(স্কুল পালানো মেয়ে)
কাড়া রোদ। দুপুরের সেই কড়া রোদে পুড়েই ছায়া, অমৃতী, আঁখি আর রেখা – এক সাথে পায়ে পায়ে তেতে ওঠা পিচ ঢালা পথধরে হাঁটছে। ওদের সবাই আছে স্কুল ড্রেসে- কারণ এই মাত্র সেখান থেকেই ওরা বেরিয়ে এসেছে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে। স্কুলড্রেস পড়া অবস্থায় মেয়েদের মোটেও সুন্দর লাগেনা কিন্তু ওদের খুবই সুন্দর লাগছে দেখতে। নাহলে পথের দু’পাশের লোকজন এমন হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবে কেনো। তাদের এই আগ্রহ দেখে ওরা নিজেরা মনে মনে বুঝে নিচ্ছে আসলেই ওরা দেখতে খুব সুন্দর। একটু পরে স্কুল ছুটি হলে ভুরি ভুরি মেয়ে এই রাস্তা ধরে হেটে যাবে। তখন কিন্তু আর এই লোক গুলোর আগ্রহ এই পর্যায়ে থাকবেনা- সেসময় ওদের চেতনা অনেক খানি ভোতা হয়ে আসবে। বেশকিছু ক্ষণ ধরে ওরা এমন আরও কিছু খাপছাড়া বিষয় নিয়েই কথা বলে যাচ্ছিলো।
তাদের এই সব কথায় ছেদ পড়লো যখন আইসক্রিম দেখে রেখা একটা বাচ্চা মেয়র মতন আইসক্রিমের গাড়ির দিকে দৌড় লাগালো। - তাই দেখে আর সবাই একে একে সেদিকে পা বাড়াতে লাগলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ওদের আলাপ চারিতার বিষয় গেলো বদলে।
-এই আইসক্রিম ! চারটা কাপ দ্যাও।
রেখার নির্দেশ মতন, আইসক্রিম ওয়ালা ঢাকনা খুলে ডালার ভেতর থেকে দু’টা কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো
-আফা ! দু’ইটা কাপ হবে।
-এই ! আমি কাপ চাই
এক দৌড়ে আঁখি আইসক্রিম ওয়ালার হাত থেকে কাপটা দখল করলো।
আর এই মূহুর্তে আঁখিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী স্বার্থপর বলে মনে হলো ছায়ার। ও সবার সঙ্গে বরাবরই এমন করে আসছে। সব সময় হাঁসি খুশি, দিল খোলা কিন্তু কোন লেনদেনের ব্যাপার দেখা দিলেই ও কেমন যেনো স্বার্থপরের মতন হয়ে যায়, তখন সবচাইতে ভাল জিনিসটা দখল করা চাই ওর।
ক্লাসের ফাস্ট বেঞ্চের কোনায় এই আঁখির জন্যই এক দিনের জন্যও বসা হয় না ছায়ার। আর পরীক্ষার সময় ওর সাথে সিট পড়লেই হলো, পুরোটা খাতা এপাশ ওপাশ না দেখিয়ে এক অক্ষরও লেখার কোন উপায় থাকে না।
-এই ছায়া, নিচ্ছিস না কেনো, একটা চকবার ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছে।
- নারে আমি এখন আইসক্রিম খাবো না।
পেছনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছায়া বলে।
-কিছু একটা আঁচ করতে পেরে ওর কাপটা ছায়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে রেখা বলে।
-নেরে ভাই তুই আমার কাপটা ধর। আমিই না হয় চকবার খাই। আমিতো সব সময় চকবারই খাই, এইটাই আমার বেশী পছন্দের।
বলে অল্প খাওয়া কাপটা আরও খানিকটা বাড়িয়ে ধরলো ছায়ার দিকে, অন্য হাতে চামুচ।
-বললাম তো ! আমি এখন আইসক্রিম-টাইসক্রিম খাবো না, আমার ইচ্ছে করছে না।
-এই তোরা এক আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে আর কত লেট করবি। এ জন্যই কি ইম্পরট্যান্ট ক্লাস ফাঁকি দিয়ে স্কুল থেকে আগেভাগে সবাই বের হয়েছিস ? কাজের কাজ তো এখনো কিছুই হলো না।
এই কথা বলেই কাঠের চামুচ দিয়ে আবার আইসক্রিম তুলতে যাবে, ঠিক এমন সময় একটা কালো ট্যাক্সি ক্যাব দেখেই আঁখি ইশারা করে গলা কয়েক গুন চড়িয়ে বলে ওঠে।
-অ্যাই বসুন্ধরা কমপ্লেক্স যাবে।
ক্যাবটি রাস্তার পাসে সাইড করে, ড্রাইভার গলা বেরকরে পেছনে তাকিয়ে বলে, যামু আফা, তয় বিশ ট্যাকা বাড়ায় দেওয়া লাগবে।
-এই তোরা সব ওঠ।
আঁখির কম্যান্ড অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সবাই তড়িঘড়ি করে ক্যাবে উঠে পড়ে। ছায়া তবু নির্লিপ্তের মত দাড়িয়েই রইলো।
-এই ছায়া উঠছিস না কেন !
