আজ ফের যাচ্ছি জয়পুর। এটি জয়পুর শহরে ঢোকার একটি ছবি।
আজমির থেকে যখন রওনা দিলাম তখন বেশ গরম। গাড়ির ভেতরে এসি ছেড়ে দিলেও বেশ তাপ লাগছে। চওড়া রাস্তা বেয়ে, দুপাশের ধুধু মাঠ পেরিয়ে দূরে পাহাড়ের সারি দেখতে দেখতে আমরা চল্লাম জয়পুরের দিকে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ৩০০ রুপি রিচার্জ করলাম। কিন্তু সেই ৩০০ রুপি ভারতে থাকা অবধি আমার ফোনে ঢুকলো না। বুঝলাম ঠক খেয়েছি। রামজিকে বলতেই ও আবারো গাড়ি ঘুরিয়ে ঐ দোকানে যেতে চাইলো। আমি নিষেধ করলাম। সময় নষ্ট হবে বলে।
১২.৩০ নাগাদ আমরা জয়পুর পৌছলাম। পিঙ্ক সিটি বলে খ্যত জয়পুর। আগে হোটেলে যাব নাকি কোন দর্শনীয় স্থান দেখবো, ভাবতে লাগলাম। হোটেলে গেলে তো ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে সময় লেগে যাবে। তাই আর হোটেলে গেলাম না। সরাসরি হাওয়া মহল এর সামনে এসে দাড়ালাম।
(হাওয়া মহল এর বাইরের কিছু ছবি)
(হাওয়া মহল এর ছবি)
বিল্ডিং গুলো সেই পুরানো আমলের। তার উপর মেটে রং করা। একারণেই এই শহরকে সবাই পিঙ্ক সিটি বলে। ভেভরে ঢুকলাম ভারতীয় হিসাবে টিকিট কেটে। সিড়ি ভেঙে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠতে হয়। বিল্ডিংটার মূল বৈশিষ্ট্য হলো ছোট ছোট অসংখ্য জানালা রয়েছে। সবুজ রং করা কাঠের পাল্লার সব জানালা। গরমে আজ ঘুরাঘুরি করে স্বাদ পাচ্ছি না। পুাই গ্রীষ্মের গরম বলে মনে হচ্ছে। তার উপরে টানা ৬/৭ দিন তো চলছি এক রকম ভাবে। নাওয়া খাওয়ারও ঠিক নেই। আর কতো? তাই ঘোরাঘুরি সংক্ষেপ করার মন মানসিকতা নিয়েই ঘুরলাম। অনেক দেশী বিদেশী পর্যটক এখানে চোখে পড়লো।
(রাজা মানসিং)
এর পাশেই রয়েছে সিটি মহল। রাজা মান সিংয়ের প্রাসাদ। হাওয়া মহল দেখা শেষ করে হাটতে হাটতে গেলাম সিটি মহল। দেখি বিদেশীদের জন্য এন্ট্রি ফী অনেক বেশী আর বেশ কড়াকড়ি। মেয়ের মা কে বল্লাম চলো ফিরে যাই। আর কি দেখবো? সবই তো ঐ রাজা রাজড়াদের প্রাসাদ! একই রকম সব। সে বল্লো আসছি যখন তখন দেখেই যাই। তুমি চুপ চাপ ভারতীয়দের লাইনে দাড়াও। দেখো কি হয়। আমি লাইনে দাড়ালাম। টপাটপ টিকেটও সংগ্রহ করে ফেল্লাম। নাচতে নাচতে চলে এলাম বউয়ের কাছে। সেও মুখ টিপে হাসলো। লাইনে দাড়ালাম সিটি মহলে ঢোকার জন্য। অনেক বিদেশী ট্যুরিষ্টে এলাকা গরম। চেক পোষ্টে বেশ ভীড়! আমার মেয়ে কি যেনো বলতে চাচ্ছিলো। আমি ওর কানের কাছে ফিস ফিস করে বল্লাম এখন কোন কথা বলো না। আগে ভেতরে ঢুকি তারপর বলো। কারণ হাতে ভারতীয় টিকেট, বাংলায় কথা বলছি, তাও আবার বাংলাদেশী টোনে! যদি ভ্যজাল হয়!
