঁকে ব্রেসলেটটা তুলে আনে। এই প্রথম স্বর্ণকার নিজেকে সর্বশান্ত বোধ করতে থাকে। এরপর ফ্যাকাশে চাহনিতে সে ইব্রাহিম আর তার ভাবী-বধূ আর তার মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে শুরু করে।
কিন্তু সেটা ইব্রাহিমকে সন্তষ্ট করতে পারে না। এই পর্যন্ত যা যা ঘটেছে এর সবই তার জন্য ন্যক্কারজনক আর ঘৃণ্য। তার এবং তার ভাবী-পরিবারের হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারের আগে সে কিছুতেই সেই দোকান ছেড়ে বেরুতে পারে না। পুলিশে খবর দিতে হবে !
“আমি এখনই পুলিশ ডাকবো,” সে বলে। “সেই কাজের জন্য তোমার ফোনটাই ব্যবহার করবো।”
“স্যার,” স্বর্নকার বলে, “পুরো ব্যাপারটা তো এরই মধ্যে মিটে গেলো। সত্যিই আমি খুবই দুঃখিত।”
“এখন ক্ষমা চেয়ে পার পাওয়া যাবে না, এতক্ষণ যা করেছ তারপর এধরনের প্রশ্ন উঠতেই পারে না। তোমার হাতে হাতকড়া পড়ানো উচিত।”
“আমাদের ক্ষমাকরে দিন, স্যার। আমাদের সবার ভুল হয়েছে।”
“কিন্তু মহিলাদের সঙ্গে এমন করার পরও ক্ষমার প্রশ্নই উঠতে পারে না।”
ইব্রাহিম টেলিফোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বর্ণকার তার হাতটেনে ধরতে চায়, কিন্তু ইব্রাহিম তাকে ধাক্কাদিয়ে সরিয়ে দেয়।
“এবারের মতো মাফ করে দাও, বাবা,” মা প্রায় কেঁদে ওঠে। “আমি তোমার কাছে অনুনয় করে বলছি—”
“চুপ থাকুন,” ইব্রাহিম খেকিয়ে ওঠে। “কি করছি সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। কিন্তু আমি এর শেষ না দেখে যাচ্ছি না—”
কাছে এসে মা তাকে জড়িয়ে ধরে, কিন্তু সে তাকে ক্ষভের সঙ্গে দূরে ঠেলে দিয়ে পুলিশের জরুরি নাম্বারে ডায়াল করার প্রস্তুতি নেয়।
“আপনি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছেন, স্যার,” স্বর্ণকার বলে। তার গলার স্বর এখন আগের চাইতে আরো বেশী কঠোর আর বিস্ময়কর।
মা শক্তকরে ইব্রাহিমের হাত ধরে।
“সেটা করলে ভোগান্তিটা কেবল আমাদেরই পোহাতে হবে,” মিনতির সুরে তিনি বলেন।
“কেন ?” আক্রোশে ইব্রাহিম চিৎকার করে ওঠে।
“ম্যাডাম, উনাকে বলুন,” স্বর্ণকার অনুনয়ের স্বরে বলে। “কাজটা করার আগেই উনার কাছে সব খুলে বলুন, ম্যাডাম।”
“ব্রেসলেটটা আমিই নিয়েছিলাম, বাবা,” তিনি ফিসফিসিয়ে বলেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আবার থামেন।
সত্যিকারে কি ঘটেছে সেটা এবার স্বর্ণকার ইব্রাহিমের কাছে খুলে বলে, সেসময় মায়ের সারামুখ চোখের জলে ভিজে আসে। সেই মহিলা কর্মী তার কাছে ব্রেসলেটটা পায়; অথবা সে আপনা থেকেই কাপড়ের ভাঁজ থেকে সেটা তাকে বের করেদেয় এবং মেয়ের ভাবী-স্বামীর কাছে ব্যপারটা প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন।
“তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম,” স্বর্ণকার বলতে থাকে। “এমন ঘটনা চারপাশে ভুরি ভুরি ঘটছে, আর আমরা এতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। খুব ভয়ঙ্কর অবস্থা, স্যার—ঠিক আছে এখন এসব ভুলে যান। জুয়েলারি মহিলাদের খুব সহজেই প্রলুব্ধকরে। বিশ্বাস করুন, আমি এতেকিছু মনেকরিনি। আজকাল ভদ্র ঘরের মেয়েরা এসব করছে। কখনও কখনও তারা আমাদের পাত্তা না দিয়েই চলে যায়, কিন্তু আমারা সব সময়ই মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি, এখন যেমন দেখলেন। ব্যাবসায়ীক সুনামের খাতিরে আমাদের সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হয়। আমি যদি ক্রেতাদের জেলখানাতেই পাঠাতাম তাহলে তো আজ থেকে বিশ বছর আগেই আমাকে দোকানটা বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকতে হতো।”
বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে ইব্রাহিম স্বর্ণকারের কথা শুনে, তার মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। যেন নতুন কোথাও এসে পড়েছে, নতুবা স্বপ্ন দেখছে।
সে মায়ের দিকে তাকায়, বিছানার মতো করে একসঙ্গেপাতা কতগুলো চেয়ারে সে মেয়েকে জড়িয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎ করে চোর নিজেই যেন বলি হতে চলেছে, এবং তার মেয়েটা কোন হিংস্রপশু দেখছে এমনভাবে তারদিকে তাকিয়ে আছে, তার দৃষ্টিযেন তাকে মৃত্যুভয় পাইয়ে দিয়েছে। সে মহিলা কর্মীর দিকে তাকায় তার ঠোঁটে কপট ঘৃণার টিহ্ন। এটা খুবই স্পষ্ট সবার সঙ্গে তাকেও সে অবজ্ঞার চোখে দেখছে।
“আমি কি কিছু ভুল করেছি ?” ইব্রাহিম নিচুস্বরে বলে।
“এসব নিয়ে আর ভাবার দরকার নেই, স্যার,” স্বর্ণকার বলে, যেন এখানের সবার মাঝে ইব্রাহিমই শুধু ভুল করেছে—সেই যেন সত্যিকারের অপরাধী।
ইব্রাহিমের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে শুরুকরে। চারপাশের সবকিছু যেন থেমে গেছে। চুরি একটি অপরাধ, কিন্তু এখানকার সবাই তার বিপরিত। তারও সেটা বোঝার দরকার রয়েছে; অন্তত সবার কাছে তার নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। কিন্তু এখন কেমন করে সেটা সম্ভব ? সে এর জবাবে কি বলবে ? বিয়ের ব্যাপারে এখনই সে কোন সিদ্ধান্ত নেবার কথা ভাবে না, কিন্তু স্বর্ণকারের মতই সে সাহসী আচরণ করার চেষ্টা করে। সে তার ভাবী-বধূর কাছে যায়।
“আমি একটা টেক্সি খুঁজে নিয়ে আসছি,” সে বলে।
“যা ভাগ,” আর্তনাদ করে ভাবী-বধূ বলে।
ইব্রাহিম স্বর্ণকারের দিকে তাকায়, যেন তার সমর্থন চাইছে, কিন্তু লোকটা তারদিকে শীতল শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর আবরও সে সেই মহিলা কর্মীর দিকে তাকায়, সেও তারদিকে ইস্পাত কঠিন উদ্ধত চোখে তাকিয়ে আছে।
“আমি আবার কী করলাম ?” খুব আস্তে করে সে বলে।
মায়ের ধরাশায়ী অবসন্ন দেহটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব দোষী মনেহয় তার, এমন পাপেরও অস্তিত্ব আছে আগে কখনই সেটা সে কল্পনা করেনি। আরেকবার সে তার ভাবী-বধূরকাছে যায়।
“দয়াকরে আমাকে এবারের মতো মাফকরে দাও,” যতটা সোহাগের সঙ্গে পারাযায় সেভাবেই সে কথাটা বলে।
“আমি তোকে বিয়ে করবো না,” অবাক করে দিয়ে সে বলে। “তোকে বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। তুই একটা পাষণ্ড !”