রেখা দরজার গ্লাস নামিয়ে ওরদিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায়।
-তোরা যা, আমার ইচ্ছে করছে না, বাসায় নানু একা, আজকে আমাকে একটু আগেভাগে বাসায় ফিরতে বলে দিয়েছে নানু।
খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকিয়ে ছায়া কথা গুলো বলল, যেনো একেবারে কিছুই হয়নি।
-ছায়া না গেলে আমিও যাবো না।
এই বলে অমৃতি গা ঝাড়া দিয়ে নামতে যাবে, এমন সময় আঁখি বলে উঠে।
-যাবিনা মানে ? তাহলে কি ওর সঙ্গে বসে এই রোদের মধ্যে আঙ্গুল চুষবি।
এই কথার কোন উত্তর দেবার আগেই অমৃতির পথ আটকে ধরে মুখে হাঁসি টানার চেষ্টা করে, ছায়া আবারো বলে ওঠে।
-প্লিজ ! তোরা যা, আজকের জন্যে আমাকে মাফকর প্লিজ ! এই বলে ক্যাব ওয়ালার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলে;
-এ্যাই মিঞা, গাড়ি ছাড় এবার- যাও-।
এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবখানা জোড়ে ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে স্টার্ট নিয়ে ধুয়া উড়িয়ে এক সময় ভিড়ের মধ্যে আরও অনেক যানবাহনের ভিড়ে ক্রমেই হারিয়ে যায়।
সঙ্গী সাথি কেউ নেই। ধীরে ধীরে হেটে, এবার কি করা যায় তাই ভাবছে ছায়া। দেখতে দেখতে রেলগেট পর্যন্ত চলে এসেছে সে। এখন আর আগের মতো রোদ নেই। আকাশটা মেঘে ঢেকে গেছে। দমকা বাতাসের সাথে ধুলোবালি উড়ছে। এরই মাঝে দেখতে না দেখতে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। এক্কেবারে মুশলধারে বৃষ্টি। এত ক্ষণ রাস্তা আটকে অনেক গুলো রিক্সা, সিএনজি স্কুটার ও টেম্পো দাঁড়ানো ছিলো, এদিক সেদিক বিশৃঙ্খল অবস্থায়। কিন্তু বৃষ্টিটা শুরু হতেই সব একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার মতন, বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। মোড়ের ভেতরে দূরে একটি টেম্পো দাঁড়ানো। তাতে যাত্রী উঠছে হুরমুর করে। টেম্পোর দরজা জুড়ে ছোট খাট একটা ভীর; তারপরও কন্ডাক্টর ছোকরা কর্কশ স্বরে ডেকেই যাচ্ছে। এরই মধ্যে আবার বৃষ্টিও বাড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের বেগও। উপায়ান্তর না দেখে ছায়া সেই ভীরের দিকেই দৌড় দিল। এরই মাঝে দেখতে দেখতে টেম্পোর সব গুলো সিটে কানায় কানায় লোকে ভরে গেছে। এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল অতিরিক্ত ওঠা দু’জনের নেমে যাওয়া নিয়ে ছোট খাট একটা বচসা চলছে। লোক দু’জন ভেতরে গিয়ে বসার জায়গা না পেয়ে নেমে যাবার জন্য ছটফট করছে। আর ক'জনা মিলে এই অহেতুক ভীর বাড়াবার জন্য তাদের সমানে বকেই চলছে। তাদেরই এক জনের ফাঁক গলে ছায়া সোজা ভেতরে চলে যায়। আর উঠতে না উঠতেই গিয়ে বসে পড়ে এক জনের কোলের ওপর। এমন বেগতিক অবস্থায় পড়ে লোকটা গেলো ভরকে। তার উপর আবার কিছু বলতে যাবার আগেই উল্টো ছায়াই উঁচু স্বরে বকতে শুরু করে- আপনারা বেটা ছেলে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই আসতে পারবেন ভাই, এই বিপদের মধ্যে আমাকে আগে একটু বসতে দিন প্লিজ ! লোকটা এবার চক্ষু লজ্জায় পড়ে আর দু’জন অতিরিক্ত লোকের