somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“অপারেশন সিকিউর শাপলা”

৩১ শে আগস্ট, ২০২৪ সকাল ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অপারেশন সিকিউর শাপলা বা শাপলা চত্বর অভিযান হল ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ ই মে বাংলাদেশের ঢাকায় সংঘটিত ঘটনাসমূহ, যার মাধ্যমে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যপ্রসূত ইসলামী অরাজনৈতিক জোট হেফাজতে ইসলামের গনসমাবেশ, আন্দোলন এবং তাদেরকে বিতাড়িত করার জন্য সরকার কর্তৃক পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বিত বাহিনীর ব্যবহারকে বোঝানো হয়। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক নবী মুহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্য করার শাস্তি হিসেবে একটি ব্লাসফেমি আইন প্রনয়ন এবং প্রকাশ্য নারী পুরুষের অনৈসলামিক মেলামেশা ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে আহবান জানানো।

৬ই মে'র ভোররাত থেকে, তৎকালীন সরকার উস্কানিমূলক আচরণের অভিযোগে বিরোধীদলীয় গোষ্ঠীর মালিকানাধীন দুটি চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টিভি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়, যেগুলো অপারেশানের কার্যকলাপ সরাসরি সম্প্রচার করছিলো। মতিঝিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন সোমবার সকালে হেফাজতের লোকদের রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর নারায়ণগঞ্জ, হাঁটহাজারী এবং বাগেরহাট সহ দেশের বেশ কিছু স্থানে হেফাজতকর্মীদের দাবীকৃত হত্যার প্রতিবাদে মিছিল হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে অপারেশনে সঙ্ঘটিত হতাহতের সংখ্যা ও পরিস্থিতিকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়। অনেকগুলো সূত্র থকে ৩০ জনেরও অধিক নিহত হওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। হেফাজত দাবি করে যে তাদের হাজারেরও অধিক কর্মী অভিযানে নিহত হয়েছে যা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকার'র জুন মাসের প্রতিবেদন, এবং সরকারি বিবৃতিসহ কোন মুক্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। [বিস্তারিত- Click This Link

১১ বছর আগে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় এসেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ও নারী নীতির বিরোধিতা করাসহ ১৩ দফা দাবি তুলে হেফাজতে ইসলাম ওই কর্মসূচি নিয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে দিনভর উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়েছিল সংগঠনটির ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। সেই রাতে রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের শাপলা চত্বর ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক ভীতিকর পরিবেশ। শেষ পর্যন্ত পুলিশ–র‍্যাব ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির অভিযানে খালি করা হয়েছিল শাপলা চত্বর। কী ঘটেছিল সেই রাতে-

শাপলা চত্বরের মঞ্চে চলছে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের উত্তেজনাকর বক্তব্য। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ওই এলাকায় ঘুট ঘুটে অন্ধকার। অন্যদিকে অবস্থানকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির শত শত সদস্য প্রস্তুত হয়ে আছেন পল্টনের তোপখানা মোড়, ফকিরাপুল ও দিলকুশা এলাকায়। অবস্থানকারীদের সরে পড়ার জন্য খোলা রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর স্টেশন যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের দিকের রাস্তা। এই চিত্র ছিল ২০১৩ সালের ৫ মে রাত সোয়া একটায়। যেকোনো সময় অভিযান শুরু হতে পারে, সেই প্রস্তুতি নিয়ে আছেন তিন স্তরে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির শত শত সদস্য। তোপখানা মোড়ে দেখা যায়, রাত দেড়টার দিকে বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশ সদস্যরা এগোনোর চেষ্টা করেন। তাঁরা প্রথমে হাতমাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে তখনো আসতে থাকে উত্তেজনাকর বক্তব্য। ঘণ্টাখানেক এভাবে চলে।