এই অবস্থায় বিয়ের ব্যপারে কিছু না ভাবার সিদ্ধান্ত সে আগেই নিয়েছে। আর এখন তার ভাবী-বউ কঠোর প্রত্যক্ষানের মধ্যদিয়ে পুরো চিন্তাধারাটাই বদলে দিলো !
হতবুদ্ধির মতো তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সবকিছু যেন চারপাশ থেকে ঘুরপাক খেতে খেতে তার দিকে ধেয়ে আসছে।
“ঠিক আছে,” কাতর কণ্ঠে সে বলে। “কিন্তু দয়াকরে, আমাকে কেবল এটুকু বুঝতে দাও—”
—রজার এলান এবং ক্রিস্টফার টিংলে’র ইংরেজি অনুবাদ থেকে সোহরাব সুমন
১. কনেকে কেবল আংটি না দিয়ে তার সঙ্গে ব্রেসলেট জাতীয় কিছু দেয়া সনাতন নিয়মের মধ্যে পড়ে। আরবিতে বাগদানের উপহারকে আল-শাবাকা নামে ডাকা হয় যার মানে “যে জিনিস বেঁধে রাখে” বা “যুক্ত করে”।
Fat-hi Ghanim (1924–1998)
ফাত-হি ঘানিম (১৯২৪-১৯৯৮)
ফাত-হি ঘানিম মিশরের নামকরা কল্পকাহিনী লেখক, তার প্রজন্মের আরো অনেকের মতো, তিনিও নাগিব মাহফুজ সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ছায়াতলে আবস্থান করার পক্ষপাতি। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল থেকে স্নাতক কোর্স সম্পন্ন করে সরকারি চাকুরে হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এবং নির্বাহী হিসেবে কাজ করার সময় তিনি তার প্রথম লেখা গল্পসংগ্রহ, অ্যা গিলডেন ইরোনা এবং পরে আল-জাবাল (দ্যা মাউনটেইন) (১৯৬৫), নামের উপন্যাস লিখতে অনুপ্রানিত হন। তার এই উপন্যাসটিতে মিশরের উপর দিককার চোরাচালানের ষঢ়যন্ত্র এবং সমতলের গ্রাম্য লোকেদের আধুনিক জীবনধারায় অভ্যস্থ হওয়ার চিত্র নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। কল্পকাহিনী রচনার ক্ষেত্রে ঘানিম বিশেষ দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন, তার গল্প-দ্যা এক্সপেরিয়েন্স অব লাভ (১৯৫৮) এবং দ্যা স্পাইকড আয়রন পেন্স (১৯৬৪) এবং চারখণ্ডের বহুমাত্রিক উপন্যাস দ্যা ম্যান হু লস্ট হিজ শ্যাডো (১৯৬৬) এর মতো লেখাগুলোর মাঝে এর স্পস্ট নজির লক্ষনীয়। উপন্যাসটি ১৯৬৬ সালে ডেসমন্ড স্টুয়ার্ট ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। পরীক্ষামূলক ভাবে তিনি আরো অনেক উপন্যাস রচনা করেন, তার মধ্যে দোউজ ডেইজ (১৯৬৬), যা সময় বিভঙ্গ রূপে রচনা করা; দ্যা ইডিওট (১৯৬৬), যেখানে একজন মানসিক প্রতিবন্ধী লোকের জীবনালেখ্য বর্ননা করা হয়েছে। এবং হট এন্ড কোল্ড (১৯৭০), এতে সচেতন ভাবে আনন্দবিহ্বলতা প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার সর্বশেষ লেখাগুলোর মধ্যে, এ লিটল লাভ এন্ড অ্যা লস্ট ভায়োলেন্স (১৯৮৫), এ গার্ল ফ্রম শুব্রা (১৯৮৬), আহমেদ এন্ড দাউদ (১৯৮৯), এবং অমেন অব বিউটি (১৯৯১)। আধুনিক আরবকে নিয়ে বিচিত্র সব কাহিনী রচনার জন্য ১৯৯৫ সালে তিনি মিশরের রাষ্ট্রিয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরষ্কারে ভুষিত হন।