সাথে গোবেচারার মত নেমে যায়। লোকটার সাথে আরও একজন ছিলো। সেও তার সঙ্গীর নেমে যাওয়া দেখে তার পিছুনেয়। এই ফাঁকে ভেতরের সবাই আবার একটু একে ওপরের কাছ থেকে সরে হালকা হয়ে বসার সুযোগ পেলো। প্রায় সাথে সাথেই কন্ডাকটরের হাতের ইশারায় ভীর ঠেলে একটা লোক তার ছাতা বন্ধ করতে করতে দ্রুত এসে বসে, ঠিক ছায়ার পাসে। টেম্পো তারও কিছুটা আগেই ছেড়ে দিয়েছে। এখন চলছে প্রায় ফুলস্পিডে। আগে থেকেই সবগুলো পর্দা নামিয়ে দেওয়া। তারপরও থেকে থেকে সামান্য বৃষ্টির ঝাপটা আসছে ভেতরে। কন্ডাকটর ছোড়া দরজায় ঝুলে ভিজছে। আশপাশ ঘোলাটে হয়ে আছে বৃষ্টির ঝাপটায়, কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। আকাশটা ক্রমেই আরও অন্ধকার হয়ে আসছে, বৃষ্টিও বাড়ছে, তাই ভেতরটাও অন্ধকার হয়ে আছে।
এরই মধ্যে বন্ধুদের ছেড়ে আসার জন্য আবারো মনে মনে আফসোস হচ্ছে ছায়ার- ওদের সাথে গেলেই পারতো, থেকে থেকে সে কথাই শুধু ভাবছে সে। এখন তার মনে হচ্ছে এত অল্পে এভাবে রেগে মেগে সব ছেড়ে আসা বোধ হয় এক দমই ঠিক হয়নি, অন্তত নিজের প্ল্যান ...এখন অন্যেরা মজা করবে, আর লাভা লাভের বিচারেও ... মাঝ খান দিয়ে একটা চকবার আর হিট একটা সিনেমা মিস হলো ! না জানি, ওরা এতক্ষণে কত মজাই না করছে ওকে রেখে। ধ্যাত্ ! কেন যে তখন এঁটো কাপটা বাড়িয়ে ধরলো। চকবার খেতে তো একদমই আপত্তি করেনি সে। আর সব আড্ডার সময় ওরা সব সময় চকবারই খায়। কিন্তু মিল্ক বারের ব্যাপারটা আলাদা। এই জিনিসটা খাবার কথা ওদের অনেকেই সবার সামনে জোরেসোরে বলে না। বিশেষ করে সঙ্গে যদি আঁখি থাকে। সব সময় ও একটু অন্য মেয়েদের দিকে কেমন কেমন যেনো তাকায়, আর যখন তখন বাজে কথা বলতেও মুখে ওর একটুও বাঁধে না। তারপর আবার সিনেমা হলের আলো আধাঁরি পরিবেশে ওর পাশে বসা কেউই নিরাপদ বোধ করে না। নিজে একটা মেয়ে হয়ে আর সব মেয়েদের সাথে এধরনের দুষ্টুমি আচরণ ছায়ার মোটেই সহ্য হয় না। আজকে ও না থাকলে ছায়া হয় তো কাপ এবং চকবার এই দু’টার বদলে মিল্কবারই চাইতে পারতো। ছায়ার এই চুপ থাকার মূল কারণই ছিলো আঁখি, ভয়টা আসলে ওকে নিয়েই, স্কুলের কয়েক জন সিনিয়র আপু তো আঁখির সঙ্গে ওর মাখামাখি ভাব দেখে পেছন পেছন খানিকটা শুনিয়ে মাঝে মধ্যেই বলে-‘এসব আঁখিরই কাজ নাকিরে।’ ভয় আঁখির বেখেয়ালি কথাবার্তায়, এই সুযোগে না আবার নিজের গ্রুপের মধ্যেই এ ধরনের বাজে কথা রটে যায়। এই সব সাত পাঁচ ভেবে এক সময় ও সিদ্ধান্তে আসতে পারে আজে যা ঘটেছে তার জন্য আসলে এই আঁখি মেয়েটাই দায়ী, মনে মনে আঁখির আরো হাজারটা দোষ ধরতে ব্যস্ত এখন ছায়া, এরই মধ্যে একজন লোক নামতেই হঠাৎ খেয়াল হয়, এখানেই নামতে হবে, সামান্য দেরি হলে ঠিক জায়গায় নামা হতো না ওর।