মূল অভিযান শুরু রাত পৌনে তিনটায়-
বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশ- তিন বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকেন। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ১০ মিনিট ধরে চলে এ পরিস্থিতি। এরই মধ্যে একপর্যায়ে মঞ্চের মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে এগোতে শুরু করেন শাপলা চত্বরের দিকে।

মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আগত আলেমে দ্বীন ও মুসল্লিদের অনেকেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। অসংখ্য মুসল্লি তখনও জিকিরে মশগুল। এ অবস্থায় মাইকে ভেসে আসে পুলিশের একটি ঘোষণাঃ “আপনারা সরে যান, এখন আমরা শাপলা চত্বর খালি করার জন্য যা করা দরকার তাই করব।“ স্বাভাবিকভাবেই এতে রাজি না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের অবস্থানে থেকে যান আল্লাহর পথে নিবেদিতপ্রাণ মুসল্লিরা। বেশিরভাগই এসময় ঘুমিয়ে ছিলেন। জেগে থাকা মুসল্লিরা জিকির করছিলে। কিন্তু আর কোন কথা বাড়ায়নি সরকারের পেটোয়া সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী। আর কোন সুযোগ না দিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি পুলিশ,র্যাব, বিজিবি ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা সব দিক থেকে ঘিরে হামলা শুরু করে। ব্রাশফায়ারের মুহুর্মুহু গুলি, গ্রেনেড, টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে নিরস্ত্র মুসল্লিদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে এই অমানুষগুলো। ঐ মুহুর্তে শাপলাচত্বরে থাকা মুসল্লিদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি আর বোমা আসতে থাকে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম এক হত্যাযজ্ঞ। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাঝে সরকারী হায়েনারা তাদের হিংস্রতা চরিতার্থ করে উল্লসিত হয়ে উঠে। উপস্থিত জনতার অনেকে কোন কিছু বুঝে উঠারই সুযোগ পাননি। অনেকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই গুলী ও বোমার শিকার হয়ে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন। বেশিরভাগ মুসল্লি ঘুম ভেঙ্গে হতবিহবল অবস্থাতে কিছু বুঝে উঠার আগেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।

এভাবে নির্বিচার গুলি চালিয়ে অবশেষে পুলিশ দখল করে নেয় শাপলা চত্বর। যারা অন্ধকারের মধ্যে খালি হাতেই কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, নির্মম বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড তাদের চিরতরে থামিয়ে দিয়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই পুলিশের জলকামান, ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দিয়ে ঐ এলাকা ধুয়ে মুছে রক্তের সব চিহ্ন পরিস্কার করে ফেলা হয়েছে। অসংখ্য লাশ গাড়িভর্তি করে গুপ্তস্থানে ডাম্পিং করা হয়েছে অথবা বৈদ্যুতিক চুল্লীতে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, প্রথমেই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এতে হেফাজত কর্মীদের প্রতিরোধ করার মনোবল ভেঙে যায়। মিডিয়াতে সম্পূর্ণ ব্ল্যাক আউটের পরও ইন্টারনেটে প্রকাশিত স্বল্পসংখ্যক ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, শাপলা চত্বরের আশপাশে অমানবিকভাবে রাস্তায় সিড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য লাশ। অনেক জায়গায় জমে গেছে কয়েকজনের লাশের স্তুপ। গোপন ছবিতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে শুধু সোনালী ব্যাংকের সিঁড়ি ও এর আশপাশে পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। শাপলা চত্বরের সবচেয়ে কাছের এই ভবনটিতে গতকাল আশ্রয় নিয়েছিলেন হেফাজতকর্মীরা। জীবন বাঁচাতে তাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় নির্বিচার গুলি,গ্রেনেড আর ব্রাশফায়ারে। এরপর মতিঝিল ও আরামবাগের বিভিন্ন অলিগলিতে আশ্রয় নেয়া আলেমদের উপ অ্যাকশন শুরু করে পুলিশ। সেখানেও ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় এক নারকীয় পরিবেশ নেমে আসে মতিঝিল ও শাপলা চত্বরে।

মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ৬ মে রাতে কত লোক নিহত হয়েছে? বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে গতকাল এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়,নিহতের সংখ্যা ২,৫০০ এরও বেশি হতে পারে। হেফাজতের ইসলামের হিসাবে নিহতের সংখ্যা ২,০০০ থেকে ৩,০০০ হতে পারে, এর বেশিও হওয়া অসম্ভব কিছু না। বিরোধী দল বিএনপি বলছে, শাপলা চত্বরে সহস্রাধিক লোককে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজন রিপোর্টার দাবি করেছেন, তিনি নিজে পাঁচটি ট্রাকে করে লাশ স্তুপ করে বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছেন। তাৎক্ষণিক লাইভ রিপোর্টিংয়ে তার সেই মন্তব্য প্রচার হলেও এরপর থেকে সেই খবর আর প্রচার করেনি চ্যানেলটি। এদিকে মার্কিন টিভি স্টেশন সিএনএন বার্তা সংস্থা এপির বরাত দিয়ে জানায়,৬ই মে রাতের নিহতের প্রকৃত সংখ্যা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। ঘটনাস্থলে মিডিয়া কাভারেজে অংশগ্রহণরত সাংবাদিকদের মতে, শত শত লোককে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে ৬ই মে কালোরাতে। মানবাধিকার কর্মীদের ধারণা হলো, নিহতের সংখ্যা এতোই বেশি যে সরকার কোনো দিনই তা প্রকাশ হওয়ার কোন সুযোগ দেবে না। এ কারণেই মহানগর পুলিশ কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, “ঐ রাতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি”।

এই বিষয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য- Click This Link

শাপলা চত্বর ম্যাসাকার : ডাম্পিং গ্রাউন্ড মাতুয়াইল
গত ১৬ বছরের ফ্যাসিজম আর ডিক্টেটরশিপে পেঁচিয়ে থাকা আতংকের কারণে অনেকেই অনেক ইনফরমেশন প্রকাশ করতে পারেননি। এখন আস্তে আস্তে সেই ইনফরমেশনগুলো সামনে আসছে, মিলে যাচ্ছে অনেকগুলো অসমাপ্ত পাজল। তাই আমিও ভাবলাম একটা ঘটনা শেয়ার করি। এই ঘটনা আমি আমার কাছের অনেককেই পারসোনালি শেয়ার করেছি, কিন্তু পাবলিকলি এই প্রথম বললাম।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : মাতুয়াইল ডাম্পিং গ্রাউন্ডের ঘটনাটা ওই এলাকায় বাস করেন এমন মানুষজনই আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন। উনাদের থেকে যা শুনে এসেছি সেটাই এই পোস্টে লিখেছি। এর সাক্ষী হিসেবে আমার তখনকার কলিগকেও আমি এই পোস্টে ট্যাগ করেছি। ঘটনার সত্যতা কতটুকু সেটা অবশ্যই তদন্তকারী বিভাগ যাচাই করে দেখবেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি শাপলা চত্বরে সেদিন রাতে যা হয়েছিলো সেখানে সরকারী ক্যাজুয়ালটির হিসাব কোনদিনই গ্রহণযোগ্য নয় এবং প্রচুর তথ্য ও এভিডেন্স গোপন করা হয়েছে।)

