কুড়িগ্রাম-০৫-০৩-২০১
হয়তো বউ অপেক্ষা করে প্রতিদিনের সূর্যের দিকে তাকিয়ে দিন গুনে, রাতের আধাঁরের দিকে তাকিয়ে রাত গুনে। ছেলে-মেয়েরাও অনাহারে- অর্ধাহারে দিনমান পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝাপসা হতে দেখে রোজ দিগন্তের ছায়া। হয়তো, ছানি পড়া চোখে বৃদ্ধা মা অন্য কারো ছেলের চিবুক ছুঁইয়ে আদর করতে করতে বলে, ‘বাবা তুই এত দিন পড়ে এলি? তোর তো এক মাস আগেই আসার কথা ছিল। রোজ রাতে ঘরের চালে বাদুরটার ডানা ঝাপটানোর শব্দে, ভোর বেলা কাকের ডাক শুনলে আমার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। তুই না হয় সবার মতো কথা বলতে পারিস না, বুঝতে তো পারিস! তোর বউ, তোর ছেলে মেয়ে, আমি তোর বুড়া মা তোর চিন্তা কত করছি। কেন এত দেরী করলি?’ পরক্ষণে ভুল ভেঙ্গে গেলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে অজানা আশংখায়। সেই কান্নায় যোগ দেয় তার আত্মার আত্মীয় ,বউ ছেলেমেয়েরা।
গ্রামের আর সবাই কাজ শেষে দল বেধে চলে এসেছে কতদিন আগে, আর এই একজন মানুষ কোথায় গেল? ছেলেমেয়ে, বউ, বৃদ্ধা মা সবাই যারা এসেছে তাদের কাছে গিয়ে খবর জানতে চেয়েছে, পায়নি কোন জবাব। বেচে আছে না মরে গেছে তাও বলতে পারেনি কেউ । বলবেই বা কিভাবে? কাজের অভাবে বউ,ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গ্রামের অন্য দিনমজুরদের সাথে তিনিও গিয়েছিলেন কাজে। যাওয়ার সময় প্রতিবেশীর কাছ থেকে কিছু কর্জ নিয়ে বউয়ের হাতে কয়টা টাকা ধরিয়ে দিয়ে গেছেন। বউটা চিন্তিত মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে চোখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি কথা বলতে পারেন না, হারিয়ে গেলে কোন ঠিকানা বলতে পারবেন না। তখন বাড়িতে ফিরবেন কিভাবে? বাদ দেন দুরের কাজে যাওয়া। আমরা না খেয়ে মরলেও ছেলেমেয়ে নিয়ে অন্তত একসাথে মরতে পারবো।’ তিনি মুখে কাষ্ট হাসি টেনে ইশারায় বলেছিলেন, ‘কথা বলতে না পারলেও গায়ে তো শক্তি আছে। সেই শক্তি নিয়ে না খেয়ে কেন মরতে হবে? যে কোন কাম- কাজ করতে পারব। গ্রামে কাম কাজ নাই, কয়দিন বাইরে খেটে এলে ছেলে মেয়েদের জন্য কাপড় চোপড়, বউকে দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল তোমার পরনের শাড়িটাও ছিঁড়ে গেছে। আর বৃদ্ধা মাকে কতক্ষণ না খাইয়ে রাখি। খুব জলদি চলে আসব। গ্রামের অনেকের সাথে যাচ্ছি তো, সমস্যা হলে তারা তো আছে।’ যাওয়ার সময় শুধু মাকে দোয়া করতে বলে হন হন করে চলে গেছেন পিছনে না ফিরে।
বউয়ের আশঙ্খা আজ সত্যি হয়েছে। তিনি হারিয়ে ফেলেছেন সঙ্গিদের। আর কথা বলতে না পারায় হারিয়ে ফেলেছেন নিজের ঠিকানা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মা ও নিজের নামটাও। তিনি পথ ভুলে চলে এসেছেন কুড়িগ্রামের যাত্রাপুরে। এখানে তিনি খেয়াঘাট এলাকায় ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন ২২ দিন ধরে। মানুষের কাছে গিয়ে ইশারায় বলছেন কোন এক ব্রিজের পাশেই তার বাড়ি। নিজের নাম বলতে ও লিখতেও না জানায় কেউ তার কোন ঠিকানার হদিস দিতে পারছে না।
বউ, আপনাকে দেয়া কথা মতো তিনি রঙিন ডুরে কাটা শাড়ি একখান কিনেছেন, ৪/৫ বছরের একটি মেয়ে শিশুর ফুল ছাপার ফ্রকও কিনেছেন, ৭/৮ বছরের এক ছেলে শিশুর নীল গেঞ্জীও একটা তার পুটলীতে। বাড়িতে ধার দেনা হয়েছে বলে তার পুটলির ভিতর থেকে ১৭০০ টাকা সবাইকে দেখিয়ে কান্না কাটি করছেন বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ঘাটে বসা এক বৃদ্ধা ভিখারিনিকে মা বলে ডেকে নিজের মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছেন । কিন্তু কিভাবে তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া যাবে? তার কান্না, তার ডাক কি পৌছুতে পারবে তার স্বজনদের কাছে?
#
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১২ রাত ৮:৪৭