এরই মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে, তবু এখনো থেকে থেকে দু’এক ফোঁটা পড়ছে। যে লোকটাকে দেখে একটু আগে টেম্পো থেকে নামার কথা মনে পড়েছিলো ছায়ার, সে এখন ছায়ার খানিকটা সামনে, এবার ছায়া খেয়াল করে, অনেক সুন্দর একটা ছাতা মেলে বৃষ্টির জমে থাকা জল এড়িয়ে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে নিচের দিকে চোখ রেখে হাঁটছে সে। লোকটা কে দেখে একদম একটা কচি খোকার মত মনে হচ্ছে ছায়ার। কেমন ঢং করে হাঁটছে, যেনো একটা ফোঁটা বৃষ্টির-চ্ছটা গায়ে লাগলে এখনই নিউমোনিয়া বা আরো কোন জটিল ব্যাধিতে মারা যাবে। ছায়াও এবার তাকে অনুসরন করে দ্রুত হাটা শুরু করেছে। তাও এই গাধাটাইপের লোকটাকে পিছু ফেলতে পারছেনা। রাস্তার ডুবো অংশ এড়িয়ে হাটতে গিয়ে বরং বেশ কয়েকবার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
কিছু ক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি আবার চরম রূপ নিলো। চারদিকে কেবল ঝম্ ঝম্ শব্দ। খুব অল্প সময়েই ছায়া একেবারে ভিজে একাকার। লোকটাকে আর ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা না করে, যে করেই হোক এবার ধরার চেষ্টা করতে লাগলো সে, কিন্তু এই ভিজে অবস্থায় এখন একটা পুরুষ মানুষের সামনে যাবার মতন স্কুলের ওড়না আর যথেষ্ট নয়। এতো সব সাত পাঁচ ভেবে চিন্তে নিয়েছে কিনা কে বলবে, কিন্তু এরই মধ্যে স্কুল ব্যাগ জড়িয়ে ধরে সে হাটার গতি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আরও কাছাকাছি আসতেই এক সময় লোকটাকে ডাকে-‘ এই যে শুনুন, একটা মেয়ে ভিজছে, সেটা দেখতে পাচ্ছেন না।’ এই বলতে বলতে লোকটার ছাতার তলে ঢুকে গিয়ে বলে, ‘আপনার ছাতায় একটু ভাগ দিতে হবে ভাইয়া’
ছাতা থাকার পরও লোকটা নিজেকে তেমন একটা বাঁচাতে পারেনি বৃষ্টির বেপরোয়া চ্ছটা থেকে। কোন কথা না বলেই সে ছায়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে ছাতাটা। এতে করে সে আরও বেশী ভিজতে শুরু করে।
ছায়ার মেজাজ আজকে অনেক আগে থেকেই খারাপ, তাই বোধ হয় সে ঠিক করেছে তার সব জেদ এই নিরীহ লোকটার ওপর ঢালবে-ছায়া মনে মনে বলছে ‘শালা হুলো বেড়াল এবার হবি ভিজে বেড়াল।’ তার পরপরই হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটা বাড়তেই ছাতার কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেয় ছায়া। এবার লোকটা সত্যি সত্যি ভিজে বেড়াল হয়ে গেলো। এমন সময় ছায়া আবিষ্কার করে লোকটার বয়স আসলে তেমন কিছু বেশী নয়। বড় জোড় ছাব্বিশ সাতাশ হবে। এতোক্ষণ নিজের অজান্তেই ব্যাগের বর্ম সরিয়ে রেখেছিলো। লোকটার বয়স বুঝতে পারার পর, এবার আবার এক হাতে সেটা জড়িয়ে ধরে। এবং আরো দ্রুতবেগে পা চালাতে শুরুকরে।
ভিজে বেড়ালের মুখে এতক্ষণ পর কথা শুনতে পেলো ছায়া।
-‘আপনি আর কত দূর যাবেন ! আমি কিন্তু সামনে গিয়ে ডানে যাবো।’
-‘কি যা তা বলছেন ! আপনি ভিজেছেন বলে আমাকেও আবার ভেজাতে চান নাকি। এতো ভিজলে আমার ভয়ানক জ্বর হবে। ভালো হয়, আপনি আমার সঙ্গে বাসা পর্যন্ত চলুন। এই তো চলে এলাম প্রায়।
একসাথে এতোটা পথ হাটার পর মেয়েটার এমন দৃঢ় অনুরোধটুকু লোকটা ফেলতে পারে না। কথা না বাড়িয়ে এক সঙ্গে পায়ে পায়ে হাটতে থাকে। এভাবে টানা মিনিট খানেক হাটার পর, একটা নীল গেটের কাছে আসার পর, সতর্ক ভঙ্গীতে ছায়া বলে।
-‘আপনি আর আসবেন না, প্লিজ ! এটাই আমাদের বাড়ি, ঠিক আছে, আবার দেখা হবে বাই !’