২০১৬ সালে (মাসটা ঠিক মনে নাই, খুব সম্ভবত এপ্রিল কিংবা মে মাস হবে) ব্যক্তিগত একটা ডকুমেন্টারির কাজে সাইট রেকির জন্য আমি আর Mithun Banik গিয়েছিলাম ঢাকার যাত্রাবাড়ীর পেছনের দিকের এরিয়া, গোলাপবাগের ভেতরে। সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই কাজলার পাড় এলাকায়। লোকাল কয়েকজন ভাইব্রাদার কে নিয়ে এরিয়া ঘুরে দেখছিলাম, উনারাও আমাদেরকে বিভিন্ন এলাকা ও স্থাপনা দেখাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে আমরা এসে পৌঁছাই কাজলার পাড়ের শেষ প্রান্তে, যেখানে শহরের চিহ্ন শেষ হয়ে খোলা ধানি জমি শুরু হয়েছে। আমাদের ডান পাশে ঢাকা-ডেমরা হাইওয়ে, সাঁই সাঁই করে গাড়ি যাচ্ছে। সামনে কিছুটা দূরে, বড় বড় ফ্লাডলাইটের আলোয় আলোকিত বিশাল এক খোলা অঞ্চল। কিছু বুলডোজার আর এক্সক্যাভেটর কাজ করছে, আর এই রাতের বেলাও উড়ছে শত শত কাক। আশেপাশে পুরোটাই খালি জায়গা হওয়ায় কাকের চিৎকার আমাদের কান পর্যন্ত ভেসে আসছে।
আমি একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "ভাই ওইটা কি?" আমাদের সঙ্গে থাকা একজন উত্তর দিলেন, "ওইটা? ওইটা মাতুয়াইল ডাম্পিং গ্রাউন্ড!" আমি তখন বললাম, "বাপরে, এত বড় ময়লার ভাগাড়ে কাউকে গায়েব করে ফেললে তো কোনদিন খুঁজেও পাওয়া যাবে না!" এরপরেই উনাদের মাঝে নেমে এলো এক অস্বস্তিকর নীরবতা। ওই ভদ্রলোক নিজে থেকেই জানালেন এক নির্মম সত্য যেটা গোলাপবাগ, কাজলার পাড়, বিবির বাগিচা সহ আশেপাশের সব এলাকার মানুষই জানে কিন্তু মুখ খুলতে কেউ রাজি না।

২০১৩ সালের ৫ই মে রাতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অন্তত এক লাখ কর্মীকে চত্বর থেকে সরানোর জন্য রাত ১টা থেকে জয়েন্ট অপারেশন শুরু করে পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবি। এর দুইঘন্টা পর রাত ৩টা/সাড়ে ৩টার দিকে অনেকগুলো ট্রাক প্রবেশ করে মাতুয়াইল ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। সেই ট্রাকগুলো থেকে নামানো হয় সারি সারি পাঞ্জাবি পায়জামা পরা রক্তাক্ত লাশ। কারো মাথায় তখনো টুপি আছে, কারো মাথায় নাই। কারো বুকের মধ্যে গর্ত, কারো মাথায়। বোঝাই যাচ্ছে গুলি খাওয়া।সেই লাশগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। সেখানে ওয়েস্ট প্রসেসিং মেশিনে গার্বেজের সাথে একে একে ফেলে দেয়া হয় লাশগুলো। ক্রাশিং এবং শ্রেডিং করে হাড় মাংস সব মিশিয়ে দেয়া হয় ময়লার সাথে। এমনভাবে মিশিয়ে দেয়া হয় যে প্রফেশনাল ফরেনসিক টিম আর তাদের ইকুইপমেন্ট ছাড়া খালি চোখে সেই প্রসেসড গার্বেজ দেখলে কেউ বলতে পারবেনা এর মধ্যে মানুষের দেহাবশেষ আছে। পুরো ঘটনাটা তদারকি করে র‍্যাব এবং লোকাল সরকার দলীয় কিছু নেতা। সেইদিন এক্স্যাক্টলি কয়টা লাশের ভাগ্যে এই পরিণতি হয়েছিলো সেটা কেউ বলতে পারবে না। তবে নাম্বারটা যে তিন সংখ্যার কম নয় এই ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত।

এই বিষয়ে অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন- Click This Link