(সিটি মহল)
(রুপার ঢাম্বুস সাইজের মটকা)
তবে নিরাপদেই পাশ দিয়ে ঢুকে গেলাম। সিটি মহল ঘুরে ঘুরে দেখলাম। রুপার তৈরী সর্ব বৃহৎ দুটি মটকা দেখলাম এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। ঐ দেওয়ানে আম, দেওয়ানে খাস, বসত ভিটা ..... এসবই আরকি! এসব দেখে গরমে আর ভালো লাগছিলো না। বের হয়ে আসলাম। বাইরে বের হয়েই দেখি যন্তর মন্তর এ ঢোকার লম্বা লাইন। আমাদের আর সেই লাইনে দাড়ানোর ইচ্ছা বা শক্তি কোনটাই হলো না। রামজিকে ডাকলাম। প্রখর রোদে গাড়ি পার্কিং থেকে বের করতেও সময় লাগলো।
(সিটি মহলের ভিতরের কিছু ছবি)
ওকে সাথে নিয়ে লাঞ্চ সারলাম। বিকালে হাওয়া মহলের ওখানেই কিছু দোকানে ঘুরাঘুরি করলাম। ওখান থেকে আমাদের হোটেল একটু দূরে ছিলো। হোটেলে যখন পৌছাই তখন সন্ধ্যা ৭ টা। হোটেলে বুকিং সংক্রান্ত যে ঝামেলাটি ছিলো সেটা মিটে গেলো সহজেই। আমরা তিন দিনের জন্য রুম বুকিং রাখলেও ওরা আামদের থেকে এক রাতর ভাড়াই রাখলো। এটা একটা প্রশংসনীয় বিষয়। রামজি বল্লো ওর পরিচিত একটি হোটেল আছে, যেখানে খাওয়ার সাথে রাজস্থানি নাচ দেখানো হয়। আমর যেতে চাইলে সে নিয়ে যাবে। আমরাও রাজী হলাম। রুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়েই রাত ৮.৩০ টার দিকে ওকে সাথে নিয়ে বের হলাম।
একটু ব্যস্ত শহর মনে হলো জয়পুর। কারণ রাস্তায় বেশ ট্রাফিক জ্যাম পেলাম। রাজস্থানি নাচ আর রাতের খাওয়া সেরে যখন হোটেলে আসলাম, রাত তখন প্রায় ১১টা। আগামী কাল সকালে আম্বার ফোর্ট আর জল মহল দেখে দিল্লী ফিরে যাব। সকাল সকাল উঠতে হবে। শুয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে বুফে ব্রেক ফাষ্ট সেরে ৮টার মধ্যেই হোটেল ছেড়ে দিলাম। কারণ গতকাল রামজি বলেছিলো আম্বর ফোর্টে সকাল সকাল না গেলে গাড়ি পর্কিং করার জায়গা পাওয়া যাবে না। তখন অনেক দূরে গাড়ি রেখে হাটতে হবে বহু দূর। তাই আমরা সকাল সকালই রওনা দিয়ে দিলাম। জল মহল হাতের ডানে রেখে এগিয়ে গেলাম আম্বের ফোর্টের দিকে।
(আম্বর ফোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা.......)
পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছে পাথরে বাধানো রাস্তা। দূর থেকেই বোঝা যায় সেই সময় কতটা সুরক্ষিত ভাবে গড়ে তোলা হয়েছিলো সেই দূর্গ। পাহাড়ের পাদদেশে গাড়ি পার্ক করে অনেকে হাতির পিঠে চড়ে আম্বর ফোর্টের বিশাল চত্বরে এসে নামছে। বেশীর ভাগ ইউরোপীয়ানদেরকে দেখলাম তারা হাতীর পিঠে চড়াটাকে বেশ উপভোগ করছে। আমরা অবশ্য হাতির পিঠে চড়িনি। রামজী পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পার্কিং এ চলে গেলো।
(হাতির পিঠে সাওয়ার পর্যটক...)