এই কথা বলে, ছাতা সহ মেয়েটা গেটের ভেতরে সেঁধিয়ে যায়, আর সেই দৃশ্য দেখেই কিনা- সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, লোকটা হতভম্বের মতন তাকিয়েই থাকে। এভাবে ঠিক কতোক্ষণ। অনন্ত কাল, না এক পলক মনে নেই; ছাতার শোকে সে বড় একটা কাতরও নয়। কিন্তু এর পর এই কাক ভেজা লোকটা গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো না ভুলে অন্য কোথাও গেলো সেটা নিয়ে ভাবার সময় কই ছায়ার।
(অন্ধ সেঁকল)
একটা ছাতা বাড়ি বইয়ে আনার জন্য সবার মুখে এমন মেঘ করতে পারে, সেটা ছায়ার ধারনাতেই ছিলো না, নাকি এর পেছনে অদৃশ্য আরও কিছু ঘটেছে ! সেটাও তার জানা হয়ে ওঠেনি। মাস তিনেক আর বাড়ির বাইরেও যাওয়া হয়নি। খুব জরুরি দরকারে বাইরে যেতে হলে সঙ্গে কেউ না কেউ থেকেছে। এমন উটকো পাহারা খুবই অসহ্য। এই ক'দিন তাই জানালা আর বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে যত দূর দেখা গেছে ততটুকুর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো ছায়ার ভুবন। ক'দিন ধরে শুনছে দূরের একটা আবাসিক স্কুলে দেওয়া হবে ওকে। তবুও ওর আচরণে যেনো কোন ভাবান্তর নেই। নারী জন্মের কী এক আজন্ম পাপ এই মুহূর্তে ওকে বিদ্ধ করার অপেক্ষায়, এসবের কিছুই যে তার একেবারেই জানা নেই।
চারতলার বারান্দার বাঁক নেয়া জায়গাটি সবসময় কেমন যেনো অন্ধকার থাকে, এমনকি দিনের বেলাতেও। সেই ডানদিকে বাঁক নেবার পরই আছে একটা সিঁড়ি। তার মুখের খোলা জায়গাটা আরো বেশী অন্ধকার আর নিরিবিলি থাকে সব সময়। সচরাচর তাই আমার সেদিকটাতে যাওয়া হয় না। অন্ধকার আমি বড় বেশী ভয় পাই। একদম ছোট বেলা থেকে রাতভর ভুতের গল্প আর হরর মুভি দেখার অভ্যাস আমার, কিন্তু তারও আগে থেকে অজানা কোন কারণে আমি অন্ধকারকে ভয় পেতে শিখেছি ! তবে এখনকার এই অন্ধকারের ভয় খানিকটা আলাদা। হল ভরা মেয়ে। কেউ কেউ ঘুমোচ্ছে, অনেকে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করছে, কেউবা ঘুমের ভান করছে। ভালো ছাত্রীদের অনেকেই লুকিয়ে চুকিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বইয়ের পাতায় ডুবে আছে। এদের মধ্যে আবার অন্য আরেকটা দলও থকতে পারে, কিন্তু এখন এত আগে তাদের কথা নাইবা বললাম।
বারান্দা দিয়ে হেটে যাবার সময়, তিন তলা আর চার তলার প্রতিটি ঘরে একই রকমের এমন গতানু-গতিগ দৃশ্য চোখে পড়ে। এত মানুষের ভীরে আমার ভুতের ভয় আগের থেকে অনেক কমে এসেছে। তারপর আবার সারা দিন এই একই পথ ধরে হাটতে হাটতে নতুন এই জায়গাটার সঙ্গে আমি নিজেকে অনেক বেশী পরিচিত করে তুলতে পেরেছি, নিজেকে এখানকার নতুন পরিবেশের সাথে অনেকটাই মানিয়ে নিতে পেরেছি। ক’দিন ধরে মনে হচ্ছে রাতে বারান্দার ঘুট ঘুটে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে চোখ বুজেও নিজের কক্ষে পৌঁছাতে সামান্য অসুবিধায় পর্যন্ত পড়তে হবে না আমাকে। কিন্তু কাজটা প্র্যাকটিকেলি করে দেখতে গেলে যে কারো সঙ্গে সামনা সামনি ধাক্কা খাবার চান্স থকেই যায়। আর সেই ধাক্কাটা যদি কোন সিনিয়র আপুর সঙ্গে লাগে- তাহলে পাক্কা ঘন্টাখানেক নিল ডাওন দিয়ে বসিয়ে রাখবে, তার সাথের আরও কয়েক জন এসে বক বক করবে আর বাজে কথা তো আছেই।
