somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোটার কাঠগড়ায় আমার সন্তান

২০ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধে যাননি, কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাসহ ভারতে যাওয়ার পথের শরণার্থীদের খাবার দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। সেবা করেছেন। সারাদিন নদীপথে পাক-বাহিনী ঢুকতে পারে বলে নদীর উত্তর তীরের চরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বাংকার খুঁড়েছেন। বালুর বস্তা সাজিয়ে দিয়েছেন। পাক-বাহিনীর অবস্থান জানতে বিভিন্ন স্থান থেকে খবর এনে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। এর বেশী কোন পরিচয় তার কাছে বড় ছিল না। তাই পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হওয়ার সময় তিনি খুঁজে খুঁজে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্তি করতে সহায়তা করেছেন, যাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাদ না পড়ে। যদিও তিনি নিজেই দেখেছেন অনেকে যুদ্ধে না গিয়ে বা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে পালিয়ে থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন ! যারা বিভিন্ন সময়ে বানিয়ে বানিয়ে অনেক সম্মুখ সমরের গল্প করে সার্টিফিকেটের মান বাড়ায়!

মুক্তিযুদ্ধের সময় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী মুক্তাঞ্চল ছিল। ধরলা নদীবেষ্টিত এই অঞ্চলে পাক-সেনাবাহিনী প্রবেশ করার কোন সুযোগ পায়নি। অবিভক্ত ভূ-খন্ড নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী থেকে পাকবাহিনী ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আবার নদীপথেও প্রবেশ করার সাহস পায়নি। সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় আমাদের বাড়িটা ছিল শরণার্থীদের জিরিয়ে নেয়ার একটা আশ্রয়। সব কথাই আমার বাবার মুখে শোনা।

আমার সন্তান সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে আমাকে বলে, ‘আমার দাদা মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা গেছেন, আর আমার বাবা ছোট থাকায় মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি। আমার নানা কেন একটা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেননি। শুনেছি কতজন তো এমন সার্টিফিকেট নিয়ে আজ রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধা নিচ্ছে, আমার অনেক সহপাঠী আজ এমন সুযোগ পেল, আর আমি ভাল রেজাল্ট করেও তা পারছি না’।
কথা ঘুরিয়ে আমার জবাব দিতে হলো এভাবে, ‘ভাল রেজাল্ট করা ও ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারা মানেই ভাল মানুষ হওয়া নয়। ভাল মানুষ হও, সব পেয়ে যাবে’। সে আমার কথা কতটা বুঝতে পারল আমি বুঝতে পারলাম না। আমিই বা কতটুকু বুঝে কথাটা বললাম নিজেই কি বুঝতে পারছি!

আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নই বলে আমাদের কোন বিশেষ কোটা হয়নি উচ্চতর ক্লাসে ভর্তি হতে বা চাকুরী পেতে। অনেক কম মেধা সম্পন্ন বা ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রটিও সরকারী চাকুরী পেয়েছে কোটা সুবিধায়। তাদের জন্য আমরা মনে মনে আহ্লাদিত হয়েছি এই ভেবে যে মুক্তিযোদ্ধাদের মুল্যায়ন হয়েছে। যদিও আজো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে রিকশা চালাতে দেখি। ভিক্ষা করছে শুনতে পাই। পানের দোকান দিয়ে পেট চালায়। তাদের জন্য আজো মাথা হেট হয়, সম্মানিত না করতে পারার অপরাধ রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজের কাঁধে তুলে নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশিত দেশ না পাওয়ার বেদনার কথা তাঁরা বলতে বলতে যখন তাঁদের চোখের কোণে জল চিক চিক করে উঠে, আমার বুকেও ব্যর্থতার বেদনা কাঁটা হয়ে বিঁধে। কণ্ঠ বুঁজে আসে। কথা থামিয়ে দেই। এর বেশী কি করার আছে আমার?

সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিবার নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়। আবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অনেক সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদও পড়ে। এই রাজনৈতিক খেলা আমাদের আহত করে। কিন্তু আমরা এখানেও দর্শকের ভুমিকায় থাকি মাত্র।

সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের চাকুরি দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিয়ে সম্মানিত করেছে। দেশবাসী সাধারণ মানুষ (যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নন), তারা সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছে। কিন্তু যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সন্তানদের (নাতি-নাতনী) এই কোটার অন্তর্ভুক্ত করেছে তখন এই সাধারণ মানুষই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। কারণ এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ও নাতি-নাতনি সহ ৩০/৪০ জনও এই কোটার আওতায় পড়েছে। তাতে সত্যিকার মেধাবীরা চাকুরি থেকে নিঃসন্দেহে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা আমার সন্তানকে আমি কিভাবে বোঝাবো? আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়া বা সার্টিফিকেট না থাকার দায় কেন আমার সন্তানকে বহন করতে হয়? যখন তারা দেখে তাদের ক্লাসের পিছনের সারিতে বসা আর সারা জীবন ভাল রেজাল্ট করেও শুধুমাত্র কোটার ফাঁদে আটকে যায় তাদের চাকুরী বা ভর্তি, তখন তারা দেশটার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। পাড়ি জমাতে চায় ভিন্ন কোন দেশে।

এভাবে কোটা পদ্ধতির বেড়াজালে আটকা পড়ে দেশ মেধা শূন্য হয়ে পড়বে। তাই কোটা পদ্ধতির সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার আরো অনেক উপায় আছে। সরকারের উচিত দেশের স্বার্থে তেমন উপায়গুলো খুঁজে বাস্তবায়ন করা।

প্রধানমন্ত্রী ভিডিও চিত্র দেখে কোটা বাতিলের আন্দোলনকারীদের চাকুরী না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তার কথাগুলো সব সাধারণ চাকুরী প্রার্থীর কাছে পৌঁছে গেছে। আন্দোলনে মুষ্টিমেয় যারা ছিল তারা না হয় চাকুরী বঞ্চিত হবে। ক্রোধে ফুঁসে প্রতিশোধ নেবে ব্যালটে, কিন্তু যারা আন্দোলনে অংশ না নিয়ে মনের মাঝে দেশের প্রতি অনাস্থার আন্দোলন রোপন করে চলেছে তারা কি এই আন্দোলনকে সমর্থন দেবে না? এই ক্রোধ আমাদের কোন পথে নেবে আমি জানি না। কারণ আমাদের এই সরকার মন্দের ভাল হয়ে টিকে থাক, অন্য কোন অপশন যে আমাদের হাতে নেই!
লেখক: সালেহা ইয়াসমীন লাইলী, লেখক ও সাংবাদিক
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×