(আম্বর ফোর্টে সকালের মনোরম পবিবেশ)
(এখানে হাতি এসে সবাইকে নামিয়ে দেয়....)
সকালের স্নিগ্ধ মনোরম কোমল আলো আর বাতাসে সেই পাহাড়, নীল আকাশ, হিম হিম ঠান্ডা বাতাস...... সত্যিই খুব ভালো লাগলো। অপূর্ব সে দৃশ্য। একটি রাজস্থানি পাগড়ি কিনলাম। একজন গাইড নিলাম। সেই সব টিকেট কেটে আনলো ভেতরে ঢোকার। ঘুরে ঘুরে দেখলাম রাজা রানীদের থাকার জায়গা। প্রাসাদ মূলত সবই এক, তারপরেও এই প্রাসাদটিকে অন্যরমক ভালো লাগলো। বিশেষ করে কাচের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে কারুকাজ খচিত একটি ঘর! তার সম্পূর্ণ ছাদটাও কাঁচের টুকরা দিয়ে সাজানো। রাজা রানী যখন এখানে বসে গল্প করতেন রাতের বেলা তখন নিচে মোমবাতি বা প্রদীপ জালানো হতো, তখন সেই প্রদীপের আলো ছাদে বসানো শত শত কাঁচের আয়নার টুকরায় প্রতিফলিত হতো। তখন মনে হতো ঘরের ভেতরেই লক্ষ লক্ষ তারা ঝিকমিক করছে। রাজা রানী এখানে বসে তাদের সময় কাটাতো। অদ্ভুত চিন্তাশিল্প !! আম্বার ফোর্টের দেয়ালে যে নক্শা, তাতেও রয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ভেজিটেবল বা ভেষজ উপাদান দিয়ে কালার করা সব নক্শা যা এখনো তেমনই আছে।
(কাঁচের নকশা করা সেই বিনোদনখানা .....)
(ভেষজ রং দিয়ে করা নক্শা.....)
রাজা মানসিংয়ের নাকি বারো জন রানী ছিলো। প্রত্যেক রানীর জন্য আলাদা আলাদ থাকার ঘর ছিলো ঠিকই। তবে এক রানীর ঘর দিয়ে আর এক রানীর ঘরে প্রবেশ করার কোন পথ ছিলো না। প্রাসাদের মাঝখানে একটি বড় খোলা মেলা জায়গা আছে। সেখানে রানীগন এসে গল্প গুজব আড্ডা তামাশা করতেন। কিন্তু কেউ যেনো কারো সাথে আলাদা ভাবে কোন গুটি করতে না পারে, তাই কারোর ঘরের সাথে কারোর ঘরের সংযোগ ছিলো না!! প্রাসাদের উপরে চার কোনায় চারটি পরিদর্শন কক্ষ দেখলাম। নিরাপত্তা কর্মীরা সেখানে থেকে পাহারা দিতো। যদিও প্রাসাদের চারিপাশ বিশাল পরিখা খনন করা, তারপরেও সব সময়ের জন্য নজরদারীর ব্যবস্থা ছিলো। আসলেই আম্বরফোর্ট দেখার মতোই একটি প্যালেস। আশে পাশে আরো কিছু ফোর্ট আছে। কিন্তু আমরা আর সেখানে গেলাম না।
(মহলের চার পাশের দৃশ্য , ভেতরের উদ্যান)
(এই নকশা দেখেই রানীরা তাদের গহনা তৈরীর নির্দেশ দিতেন এবং এই পালকিতে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন)
দেখতে দেখতে প্রায় ঘন্টা খানেক পার করলাম। গাইড আবার আমাদেরকে নিচে সরকারী দোকানে নিয়ে গেলো। সেখানে প্রাকৃতিক উপায়ে কিভাবে কাপড় রং করা হয়, সেটা দেখলাম। এখানে শাড়ি কাপড় জুুয়েলারী জুতা স্যান্ডেল অনেক কিছু্ই বিক্রি হচ্ছে দেখলাম, সরকারের নির্ধারিত দরে। এক জোড়া উটের চামড়ার জুতা খুব পছন্দ হলো।