তাদের কেউ কেউ আবার আরো কঠিন শাস্তির ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোন ছুঁতায় বারান্দার নিরিবিলি জায়গাটার দিকে নিয়ে যাবে। এমনও হতে পারে টয়লেটের দিকে যাবার জন্য ইঙ্গিত করে বসবে। সেই জায়গাটা আরো বেশী নিরিবিলি ও নিরাপদ, অন্তত তারা যে কাজটা করতে চায় তার জন্যে। তাই বেশীর ভাগ সময় ওরা ওদিকটাতে যাবার ঈশারা ছুড়ে দেয়। তবে খুব ভীরের মাঝেও ওরা অনেক নিরিবিলি জায়গা বের করে নিতে পারে। তাছাড়া কেউ কিছু দেখলেই বা কি আসে যায় ওদের। কেবল টিচার ছাড়া অন্য কাউকেই ওরা তেমন একটা গুনায় ধরে না। রাতের এই সময়টাতে হল সুপার আর আয়ারা নিজ নিজ কোয়ার্টারে চলে যায়। এমন একটা নির্ঝঞ্ঝাট সময়ে তাই পুরো হলটা ওদের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়।
বাঁকের মাথার সিঁড়িটার দিকে প্রথম প্রথম আমি যেতাম না ভুতের ভয়ে। আর এত রাতেও আগে এদিকটায় আসা হয়ে ওঠেনি। তার ওপর আবার আমার বেডপার্টনার অনেক আগেই আমাকে এই সিঁড়ির কথা জানিয়ে রেখেছিলো। এদিকটার এই আলো-আঁধারি পরিবেশে সন্ধ্যার পর হতেই নাকি লাইকারদের আড্ডা বসে। তাই অন্যসব ভালো মেয়েরা সচরাচর এদিকটা এড়িয়ে চলে। পুরাতনেরা নতুনদের অনেক রাখঢাক করে সতর্ক করে। এতে যে রহস্যের জন্ম হয় তাতে করে সবারই আগ্রহ বেড়ে যায় শতগুণ। এই কৌতূহল মেটাতে গিয়ে অনেকেই অকারণ এদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে, এমন ঘটনাও শুনতে পাওয়া যায়।
আয়ারা কিন্তু এই সব লাইকারদের বদলে নাটকীয়তা করে ভুতের গল্প শোনায়। তাদের অনেকেই বলে সিঁড়ির ওদিকটায় নাকি, কি সব দোষ আছে। তাদের সেই একঘেয়ে একই কথা, ‘আপুমনিরা আপনেরা কিন্তু সন্ধ্যার পর উত্তরের সিঁড়ির দিকে কেউ যাইবেন না খবরদার !’ শেষে উত্তমা দিদির পেছনে এই নিয়ে নাছোড়বান্দার মত লেগে থাকায় এক সময় সে জানায়, ‘তুমি মাইয়া নতুন, এতসকালেই এই সব বুঝবানা, ঐ সিঁড়ি দিয়া রাইতের আন্ধারে নামনের সময় বছর দুই আগে কি জানি কি খারাপ জিনিশ দেইখ্যা দুই দুইটা মাইয়্যা পাউ ভাঙ্গছে, সেই যে টিসি নিয়া গ্যাছে, একদিনের জন্যও আর এইদিকে আসে নাই। আজকে তারা থাকলে সব তিনাদের মুখের থনই শুনতে পারতা।’
এধরনের গাঁজাখুরি ঘটনা যে কেবল সেই সিঁড়িটা কে ঘিরে তা কিন্তু নয়। হলের বাথরুম নিয়েও এই পর্যন্ত ডজন খানেক ভুতুড়ে গল্প শুনেছি। সত্যি বলতে কি, এখানে আসার প্রথম দিন থেকেই, আমার কেবলই মনে হচ্ছে বাথরুমের ভেতরে থাকার সময়টুকু- বিশেষ করে গোসলের সময় আমার দিকে কে যেনো চেয়ে থাকে ! কে যেনো কোন গোপন জায়গা থেকে আমাকে দেখে। গোসল আর কাপড় ছাড়তে তাই আমার বড় বেশী ভয়। তার পরও কড়া নিয়ম কানুনের চাপে, গোসল করতে সেখানে যেতেই হয়। একদিন গোসলের সময় সত্যি সত্যি এরকম কিছু একটা আঁচ করতে পারি। গোসল সেরে সবে কাপড় ছাড়তে যাবো, ঠিক এমন সময় কারেন্ট চলে যায়। ঘুলঘুলির ভেতর দিয়ে আসা সামান্য আলোতেই বাদবাকি কাজ সেরে কাপড় চোপড় পড়ি। আলোআঁধারি হাতরে দরজার হুকে হাত বাড়াতেই মনে হয়, কাঠের দরজার ফাঁক গলে কি যেনো একটা কিছু সরে গেলো, মনের ভুল কিনা একথা ভাবারও সুযোগও পেলাম না, কি যেনো এক আতঙ্কে মনের অজান্তেই চিৎকার দিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে আসি। এমন সময় বাথরুমের বাইরে করিডোরে কে যেনো আমাকে দু’হাত দিয়ে পাজাকোলা করে জাপটে ধরে, ভয়ে আমি আরো জোরে চিৎকার দিতে যাবো, কিন্তু পারি না, তার আগেই; ধমক দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করে -‘এই মেয়ে এখনও ভয় কিসের আমি আছি না।’ তখনো আমার ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা, এমন সময় চোখে চোখ পড়তেই আবারো বলল- ‘ কি হয়েছে, এই মেয়ে আমি আছিনা, দেখতে পাচ্ছ না’, আমি তখনো থর থর করে কাঁপছি, বলি- ভয় পেয়েছি, কি যেনো একটা দরজার ফাঁক গলে ভেতরে তাকিয়ে ছিলো, স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি, আমি আর এখানে থাকবো না ! আপু ! সকালেই বাসায় জানাবো, যে করেই হোক আমাকে যত তড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে যাবার জন্য।
