তরুণ বয়সে ছেলে-মেয়েদের পথচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। এই সময়টাতেই আবেগের আবেশ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের একুল-ওকুল দু’কুল। সবধরণের অপরাধ প্রবণতা বা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তীব্র আকর্ষন তৈরি হয় এই বয়সটাতে। এই সময়ে যদি তারা সঠিক সাংস্কৃতিক চর্চায় নিজেদের ব্যাস্ত রাখে, তাহলে তাদের পদস্খলনের সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে প্রকৃত সুশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। উপন্যাস, আরো elaborately বলতে গেলে সাহিত্য, হলো সমাজের দর্পন। এটার মাধ্যমে আপনি সমাজ সম্পর্কে জানতে পারবেন। সমাজের কিছু ভুল বা Follies তুলে ধরে তার জন্য কিছু সাজেশানমুলক নির্দেশনাও আপনি পাবেন এই উপন্যাসে বা সাহিত্যে। আমি উপন্যাসে কথা বলছি এই কারণে যে আমাদের তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে বর্তমানে সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাটি হচ্ছে উপন্যাস। উপন্যাস পঠন মানুষকে সাংস্কৃতিক করে তোলে, অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখে, উপন্যাসের মাধ্যমে ভালোকে গ্রহন আর মন্দকে বর্জন করতে শেখে এর পাঠকেরা।
আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মুহুর্তে বাংলাদেশের সেরা বা ১ নম্বর উপন্যাসিক কে? আপনি চোখবুঝে যার নাম বলবেন, তিনি হলে হুমায়ুন আহমেদ। বাংলা উপন্যাস পাঠকদের কাছে বিশেষতঃ তরুণদের কাছে হুমায়ুন আহমেদ এক জনপ্রিয় নাম। ‘শংখনীল কারাগার’ বা ‘সূর্যের দিনবাড়ী’র মত বিখ্যাত উপন্যাস লিখে তিনি একেবারে তারকা বনে গেছেন।
কিছুদিন আগে এক পত্রিকার রিপোর্টে জেনেছিলাম, বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগল সার্চে গিয়ে আপনি যদি কোন বাংলা শব্দ লিখতে শুরু করেন তাহলে গুগল সাজেশান হিসেবে যে সমস্ত শব্দাবলী দেখাবে, তা’ আপনাকে রীতিমত বিব্রতকর পরিস্থিতে ফেলে দেবে। যেমন, ‘সে’ লিখলে কী ভেসে উঠবে তা’ সহজেই আপনার অনুমেয়। অথচ আপনি হয়তো লিখতে চেয়েছিলেন ‘সেকাল’, ‘সেবা’ অথবা ‘সেতু’। আর আপনি যদি ‘বাংলা চটি’ লিখে সার্চ দিয়ে থাকেন, তাহলে যা আসবে তা বলতে আমি অপারগ।
ভাবছেন, সাহিত্যের আলোচনা করতে করতে আমি হঠাৎ এই জাতীয় শব্দাবলীর আলোচনা শুরু করলাম কেন? সম্প্রতি আমি আমাদের দেশের সেই জনপ্রিয় উপন্যাসিকের ২০১০ সালের বই মেলায় প্রকাশিত একটি উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। উপন্যাসটির নাম হচ্ছে ‘শুভ্র গেছে বনে’। আমার কাছে বইটির ২০১০ বইমেলার চতুর্থ মুদ্রণটি রয়েছে। যাইহোক, এই বইটি পড়ার পরে আমি সত্যিই অবাক হলাম আর ভাবলাম, গুগলে ‘বাংলা চটি’ লিখে সার্চ দিলে যা আসে আর এই উপন্যাসের মধ্যে আদৌ কি কোন পার্থক্য আছে? আমাদের তরুণ সমাজের কী শেখার আছে এই উপন্যাস থেকে? আমাদের তরুণ সমাজ কি তথাকথিত ‘আকাশ সংস্কৃতি’ নামক এই ভালগারিজম থেকে মুক্তির দিশা পাবে এই উপন্যাস থেকে? এই উপন্যাস পড়ে আমাদের তরুণ সমাজ কি সত্যিই সঠিক ট্র্যাকে চলবে? অন্যায় থেকে দূরে থাকবে? অপসংস্কৃতি থেকে দূরে থাকবে? নাকি ....................................... । শুন্যস্থান পূরনের দায়িত্বটা আমি আপনাকেই দিলাম।
আমার উপরোক্ত কথাগুলো কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নয় যদি না আপনি এই উপন্যাসটি পড়ে থাকেন। আপনাদের জ্ঞাতার্থে আমি এর বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েকটি লাইন পৃষ্ঠা নম্বরসহ উদ্ধৃত করছিঃ
নীপাঃ সফিক ভাই আমাকে মডেল করে ছবি আঁকতে চায়, রাজি হবো?