শাপলার সেই দিনগুলো-১

মাতুয়াইল ডাম্পিং গ্রাউন্ড, স্থানীয় ভাষায় বলে ময়লার পাহাড়। ঢাকা-শহরের সমস্ত আবর্জনা এখানে এনে ক্রাশিং করে গ্যাস বানানো হয়। এরিয়াটা কয়েক মাইল ব্যাপী হবে। ডেমরা কোনাপাড়ার মধ্যে পড়েছে জায়গাটা।
২০১৩ সাল, আমি তখন কাজলা ভাঙাপ্রেস কাসেমিয়া মাদরাসায় পড়ি। ৫ই মে রাতে শাপলা চত্বরে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলাম। চোখের সামনে শহীদ হতে দেখেছি। লাশের ওপর দিয়ে ফিরেছি ভোররাতে।

পরদিন সকাল, মাদরাসা থেকে আধা কিলো দূরত্বেই সেই ময়লার পাহাড়। এর আশেপাশে খেলতে যেতাম আমরা। ঘোরার অন্যতম জায়গা ছিল এই জায়গা। ভোরে যখন মাদরাসায় ফিরলাম, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম একের পর এক ময়লার ট্রাক ঢুকছে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। মিনিমাম ১৫/২০টা হবে যদ্দূর মনে পড়ছে। তবে সবগুলোর ওপরে ত্রেপাল দিয়ে ঢাকা, যা আগে কখনো দেখিনি। পেছনে দেখলাম পুলিশ-র‌্যাবের গাড়ি। বিকালে হাঁটতে গেলাম সেখানে। কিন্তু মেইন গেইটের সামনে পুলিশের গাড়ি, আর স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাদের উপস্থিতি দেখলাম। এমনিতেই আগের রাতে পুলিশের নির্মমতা দেখে মনে ঘৃণা আর ভয় জন্মেছে, এর ওপর পুলিশ দূর থেকেই সরিয়ে দিচ্ছে। আঁচ করতে পারছিলাম, ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। যেই গেইট এত বছরেও বন্ধ দেখলাম না, সেটা আজ বন্ধ কেন?
এরও কয়েকদিন পর যখন সেখানে আবারও গেলাম, ভেতরে সেখানকার পরিচিত কর্মচারীদের মুখে স্পষ্ট শুনলাম, গাড়ি ভরতি লাশ এনে ট্রিটমেন্ট প্লান্টে সব গুড়ো গুড়ো করে মিশিয়ে দেয়া হয় ময়লার সাথে। যেখানে ফেলা হয় গুড়োগুলো, সেই জায়গাটা ঘেরাও করা ছিল, প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আরও কিছু তথ্য শুনেছি, শুনেছি অনেককিছুই। দূর থেকেই তখন পেলাম শহীদের ঘ্রাণ, যেন বহুদিন ধরে চিনি এসব ঘ্রাণ, দুর্গন্ধময় এই জায়গায় এই ঘ্রাণ আসবে কোত্থেকে! বলব আরও কিছু, লিখব এসব চেপে রাখা ইতিহাস, সবে তো শুরু!

গণহত্যায় ব্যবহৃত গোলাবারুদের সংখ্যাঃ
৫ মের ওই অপারেশনে প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ খরচ হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের হিসাবে ৮০ হাজার টিয়ার শেল, ৬০ হাজার রাবার বুলেট, ১৫ হাজার শটগানের গুলি এবং ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে পিস্তল এবং রিভলবার জাতীয় ক্ষুদ্র অস্ত্রের গুলি খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩০০ রাউন্ড। সরকারের ৫ মের অপারেশনে র‌্যাবের ১ হাজার ৩০০ সদস্য, পুলিশের ৫ হাজার ৭১২ এবং বিজিবির ৫৭৬ জন সদস্য সরাসরি অংশ নেয়। এর বাইরে বিজিবির ১০ প্লাটুন ছাড়াও র‌্যাব এবং পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য ‘স্টাইকিং ফোর্স’ হিসেবে তৈরি ছিল। রাত ২টা ৩১ মিনিটে মূল অপারেশন শুরু হলেও রাত ১২টার পর থেকেই মূলত আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ধীরে-ধীরে শাপলা চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। পুলিশের পক্ষ থেকে ওই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’। র‌্যাবের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’।