-‘কই কোথায় ? চলো তো দেখি ! আই আনু আয় তো আমার সঙ্গে।’ তার ডাক শুনে গোসল খানার পাসের কোঠা থেকে বেরিয়ে অন্য আরেক আপু এগিয়ে আসে। হাতে হারিকেন থাকায় আনুদি’র চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না। কি হয়েছে সামান্য শুনেই সে হারিকেনটা সামনে ধরে খুব সতর্কভাবে যেখানে আমি গোসল করছিলাম সেই জায়গাটা খুঁটিয়ে দেখে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি, যদিও পুরোটা স্বাভাবিক হইনি তখনো। এই আনুদি’ আমাদের ড্রিলের নেতৃত্ব দেন। নতুন বলে তার নেক নজরের কারণেই তখন পর্যন্ত আমাকে ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে ড্রিলে যেতে হতো না। কিন্তু এখন অন্য আরেক কারণে এই আনুদি’ নামটি আমার কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে যাচ্ছে।
-‘এই মেয়ে এদিকে এসো, এই শেফালি ওকে ধরে ভেতরে নিয়ে আয়, ভয়টা কাটিয়ে দেওয়া দরকার, যা শীঘ্রই লবণ পানি নিয়ে আয়, এক গ্লাস।
-‘তোর টার্গেট, তুই বসে লবণ পানি খাওয়া আর যত খুশি ইচ্ছামত ভয় কাটা, আমার ডাইনিং এ যাবার সময় হলো।’
এই বলে সাই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেফালি দি’ চলে গেলো।
-‘এই অবেলায় কেন গোসল করতে এসেছো, তোমার মেটরা সব কই, এমন ভয় পেলে এর পর থেকে আর একলা আসার দরকার নেই, কাউকে না পেলে অন্তত আমাকে ডাকবে বুঝেছো।’
এতোসব বলতে বলতে আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো-‘কই দেখি ভিজেছে কিনা।’
এই কথা শুনে সরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই খট করে দরজা বন্ধের শব্দ পাই।
আনুদি’ নানান ছুঁতায় শুধু নিচের দিকেই হাত বাড়াচ্ছে, আর ফিসফিস করে বলছে ভয়ে সব ভিজিয়ে ফেলেছ কিনা আগে দেখি। তার পরপরই সোজা হাত গলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে ইস্ ! এত বড় মেয়ে কাণ্ডজ্ঞানের মাথা খেয়েছো। এই অবস্থায় রুমে ফেরা ঠিক হবে না তোমার, নাও আবার গোসল করে ফ্রেস হও আগে। আমি আবারো বাঁধা দেবার চেষ্টা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল, আচ্ছা তুমি ঠিক মতন দাঁড়িয়ে থাক, আমিই গোসল করিয়ে দিচ্ছি, বলেই যত্রতত্র হাত চালাতে থাকে।
-‘বুঝলে জায়গাটা কিন্তু আসলেই ভালো না। গতবছর অক্টোবরে নতুন আসা একটা মেয়ে, এই এখানটাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলো। তারপর সেই মেয়ে কোনদিনই একা এদিকটা মাড়ায়নি। অন্যরাও কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসে। মাঝে মধ্যেই এমন হয়; কেউ চোখ দেখে, কেউবা কান্নার আওয়াজ অথবা বিদঘুটে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। এখান থেকেই মনে হয় অনেক মেয়ের ওপর আলগা দোষ ভল করেছে, এই অবস্থায় ওদের অনেকেই বাড়ি ফিরে গেছে। তবে মনে রেখ আমি আর শেফালি দি’ থাকতে তোমার কোন ভয় নেই, লক্ষ্মীটি। ঘৃণা আর দুঃখে গা আমার রি্ রি্ করতে শুরু করেছে। মুখের লালা গরম হয়ে আসছে। আনুদি’ অনেক কসরত করে আমার গায় পানি ঢালছে। নিজ হাতে শরীর ডলে দিচ্ছে। এরই মধ্যে এক সময় কারেন্ট চলে এলো। আনুদি’র জ্বল জ্বল দৃষ্টি তখন আমার দিকে। মুখে হাত গুজে তিনি একদম থ !
