মহাবিশ্ব সৃষ্টি সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার শুরু হয় সেই
আদিকাল থেকেই। মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য ভেদ
করার প্রয়োজনে মানুষকে জানতে হয়েছে
আপেক্ষিক তত্ত্ব, ন্যানোপার্টিক্যাল, কেন্দ্রিক
পর্দাথবিজ্ঞান ইত্যাদি। তবুও এ মহাবিশ্বের
সৃষ্টিরহস্যের কিংবদন্তি আমরা পুরোপুরি উদ্ধার
করতে পারি নি। না পারার যথেষ্ট কারণ আছে।
মহাবিশ্বের সূচনা থেকে এই আপনি যখন এ
আর্টিকেলটি পড়ছেন এ মোট সময়কে যদি আপনি
একটি দিন হিসেবে সূচিত করেন তবে মানবসভ্যতার
ঊষালগ্ন হচ্ছে রাত এগারোটা বেজে উনষাট মিনিট
উনষাট সেকেন্ড। অর্থাৎ মহাবিশ্বের বয়স যদি ২৩
ঘণ্টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড হয় তবে মানবসভ্যতার
বয়স ১ সেকেন্ড।সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশপ উসার
হিসাব করে বলেছিলেন মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল
৪০০০খ্রিষ্টপুর্বাব্দে। কিন্তু এডউইন হাবল বলেছেন
আজ থেকে ১৫০০-২০০০ হাজার কওটি বছর আগে
মহাবিশ্বের আকৃতি ছিল ডিম্বাকার। তার মানে
তারও অনেক আগে এ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল।
আসলে মহাবিশ্বের প্রকৃত অনুমিত বয়স
১৩.৭৯৮±০.০৩৭বিলিয়ন বছর। নাহ আসলেই সংখ্যাটা
প্রকৃতভাবে অনুধাবন করা কল্পনাতীত। এ বিশাল
সময়ের ফারাক থেকে সহজেই বুঝা যায় আসলে শুরুটা
কিভাবে হয়েছিলো তা অনুসন্ধান করার মাঝেও
অনেক ঘাটতি থেকে যাবে। তবুও মানুষ অনেক দূর
এগিয়েছে।
এই সিরিজের প্রথম পর্বে আমরা শুধু মহাবিশ্বের
সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করব।
মহাবিশ্বের আকৃতিঃ প্রথমেই বলেছি এডউইন
হাবলের কাছ থেকে জানা যায় ১৫০০ থেকে ২০০০
বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্ব ডিম্বাকার ছিল। কিন্তু
পরের অবস্থা অনেকটা ভিন্নতর। ১৯৬৫ সালে
আমেরিকার নিউজার্সিতে বেল টেলিফোন
ল্যাবরেটরিতে আর্নো পেঞ্জিয়াস (Arno Penzias)
আর রবার্ট উইলসন নতুন মাইক্রোওয়েভ এন্টেনা দিয়ে
পরীক্ষা করে দেখেন যে, একটা অদ্ভুত তরঙ্গ
চারদিক থেকে আসছে তাও আবার সমান হারে।
তাঁরা বুঝলেন এটা হলো মহাবিস্ফোরণের ফলে
আলোর তরঙ্গ সরণের ফলে লাল পেরিয়ে
মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে পরিণত হবার ফল। তাদের এই
আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে তারা
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও প্রসারণ সংকোচন তত্ত্বঃ
বিগব্যাংঃ ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল এর
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ তত্ত্ব থেকে মহাবিশ্বের
সৃষ্টিরহস্যের অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। পুরো
মহাবিশ্ব একটি অসীম ভরের ক্ষুদ্র ডিম্বাকার কণার
ভেতরে আবদ্ধ ছিল। যাকে বলা হয় সুপার এটোম।
সুপার এটম হচ্ছে এমন কণা যেটাতে অসীম ঘনত্বের
অসীম ভরের বস্তু আছে। কণাটির ভিতরের পদার্থসমূহ
অত্যন্ত অস্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। একসময়
অভ্যন্তরীণ শক্তির ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে এই
বিস্ফোরণের ফলেই সৃষ্টি হয় আমাদের এই মহাবিশ্ব।
এটাই বিগ ব্যাং থিওরি নামে অধিক পরিচিত।
এখান থেকেই সময়,স্থান,শক্তি,পদার্থের উৎপত্তি
বলে ধারণা করা হয়।বিগ ব্যাঙ্গের ফলে সৃষ্ট
খণ্ডাংশগুলোর বিভিন্ন রূপ যেমন-