সেই রাতের গণহত্যার বিষেয়ে, একুশে টিভির ক্যামরোম্যান জানিয়েছেন, লাশের সংখ্যা হবে প্রায় ২৫০০, এমনকি ৫ ট্রাক লাশ যেতে তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। এসময় ভিডিও করার কারনে তাকে ও তার সহকর্মীকে মারধর করে একুশে টেলিভিমনের ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে র‌্যাব। সময় টিভির কাছে লাশবোঝাই ট্রাকগুলোর ছবি আছে। বেসরকারী হিসাব মতে ২৫ ট্রাক লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মাতুয়াইলের দিকে, ১৬ ট্রাক লাশ যায় পিলখানায়। সঠিক লাশের সংখ্যা এখনো সন্দিহান!

এই বর্বরোচিত গণহত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেনি সরকার। বরং প্রেস নোট দিয়ে অবৈধ সমাবেশের জন্য হেফাজতকে দায়ী করেছে। বলা হয়, ঘটনার সময় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি এমনকি কোনো কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।

আমরা রহস্য করতে বা রাখতে পছন্দ করি। রহস্য ভেদ করতে চাই না। কিন্তু এখন বোধহয় সময় এসেছে, কিছু রহস্য ভেদ করে কঠিন সত্যের মুখোমুখী হওয়ার। এ ভিন্ন কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকলে বিস্তারিত জানাবেন। এই বিষয়ে সঠিক তদন্ত হওয়া জরুরী।

(তথ্য সংগৃহীত/সংশোধিত/পরিমার্জিত)

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২৪ দুপুর ২:০৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভোটের ২/৩ দিন আগে ট্রাম্পকে আবারো গুলি করার সম্ভাবনা।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৮:২২



ট্রাম্পকে ২য় বার গুলি করার জন্য পজিশন নিয়েছিলো একজন পরিচিত অপরাধী লোক; সে ধরা পড়েছে। তার পুরো প্রচেষ্টা, তাকে ধরার ধরণ ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ লোকদের আচরণ দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার চাঁদগাজী/সোনাগাজীকে একটু মানিয়ে নেয়ার অনুরোধ।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:০১


ব্লগার চাঁদগাজীর একটাই সমস্যা তিনি অহেতুক মানুষকে খোঁচান। গার্বেজ বা নতুন প্রজন্ম যেগুলোকে গু পোস্ট বলে সেগুলোকে সরাসরি গু পোস্ট বলা ব্লগে বেমানান। ফেসবুক ইনস্টাতে বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। যেমন আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড ইউনুসের রিসেট বাটন নিয়ে ফ্যাসিবাদীদের প্রপাগান্ডা

লিখেছেন জিয়া চৌধুরী, ০৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৮:২৩

ড. ইউনূসের "রিসেট বাটন" পুশ করার বক্তব্য নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসররা।

আসুন দেখি রিসেট বাটন পুশ করা বলতে কী বুঝিয়েছেন ড. ইউনূস।

সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। রাষ্ট্রপুঞ্জে ইউনূসের সফল দৌত্যে চিন্তায় নয়াদিল্লি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৬



বাংলাদেশের মাটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন রুখতে নতুন অন্তর্বর্তিকালীন সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে ক্ষোভ বাড়ছে সাউথ ব্লকে। সে কারণে মুহাম্মদ ইউনূস চাইলেও রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার কী বলবে আম্লিগ? "জয়'র তথ্য বিক্রির ফরমুলা"

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:০৮


সজীব ওয়াজেদ জয় গণভবনে মিটিং ডেকে দাম্ভীকতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাতীয় তথ্য ভান্ডার অর্থাৎ NID তথ্য ভান্ডারের মিরর কপি চেয়েছিলেন। কেন তিনি জাতীয় তথ্য ভান্ডারের মিরর কপি চেয়েছিলেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×