(এই কড়াইতে বাঁদিদের জন্য রান্না হতো)
(আম্বার ফোর্ট)
সেই দোকান থেকে আবারো পাহাড় বেয়ে উপরে উঠলাম। কারণ পার্কিং এ যেতে হলে এভাবেই যেতে হবে। আবার পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। রামজিকে ফোন দিলাম, বল্লো নিচে নামার রাস্তাতেই তাকে পাওয়া যাবে। পেয়েও গেলাম। আবহাওয়া এখন বেশ গরম হতে শুরু করেছে। সকালের সেই মিষ্টি মিষ্টি ভাব আর নেই, তাই দ্রুত গাড়িতে বসে এসি ছেড়ে দিলাম।
(জল মহল)
এবার জল মহল দেখে রওনা দিবো দিল্লীর পথে। জল মহলটি রাস্তার পাশেই। বিশাল এক দিঘীর মাঝস্থানে একটি রাজবাড়ি। রাজা মানসিং নৌকায় চড়ে ঐ প্রাসাদে যেতেন। পানির নিচেও কক্ষ আছে। ওখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে পনিপুরি, ভেলপুরি, বাদাম কুলফি খেতে খেতে কাঠ ফাটা রোদে উক্ত স্থানের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। তারপর রওনা দিলাম দিল্লীর উদ্দেশ্যে। তখন প্রায় ১.৩০টা বাজে। গাড়ি চলছে তো চলছেই। রাস্তাতে কোন যান জট পাইনি। দুপুরে একটি ধাবাতে লাঞ্চ সেরে নিলাম। আমরা গুড়গাও হয়ে দিল্লীতে যাচ্ছি। এসেছিলাম আগ্রা হয়ে।
(ভেলপুরি আর বাদাম কুলফি ...সেইরকম স্বাদ .... )
(বিদায় বেলা জয়পুর ....)
দিল্লীতে ঢুকতে বেশ জ্যাম পার হতে হলো। রাত আনুমানিক ৮টার দিকে দিল্লীর হোটেলে পৌছালাম। প্রথম দিন এই হোটেলে এসে যে রুমে উঠেছিলাম, সেটি ফাকা ছিলো না, তাই অন্য আরেকটি রুমে উঠলাম। রুমটি ভালো। ভোর ৫টায় দিল্লী এয়ারপোর্টেও উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। কারণ ৭.৫০ এ জেট এয়ারে কলকাত ফিরবো। তাই এই রাতেই হোটেলে আলাপ করে ট্যাক্সি ঠিক করে রাখলাম। রামজি যেতে পারবে না, কারণ আগামী কাল সে আবারো অন্য ট্যুরিষ্ট নিয়ে আগ্রা যাবে। এই কদিনে রামজির সাথে আমাদের বেশ ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরী হয়েছিলো। খারাপ লাগলো যখন ওনাকে বিদায় দিলাম। আমার মেয়েকে সে বলেছিলো, তুমি আমার কাছে থাকো, তোমাকে আচ্ছা আচ্ছা খানা খিলাউঙ্গা, ইয়ে মেরা ওয়াদা !! তার কথা শুনে রবি ঠাকুরের কাবলী ওয়ালার কথা মনে পড়েছিলো আমার .....!!
হোটেলের ক্যটারিং এ সেই মান্নানকে রাতের খাবারের জন্য অর্ডার করলাম। খেয়ে দেয়ে দ্রুত শুয়ে পড়লাম, মাথায় টেনশন সেই কাক ডাকারও আগে উঠতে হবে, গান্ধীজি এয়ারপোর্টের ৩নং টার্মিনাল ধরতে হবে আমাদের!! গন্তব্য- কলকাতা!!