গ্রহ,উপগ্রহ,নক্ষত্র,ধুমকেতু, উল্কা ইত্যাদি নাম নিয়ে
প্রতিনিয়ত নির্দিষ্ট হারে দুরে সরে যাচ্ছে। দুরে
সরতে সরতে এগুলো একসময় শেষ সীমায় পৌঁছে
যাবে। এর অর্থ হলো নীহারিকাগুলো পরস্পর থেকে
দুরে সরে যাচ্ছে। যার দূরত্ব যত বেশি তার ব্দুরে সরে
যাওয়ার হারও তত বেশি।
বিগক্রাঞ্চঃ অন্য একটি তত্ত্ব মতে প্রসারণের শেষ
সীমায় পৌঁছে যাওয়ার পর নীহারিকাগুলো দুরে
সরে না গিয়ে বরং পরস্পরের কাছাকাছি চলে
আস্তে আসতে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে ঘনীভূত হবে।অর্থাত
বিগ ব্যাং এর ঠিক বিপরীত ব্যাপার টুকু ঘটবে।
আবার বিগ ক্রাঞ্চ তত্ত্বের সমাপ্তিই হলো
বিগব্যাঙয়ের সূচনা। এভাবেই বিগব্যাং ও বিগ
ক্রাঞ্চ পর্যায়ক্রমিকভাবে সঙ্ঘটিত হয়। একে
পালসার থিওরি বলে।
বিস্ফোরণের পরবর্তী অবস্থায় তাপমাত্রার ক্রম
পরিবর্তন ও প্রথম পরমাণুর সৃষ্টিঃ
বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের দুর সীমানায় পর্যবেক্ষন
করে দেখতে পান যে, এই মহাবিশ্ব প্লাজমা
অবস্থায় অর্থাৎ অস্বচ্ছ বা অর্ধস্বচ্ছ আয়নিত গ্যাসে
পরিপুর্ন ছিল।পরোক্ষ হিসাবে দেখা গেছে যে,
মহাবিস্ফোরণের ১০-৪৩ সেকেন্ড পর মহাবিশ্বের
তাপমাত্রা ছিল ১০^৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং
ঘনত্ব পানির ঘনত্বের ১০ টু ১০ গুণ। মহাবিস্ফোরনের
এক সেকেন্ডের শতভাগের এক ভাগফ সময়ে মহাবিশ্ব
পরিপুর্ন ছিল বিকিরণ নিউট্রিনো এবং ইলেকট্রন
পজিট্রন যুগলে।তাপমাত্রা তখনো এসব হাল্কা
পদার্থ ও প্রতিপদার্থের কণিকাযুগল সৃষ্টির জন্য
প্রয়োজনীয় শক্তি যোগান দিতে সক্ষম ছিল। প্রায়
দুই সেকেন্ড পর মহাবিশ্ব এতটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল
যে, ইলেকট্রন পজিট্রন যুগল আর নতুন করে সৃষ্টি হতে
পারল না। এবং ক্রমাগত ধ্বংস হয়ে এরা রূপ নিল
শক্তিতে। অল্প সংখ্যক ইলেকট্রন শুধু থাকল ধনাত্মক
প্রোটন কণিকার চার্জের ভারসাম্য রক্ষার জন্যে।
বিকিরণ এখন শুধু প্রাধান্য পেল সমস্ত জগত জুড়ে
প্রোটন, নিউট্রন বা ইলেকট্রনের জন্য প্রায়
শতকোটি আলোক কণিকা। অর্থাৎ ফোটন কণা
বিরাজ করছিল তখন সারা মহাবিশ্ব জুড়ে। এরপর
মহাবিশ্বের তাপমাত্রা তার বয়োবৃদ্ধির সাথে
সাথে হ্রাস পেতে লাগল। উচ্চ শক্তির ফোটন সংখ্যা
হ্রাস পেতে থাকে। ফলে ইলেকট্রন আর পজিট্রন
মিলে যে পরিমাণ ফোটন তৈরী করে, সেই হারে
ফোটন থেকে ইলেকট্রন পজিট্রনযুগল তৈরী করতে
পারে না। মহাবিস্ফোরণের তিন মিনিটের মাথায়
প্রোটন ও নিউট্রন মিলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস
তৈরী করতে থাকে। আরও দেখা যায়
মহাবিস্ফোরণের মাত্র দশলক্ষ বছর পরেই
মহাবিশ্বের অতি ঘনীভূত উতপ্ত বিকিরণ ও কণিকার
পিণ্ড তাপ হারিয়ে ৩০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে
নেমে এসেছে। আর এই তাপমাত্রায় এসেই
ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথ
নিয়ে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণু সৃষ্টি করতে
শুরু করেছে। এ সময় বায়ু ও বিকিরণ ভারসাম্য লাভ
করে একটি সুষম তাপমাত্রায় নেমে এসেছে।
পরবর্তি পর্বে হিলিয়াম থেকে অন্য পরমাণু সৃষ্টি ও
মহাবিশ্বের পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
কৃতজ্ঞতাঃ ১। ডঃ আমির হোসেন খান।
২।প্রফেসর মোহাম্মদ ইসহাক।
৩।ডঃ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
৪। উইকিপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৫ সকাল ৮:২১