আমার মায়ের একটা চোখ ছিলো। আমি তাকে ঘৃণা করতাম আর তাকে নিয়ে আমি বিব্রত ছিলাম। আমার মায়ের ছোট একটা পুরান পোষাকের দোকান ছিলো আর সেই দোকানের উপার্জন দিয়েই আমাদের চলতো।
আমার স্কুলের একটা বিশেষ দিন। দিনটি আর দশটা দিন থেকে আলাদা ছিল, কারণ; এই দিনটাতে স্কুলের ছেলেমেয়েরা উৎসবে মেতে উঠতো। সেই দিন আমার মা আমার স্কুলে আসলো আর আমি তার এক চোখের জন্য খুবই বিব্রত বোধ করতে লাগলাম। ‘সে এটা কিভাবে পারলো?’ এই চিন্তা করে আমি তার দিকে ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকালাম আর বের হয়ে আসলাম। পরের দিন স্কুলে সকল ছেলে মেয়েরা বললোঃ ‘তোমার মায়ের মাত্র একটা চোখ?’। আমার মনে হলো তারা আমার দিকে খুবই ঘৃণার আর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
মাঝে মাঝে মনে হতো, ‘মা টা যদি মরেও যেত!’। আমি একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মা, তোমার অন্য চোখটি নেই কেন? তুমি আমাকে আমার বন্ধুদের কাছে হাসি আর অবজ্ঞার পাত্র বানাচ্ছো। তুমি কেন মরে যাওনা?’ কোন জবাব দেইনি মা। আমার একটু খারাপ লাগলেও এই ভেবে শান্তি পেলাম যে, যা এত দিন ধরে বলতে চেয়েছিলাম তা’ তো বলতে পারলাম। এর কারণ হতে পারে যে আমার মা আমাকে কখনোই শাস্তি দেইনি, কিন্তু আমি ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে আমি তাকে আঘাত দিয়েছি।
সেই রাতে আমি ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানির জন্য রান্না ঘরে গেলাম আর দেখলাম আমার মা সেখানে কাঁদছে; গুমরিয়ে, পাছে আমি ঘুম থেকে উঠে পড়ি! তার দিকে একবার তাকিয়ে আমি আবার ফিরে এলাম। সেদিন যা বলেছিলাম তার জন্য একটু মন খারাপ করতে লাগলো। কিন্তু তার এক চোখের জন্য তার প্রতি আমার ঘৃণা একটুও কমেনি। তারপর, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি বড় হয়ে যে কোন উপায়ে সফল হবো, কারণ; আমি আমি আমার একচোখা মা আর আমাদের এই তীব্র দারিদ্রকে প্রচন্ড ঘৃণা করতাম।
তারপর আমি সত্যিই সত্যিই অনেক কঠোর পড়াশুনা করতে লাগলাম, সিউল শহরে আসলাম আর নিজের প্রচেষ্টার দ্বারা সিউল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তার বেশ কিছুদিন পর আমি ভালো উপার্জন করতে শুরু করলাম আর একটা বাড়িও কিনলাম। আমি বিয়ে করলাম আর আমার সন্তান পৃথিবীতে আসলো। স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে সিউলে এখন আমার সুখের সংসার। সিউলের এই বাড়িটি খুব পছন্দ করি কারণ, এখানে আমার একচোখা মায়ের কথা একদমই মনে পড়ে না।
আমার সুখ বাড়তেই থাকলো। আর, তারপর একদিন সেই অনাকাংখিত ঘটনাটি ঘটলো। আমার মা সিউলে আসলো; তার এক চোখ নিয়ে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো; আমার ছোট্ট মেয়েটি ভয়ে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। আর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম; ‘কে তুমি? কেন তুমি এখানে এসেছো? কত বড় সাহস যে তুমি আমার বাড়িতে এসে আমার মেয়েকে ভয় দেখাও?’ আমার মা শান্ত ভাবে জবাব দিলো, ‘আমি দুঃখিত, আমি সম্ভবত ভুল ঠিকানায় এসেছি’। আর তারপর সে চলে গেল। ‘থ্যাঙ্ক গড! সে আমাকে চিনতে পারেনি’ ভাবলাম আমি। মনে হলো সত্যিই মুক্তি পেলাম।
এর অনেক পর একদিন আমার স্কুল থেকে Re-union সম্পর্কিত একটা চিঠি পেলাম। আমার স্ত্রীর কাছে ব্যাবসার কাজে যাওয়ার নামে মিথ্যা বলে আমি সেই রি-ইউনিয়নে যোগ দিলাম। রি-ইউনিয়ন শেষ হলে এক বিশেষ কৌতুহলবশতঃ আমার সেই জ্বীর্ন-শীর্ণ বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, আমার মা তার শীর্ণ ঘরের মধ্যে নিশ্চল পড়ে আছে। এতে আমার একটুও কান্না পেলোনা। তার হাতে এক টুকরো কাগজ দেখতে পেলাম। সেটি ছিলো মুলতঃ আমাকে লেখা তার একটা চিঠি।
মা লিখেছে,
‘বাবা,
আমার মনে হয় জীবনের দীর্ঘ সময় আমি পার করেছি। এবং আমি আর কখনোই সিউলে যাবোনা। এটা আশা করা কি খুব বেশি হবে যে, তুমি একটি বারের জন্য আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দেখে যাও? আমি তোমাকে খুব মিস করি বাবা। যখন শুনলাম যে তুমি রি-ইউনিয়নে আসছো, আমি খুবই শান্তি পেলাম যে এবার বোধহয় তোমাকে দেখতে পাবো। কিন্তু তোমার জন্য আমি সেখানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি সত্যিই দুঃখিত যে আমার মাত্র একটা চোখ।
যখন তুমি খুব ছোট ছিলে, একটা দূর্ঘটনায় তুমি তোমার একটা চোখ হারাও। মা হয়ে আমি তোমার একটি চোখ হারিয়ে বড় হওয়ার সহ্য করতে পারিনি আর তাই আমার একটা তোমাকে দেই। আমি খুবই গর্ববোধ করতে লাগলাম যে আমার ছেলে আমার চোখ দিয়ে এই পৃথিবীকে নতুন করে দেখতে পাচ্ছে। আমি কখনো তোমার কোন কাজে কষ্ট পাইনি। যখনই তুমি আমার উপর রাগ করেছো, ভেবেছি; আমাকে ভালোবাসো বলেই তা করেছো। আমি সেই সময়গুলো খুব মিস করি যখন তুমি ছোট ছিলে আর ভয় পেলে আমার কাছে ছুটে আসতে।
তোমারে খুব মিস করি বাবা। তোমারে অনেক ভালোবাসি। তুমিই আমার পৃথিবী’।
আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। সারা জীবন আমার এই মাকে আমি ঘৃণা করে এসেছি যে শুধুমাত্র আমার জন্য বেঁচে ছিলো। আমার এই পাপের কোন প্রায়শ্চিত্য নেই.......
[ মাগো! তোমরা এত গ্রেট কেন মা?]
(অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। লেখাটির ইংরেজি ভার্সন আমার এক বন্ধু আমাকে মেইল করে পাঠিয়েছে। আমাকে প্রচন্ড ছুঁয়ে যাবার কারণে বাংলায় অনুবাদ করে ব্লগে শেয়ার করলাম। আগে কেউ অন্য কোথাও দেখে থাকলে দোষাবেন না আশা করি। সোর্স লিঙ্কটি জানা না থাকায় এখানে দেয়া সম্ভব হলোনা।)