খদ্দের কেন পতিত নয়?
পতিতা শব্দটির সাথে ঘোর আপত্তি আছে আমার। যদি এই শব্দটার পুংলিঙ্গ থাকত তাহলে হয়তো এতটা আপত্তি থাকত না। কিন্তু পতিতারা যাদের কল্যানে পতিত তারা উচ্চতায় থেকে যান পুরুষ হওয়ার গৌরবে। আজকাল এই শব্দটা ব্যবহারে অনেক সচেতন মহল বা মানবাধিকার কর্মীরা আপত্তি তোলায় অনেকে যেন দয়া করে শব্দটা ব্যবহার করেন না। তবে বেশীর ভাগ মানুষ যারা এই কথিত পতিত শ্রেণীর মানুষকে অবলম্বন করে বাচেঁন তারাই আবার শব্দটাকে কচলায়ে কচলায়ে তিতা তুলে খান। আজও অনেক শিক্ষিত(!) নামধারী মানুষ ও অনেক পত্রিকায় পতিতা শব্দটিকে ব্যবহার করে মশালাদার শব্দ হিসেবে। কিন্তু কখনও এমন দাবী শোনা যায় না যে নারী পেটের দায়ে বা সমাজের রক্তচক্ষুর শিকার হয়ে এমন জীবন বেছে নেয় তারা পতিতা কেন? বরং যারা বা যে পুরুষ লালসার বশবতি হয়ে বা বিকৃত যৌনাচারে আদিষ্ট হয়ে পতিতা বানায় তারাই পতিত!
সমাজ কতটা নারী বান্ধব তা সহজেই অনুমান করা যায় ঘটনা থেকে! নারীরাই যেন সকল মন্দের আধার। পতিতার যেমন পুংলিঙ্গ নেই, নেই বেশ্যা শব্দটারও। একজন পুরুষ শত বেশ্যার সাথে শুইলেও বেশ্যা হয় না। একজন নারীকে খুব সহজেই পতিতা আখ্যা দেয়া যায়। যখন খবর হয় “পতিতার সাথে খদ্দেরের বিয়ে!” এই বিশ্ময়সুচক খবরটি যেন অসম্ভব বেমানান কিছু ঘটে যাওয়া। অবশ্য মনুষ্য যোগ্যতার বিচারে সেই পতিত মেয়েটি যাকে পরিবার,সমাজ, রাষ্ট যৌনকর্মী বানিয়েছে তার সমান যোগ্যতা সেই খদ্দেরের নেই! তবুও তাকে শুধু খদ্দের বলে সম্মানিত করা হয়, পতিত বলা হয় না।
যৌনকর্মীরা যে কতটা বাধ্য হয়ে এই পেশায় জড়িয়ে পড়ে তা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে তাদের নিয়ে একটা গবেষণা কাজের সুযোগে। ”সেক্সুয়ালিটি, হেলথ এন্ড দ্য মিডিয়া” নামের একটা ওয়ার্কশপ শেষে সেক্সওয়ার্করদের নিয়ে একটা গবেষনা কাজ করতে হয় আমাকে। বিভিন্ন মানের ও মুল্যের যৌনকর্মীদের সাথে খোলা মেলা কথা বলতে হয়। শুরুতে আমার মনে হয়েছিল আমি হয়তো একজনকেও খুঁেজ পাব না যিনি এই পেশায় থেকে কথা বলতে রাজি হবেন। তাছাড়া কে এই পেশায় আছেন তাকেই বা কিভাবে সনাক্ত করব? পাছে কাউকে এমন প্রশ্ন করে তার হাতে লাঞ্চিত হই এমন ভয়ও ছিল। তবুও কাজটা যখন করার দায়িত্ব নিয়েছি এবার খুঁজতে থাকলাম কোন সংগঠন তাদের নিয়ে কাজ করে কিনা বা তাদের কোন সংগঠন আছে কিনা । খুঁজেও পেলাম একশন এইড বাংলাদেশ এর ফান্ডে কুড়িগ্রামে স্থানীয় এনজিও সলিডারিটি যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য ও সচেতনতা নিয়ে কিছু কাজ করে। যাই হোক সলিডারিটির ফিল্ড স্টাফকে ভরসা করে তার কাছ থেকে তালিকা গুলো সংগ্রহ করলাম। একা তাদের সাথে দেখা না করে সেই ফিল্ড স্টাফের সাথে পর পর ২ দিন গ্রুপে গিয়ে আলোচনা শুনলাম। সলিডারিটির এই গ্রুপ গুলোতে ভাসমান যৌনকর্মীরা সদস্য হয়। তারা আলোচনা অংশ নিয়ে যে সময় দেয় তার জন্য পারিশ্রমিক দাবী করে। আমাকে কোন অতিরিক্ত সময় দিতে রাজি হয় না তারা। আমি কয়েকজনের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে কখন সময় দিতে পারবেন শুনে বাসায় যাই। এ কাজে আমি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের সহায়তা নেই। তাদের বাড়িতে যেতে যেতে বিভিন্ন বয়সী অনেক পুরুষ রাস্তায় দাড়িয়ে টিপ্পুনি কাটে, শিষ দেয়, আড়চোখে তাকায়। এসব কিছু কাটিয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছুলেই সমস্যা শেষ হয় না। অনেক গল্প করে কথা বলে বলে যৌনকর্মীদের আস্থা অর্জন করার পর তারা একে একে বলে যায় তাদের যৌনকর্মী হওয়ার কাহিনী। কি ভয়ংকর, কতটা বিভৎস রোমহর্ষক সেই কাহিনী! কত পুলিশকে কতভাবে কর দিতে হয় তাদের উপার্জনের! কারা কারা তাদের খদ্দের! বাপ-বেটা- নাতি কেউই বাদ যায় না! অপরাজিতা দলের সভাপতি রাবেয়া (ছদ্মনাম) বললেন, যে সমাজ আমাদের কাজকে অন্যায্য বলে আমাদের ঘৃণা করে সেই সমাজের সমাজপতিরাও আমাদের কাছে আসে গোপনে। শেফালী (ছদ্মনাম) বললেন, আমাদের মিটিং করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের ঘরটি চাইলে চেয়ারম্যান দিতে চায় না। অথচ চেয়ারম্যান নিজের দরকারে চলে আসে অথবা ডেকে পাঠায়। যারা প্রকাশ্যে আমাদের ঘৃণা করে তারাই ভালবাসার কাঙ্গাল হলে আমাদের কাছে আসে।”
একবার এক উচু দরের যৌনকর্মীর সাথে পরিচয় হয় ট্রেনে। চেন্নাই থেকে কোলকাতা ফিরছিলাম চিকিৎসা শেষে। পাশের সিটে সেই মেয়েটি। কামরায় মাত্র ২ জন ছাড়া সবাই অবাঙালী। লম্বা ভ্রমন প্রায় ২ দিন ২ রাত। খুব খাতির হল মেয়েটির সাথে। একসময় মেয়েটি নিজেই নিজের পরিচয় দিল যৌনকর্মী হিসেবে। শিক্ষিত ও সুন্দরী মেয়েটি। নাম রোশনাই। আমি যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করি জেনে খোলাখুলি বললেন অনেক কথা। কিভাবে এই কাজে এলেন, কেন? বললেন বাবা-মার অমতে পালিয়ে সোহরাব নামের মুসলিম এক ছেলেকে বিয়ে করেই ফেসে যান তিনি। বেকার সোহরাব এমন এক বাসায় নিয়ে তাকে তোলেন সেটা একটা ছেলেদের মেস । একটা রুমে রোশনাই সারাদিন দরজা আটকিয়ে থাকতেন। বাবা-মা খুঁেজ পেলে ধরে নিয়ে যাবেন এই ভয়ে ঘর থেকে বের হননি অনেকদিন। কিন্তু দুজনই বেকার, খাবেন কি? এক সময় সোহরাবও তাকে ফেলে চলে যায়। এই সুযোগে মেস এর অন্য পুরুষরা তাকে সহমর্মিতা দেখাতে ঘরে আসতে থাকে। বাধ্য হয়ে একদিন রোশনাই বাবা-মার বাড়িতে ফিরে গেলেন। কিন্তু বাবা মা তাকে বাড়িতে গ্রহন করে নাই। এবার দুরসম্পর্কের এক বোনের বাসায় আশ্রয় মিলল তার। দুুলাভাই নিজের অফিসে চাকুরী দেবে এমন প্রতিশ্রুতিতে। সেখান থেকেই শুরু। অনেক চাকুরী আর অনেক হাত বদল হতে হয়েছে তাকে। যে কাজেই যেখানেই কোন পুরুষের পাশাপাশি হতে হয়েছে সেখানেই তাকে খুশি করতে হয়েছে সেই পুরুষকে। কোথাও কোন কাজের মূল্যায়ন হয়নি শরীর ছাড়া। অবশেষে তিনি সেটাকেই পুঁিজ করে ব্যবসা করছেন। বললেন, যৌনতার চাহিদা আছে বলে ব্যবসা হয়। যারা টাকা দিয়ে কিনে তারা কেন ভাল হবে? জীবনে কত রকমের পুরুষ দেখেছি। অনেকে বউকে সন্দেহ করেই বেশ্যা বলে গাল দেয় । আর নিজে হাজার হাজার টাকা ওড়ায় এই কাজে।
সালেহা ইয়াসমীন লাইলী
লেখক ও সাংবাদিক