যুথীঃ তুই নেংটু হয়ে থাকবি, সফিক ভাই ছবি আঁকবেন—এরকম?
নীপাঃ প্রায় সেরকম। (১৪)
করিম আংকেলের বয়স ষাট। তিনি বিপত্মীক। তিনি তার রুপবতী প্রাইভেট সেক্রেটারী যমুনাকে নিয়ে এসেছেন। যমুনার বয়স ২৩/২৪। সে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ করেছে ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটি থেকে। যমুনার সঙ্গে তিনি এখন লিভ টুগেদার করছেন। করিম আংকেল অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গ পছন্দ করেন। মেয়েরাও তাঁর সঙ্গ পছন্দ করে। (১৫)
> ভেরী গুড। পৃথিবীর সৌন্দর্য্য মাত্র দু’টি জায়গায়। ‘আলো ছায়ার খেলাতে আর নারীদেহে’। কার কথা জানো?
>মনে হচ্ছে আপনার নিজের। (১৬)
ছবি কিছু হয়নি। দামি ক্যানভাস নষ্ট করেছো। রঙ নষ্ট করেছো। সবচেয়ে খারাপ এঁকেছো Nude ছবিটা। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল থেকে এসেছে। তার সারা শরীরে দুর্ভিক্ষের ছাপ । শুধু তার পশ্চাৎভাগ দুর্ভিক্ষমুক্ত। প্রোটিনের অভাবে রুগ্ন এক নারী বিশাল পাছা নিয়ে শুয়ে আছে। এইসব ছবি মডেল দেখে আঁকতে হয়। (১৭)
করিম আংকেল বললেন, দশটি প্রধান আনন্দ কী তোমরা জানো?
নীপা বলল, আমরা কিছুই জানিনা। আপনি কী জানেন বলুন।
করিম আংকেল বললেন, আনন্দের তালিকায় প্রথমে আছে sex । মুখ চাওয়া-চাওয়ি করার কিছু নেই। যেটা সত্যি সেটা বলতে হবে। এখন তোমরা বলো দ্বিতীয় প্রধান আনন্দ কী?
নীপা বলল, গান শোনা?
করিম আংকেল বললেন, হয় নি। দ্বিতীয় প্রধান আনন্দও হলো sex । তৃতীয়ও তাই। চতুর্থ হচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গ। ..... (১৮)
যুথী বলল, তুই কি বস্ত্র পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছিস?
নীপা বাথরুম থেকে বলল, মোটামুটি সেরকমই। মনে হয় কাপড়ে এলার্জি হচ্ছে। কাপড় গায়ে লাগলে হালকা র্যা শের মতো হয়।
>লাইলীরও কি একই অবস্থা?
>নীপা হাসতে হাসতে বলল, হুঁ।
>আমার ভাইয়ের স্ত্রীর তাহলে অনেক উন্নতি হয়েছে!
নীপা বলল, পুরো বিষয়টা দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করছে। প্রাইমারি স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেবের দৃষ্টিতে চরম অবনতি। আবার করিম আংকেলের দৃষ্টিতে উন্নতি। (১০৮-১০৯)
এই হলো বেশ কয়েকটি নমুনা।
সাহিত্য যদি সমাজ থেকে পাপ আর অন্যায়কে বিদূরিতে করতে না পারে, তাহলে সেই সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? সাহিত্য হতে হয় জীবনবোধসম্পন্ন। ভালো আর মন্দের পার্থক্য করে যে উপন্যাস বিরচিত হয়, কেবল সেই সাহিত্যই হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ আর সমাজে চলার পাথেয়। আমাদের হুমায়ুন আহমেদরা কি আমাদের কোমলমতি তরুণদের হাতে সেই ভালো-মন্দের বিভেদ সৃষ্টিকারী, কালোত্তীর্ণ, জীবনবোধসম্পন্ন উপন্যাস তুলে দিতে পারছেন?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১০ রাত ১১:২১