সামাজিকভাবে বহিষ্কৃত, অবহেলিত, প্রান্তিক আর প্রায়শই সহিংসতার শিকার বাংলাদেশের লিঙ্গান্তরী নাগরিকরা এমন একটি দিনের স্বপ্ন দেখেন যখন তাদের অস্তিত্ব কেবল সহ্যই করা হবে না, তাদের ব্যক্তিপরিচয়টাও উদযাপন করা হবে। তাদের সংগ্রাম এমন একটি মৌলিক অধিকারকে সমর্থন করে যা বেশিরভাগ অলিঙ্গান্তরীরা জন্মগতভাবেই পেয়ে আসছে: স্ব-অনুভূত আত্মপরিচয়ের অধিকার। লিঙ্গান্তরী বাংলাদেশীদের জন্য, প্রতিটি দিন এই বঞ্চনার স্মারক। লিঙ্গান্তরীদের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়াটা আমাদের এই সময়ের পরিত্যক্ততা, অমানবিকতা আর নির্যাতনের ‘কালো অধ্যায়'।
আর এই নিপীড়ন মূলত ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের ক্ষত থেকে হওয়া দাগ। উনিক শতকের প্রাক ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃতপক্ষে রাজকীয় আসর এবং নৃত্য, নাট্যকলা ইত্যাদিতে লিঙ্গান্তরবাদের এক ইতিহাসসমৃদ্ধ ঐতিহ্যের মাধ্যমে হিজড়াদের সামাজিকভাবে স্বীকৃতি ও ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করা হতো। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে, 'ফৌজদারি উপজাতি আইন, ১৮৭১' (Criminal Tribes Act, 1871) সমাজের সেসব সদস্যদের 'বিপথগামী/বিকৃত' পরিচয়ের কারণে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে।
আমি এযাতব যেসব লিঙ্গান্তরী বাংলাদেশীদের সাথে কথা বলেছি, তাদের অধিকাংশই এমন একটি দেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন যেখানে কার্যত লিঙ্গবৈচিত্র্য এবং লিঙ্গতারল্যতার কোনো ধারণাই জনসাধারণের নেই। প্রায় প্রত্যেকেই খুব ছোটবেলা থেকেই এক অচেনা অন্যকারো শরীরের 'ফাঁদে আটকা' পড়ার অনুভব বোধ করে আসছেন। যেন লুকিয়ে থাকা আর প্রতিরোধের উপায় হিসেবে অন্যলিঙ্গের পোশাক পরিধান করা। এরা অর্থনৈতিক কারণেও দ্বৈত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় যতক্ষণ না পরিবার দ্বারা বহিষ্কৃত অথবা নিজেদেরকে মুক্ত না করার উপায় খুঁজে পায়।
ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে, লিঙ্গান্তরিতদের বঞ্চিত ও অবহেলিত করা হয় নিয়মিত। আর গার্হস্থ্য পরিধির বাইরে সর্বসাধারণের জন্য নির্ধারিত স্থানেও এই বৈষম্যের হাত থেকে নিস্তার নেই। শিশুরা স্কুলে তাদের সমবয়সীদের দ্বারা ব্যঙ্গ এবং আক্রমণের স্বীকার হয়। হাসপাতালে, ডাক্তাররা তাদের চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানায়, বা অপ্রাসঙ্গিক ও অনুপযুক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে হয়রানির সৃষ্টি করে। হাসপাতালের বিছানা বা ভোটকেন্দ্রের মতো অত্যাবশ্যক লিঙ্গ-নিরপেক্ষ অবকাঠামোর সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির কারণে এই সংকট আরও প্রসারিত হয়। পারিবারিক সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্নতা অথবা শিক্ষার নূন্যতম অধিকার, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং অন্যান্য সংস্থান না থাকায় বেশিরভাগ লিঙ্গান্তরিত বাংলাদেশিদের বেঁচে থাকার উপায়ও যেন সীমিত।
২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের একটি পৃথক লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। সরকারি নথিতে পুরুষ ও মহিলাদের পাশাপাশি হিজড়াদের আলাদা লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে এইমর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেই সভায়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে ১০,০০০ নিবন্ধিত হিজড়া রয়েছে। এতদসত্ত্বেও, সরকারী নথিতে লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য কিভাবে বা কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং কে-ই বা হিজড়া হিসেবে যোগ্য হতে পারে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নীতিমালা এখনো বাংলাদেশে নেই। এখনও লিঙ্গ পরিচয় সংজ্ঞায়িত করে এমন কোন আইন নেই। একজন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত এবং স্বতন্ত্র অনুভূতি পুরুষ, মহিলা বা উভয়ের মিশ্রণ অথবা উভয়ের কোনোটাই না, এমনও হতে পারে; যা কিনা জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে আবার নাও হতে পারে।
লিঙ্গান্তরিত, লিঙ্গহীন, এসব শব্দ মূলত হিজড়া শব্দটার জয়প্রিয়তায় ঢাকা পড়ে আছে। আর হিজড়ারা হলো মূলত পুরুষ থেকে লিঙ্গান্তরিত মহিলাদের সম্প্রদায়, যা কিনা নিরাপত্তার নামে অনেকসময়ই নিপীড়নমূলক নিজস্ব আপাতবিরোধী এক কূটচক্র। যেসব লিঙ্গান্তরিত নারীরা এই বলয়ের আরোপিত প্রভাবকে অস্বীকার করে তাদেরকে সক্রিয়ভাবেই যেন বাদ দেয় হিজড়া সম্প্রদায়। গণমাধ্যম আর মানবাধিকার সংস্থাগুলোও 'তৃতীয়লিঙ্গ' ব্যতীত অন্য কোনও লিঙ্গের গণণা বা বিবরণে ব্যর্থ হয়েছে। লিঙ্গঅসঙ্গতি—এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তির জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গ তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে একাত্ম হয় না—বাংলাদেশে মূলধারার বর্ণনা থেকে এ ধারণটা প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, এবং লিঙ্গান্তরিত মানুষের একমাত্র দৃশ্যমানতা হল হিজড়াদের বাঁধাধরা সংজ্ঞা এবং উপস্থাপনা।
বাংলাদেশের হিজড়া ও অন্যান্য লিঙ্গান্তরী জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা এবং সব প্রকারের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতকরণের অধিকার আছে, মানে থাকা উচিত কিন্তু প্রকৃতঅর্থে নেই। আর এর জন্য শুধু দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শুধু নয়, আইনের প্রণয়ন এবং নিরপেক্ষ ও পরিচ্ছন্ন প্রয়োগেরও প্রয়োজন যাতে অন্যান্য সবলিঙ্গ একই সমাজব্যবস্থায় গড়পড়তা আর সব পুরুষ ও মহিলা নাগরিকের মতোই নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারে—যে অধিকার থেকে আসলে তারা অনেক দিন ধরেই বঞ্চিত হয়ে আসছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২৩ ভোর ৬:০৬