-‘হা ! কিরে এত বড় ! কয়জনে ধরেছে বল ? নাকি সব সময় তুই এই দু'টো নিয়ে খেলা করিস।’
প্রতিবাদ করার ভঙ্গিতে আমি বললাম, -‘আমার অল্পেই হয়, বেশী ক্ষণ ধরে থাকার দরকার হয় না। -এই হঠাৎ হাত দিয়ে ঘোষলে ...।’
এই কথা বলতেই কিযে হলো, আনুদি’ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন বলে মনে হলো। আমাকে নিবির করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘এই খবরদার একদম মিথ্যে বলবি না কিন্তু।’ তারপর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে জানতে চান, ‘বাড়িতে তোরা কে কে।’
আমি বলি, ‘আব্বা আমা আর আমার পিঠাপিঠি বড় ভাই, নানু আর ছোট ভাই।’ –--‘টিউটর ছিলো না কখনো ?
-‘না অনেক আগে ছিলো।’
–‘হারামজাদি ! বাড়িতে কার সঙ্গে কী করেছিস ঠিক ঠিক বল, এমনি এমনি কি আর এখানে পাঠিয়েছে তোকে ! এই জেলখানায় ! দাঁড়া জিন্দেগির মতন আজকে তোর ভয় কাটিয়ে দেই !’
তারপর আনুদি’ এমন সব বাড়াবাড়ি শুরু করে দিলো যে আর বাঁধাদিয়ে রাখতে পারলাম না।
কিছুক্ষণ পর বারান্দা দিয়ে হাঁটছি। আমরা দুজন সমান গতিতে যার যার রুমের দিকে এগুচ্ছি। আমার মাথা নিচু হয়ে আছে। জানি কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না, তাহলেই অকারণ ভয়ানক সব শাস্তি আর নিল ডাওন। পাশাপাশি হাটার সময় সে পড়াশোনার ব্যাপারে সিরিয়াস কয়টা কথা বললেন, আমার লেখাপড়ার বিষয়ে টুকটাক জেনেও নিলেন। এমন ভাব যেনো একটু আগে আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। ক্লাসের সেকেন্ড গার্ল, খুব ভালো ছাত্রী হবে হয় তো, সেই সুবাদেই টিচারদের সঙ্গে উনার খুব ভালো সম্পর্ক।
-‘এই মেয়ে অঙ্ক ভালো না বুঝলে আমার কাছে এসো। ভলো হ্যান্ড নোটও আছে। চার তলার বা' দিকের তের নম্বর রুম। তোমার বেড পার্টনার কে বললে চিনিয়ে দিবে। ও আর শেফালি কিন্তু লাইকার বুঝলে। ওকে একদম ঘাটাবে না। শেফালির কানে গেলে সে তখন তোমার খবর করে ছাড়বে, বুঝেছ !’
আমি মাথা দোলাই। আনুদি’ আরো জোর গলায় বলেন,
‘শোন এখন থেকে কেউ তোমার লাইকার হতে চেয়ে চিঠি দিলে আমাকে দেখিয়ে তারপর উত্তর দেব। ইউ আর মাই ফাস্ট বুক ! একথা ওদের কারো জানতে বাকি নেই ! হ্যাঁ, ঠিক আছে !’
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় আমাদের সামনে দিয়ে কয়েকটা মেয়ে হেটে গেলো। তাই দেখে ওদের কাছে স্বাভাবিকভাবে নিজেকে তুলে ধরার জন্যই, সে আবার কথা ঘুরিয়ে বলতে লাগলো,
-‘না না এতে ভয় পাবার তেমন কিছু নেই, তোমার ভয় কাটাবার জন্য এতোসব আজগুবি গল্প গুলো শোনালাম তোমাকে। কিন্তু আজকের ভুয়া ভুতের গল্প কিন্তু কাউকে শোনাতে যেও না আবার।’
তারপর ওরা দূরে চলে যেতেই আবার কঠিন স্বরে বলতে লাগলো, - এই কথা কাউকে ভুলেও বলতে যেওনা, হেড মিসের কাছে বিচার গেলে তুমি নিজেই সাংঘাতিক ফেঁসে যাবে। কড়া রোদে ড্রিল আর ডাইনিংএর রান্না করা... পারবে এতসব কঠিন কাজ। আর শোন বাসায় যাচ্ছ কবে ?’
পাশের জানালা থেকে আসা মৃদু আলো গায়ে পরতেই নিজের দিকে ঈশারা করে, গলা থকে ওড়না এক ঝলকে সরিয়ে –‘এসব কিনে নিয়ে আসবে। ছোকরা টিচার গুলো কেমন কুনজরে তাকিয়ে থাকে সেদিকে খেয়াল করেছ।’
একথা বলতে বলতেই আমার রুমের সামনে এসে পৌঁছাই। দরজার সামনে এসে আমি আপনি দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার দাঁড়ানো দেখে আনুদি’ও দাঁড়িয়ে একথা সেকথা বলতে বলতে এক সময় আমাকে ভেতরে যাবার ঈশারা করে সামনের দিকে সোজা হাটা শুরু করে, এভাবে কিছু দূর এগিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে, হেসে একটা ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিয়ে বলেন,
-‘বাই !’
http://www.sohrabsumon.me/?p=188
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৫০