আফা! ওর শীর্ন হাতটি বাড়িয়ে দিলো ছয়-সাত বছরের ছেলেটি।চেহারায় প্রচন্ড মায়া।আমার খারাপ লাগছিলো না করতে।তবু বললাম,হবে না।
কিছু দ্যান না,আফা!
বাসা থেকে বেরোনোর সময় পার্সে একশ পঞ্চাশ টাকা ছিলো।আসার সময় পঞ্চাশ টাকা তিথি আর আমার দুজনের বাস ভাড়া দিয়েছি।এখন আমার কাছে একশ টাকার একটা নোটই অবশিষ্ট আছে।যাওয়ার ভাড়া বাদে বাকি টাকায় আমি আর তিথি দুজনে আইসক্রিম খাবো।খুচরা না থাকায় মহা মুশকিলে পড়া গেল।
আফা! সকাল থেকে কিছু খাইনি।শরীলডা ভালা না, কিছু দ্যান।
রাস্তার অপজিটে একটি ছোট বেকারির দোকান।আমি ছেলেটাকে বললাম," আমার কাছে খুচরা নেই; চল ওই দোকান থেকে খুচরা করে দিচ্ছি।" ছেলেটাকে পঞ্চাশ টাকা দিলাম; পঁচিশ টাকায় নিজের জন্য একটা আইসক্রিম কিনলাম।গরমে গলাটা ভীষণ শুকিয়ে গেছে।
স্যরি,একটু দেরি হয়ে গেল।
একটু! পুরা তিরিশ মিনিট তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
পরীক্ষা শেষ করে বেরিয়েছি; তখনি চন্দ্রাদের সাথে দেখা আর কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।
তিথির জন্য আর একটা আইসক্রিম নিয়ে ওর হাতে দিলাম।ফরসা দোহারা গড়নের একটি মেয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।আমাদেরই ক্লাসমেট।প্রথম বর্ষে কিছুদিন ক্লাস করেছিলো।তারপর আর কখনও ক্লাসে দেখিনি।পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষা দেয়।প্রথম বর্ষের শুরুর দিকে একদিন আলাপ হয়েছিলো।নাম মোহনা।বেশ হাসি খুশি চঞ্চল মনে হয়েছিল সেদিন মেয়েটিকে।কিন্তু তারপর থেকে পরীক্ষার দিনগুলোতে যতবার দেখেছি ওকে কেমন যেন গুটিয়ে রাখে নিজেকে।কারোর সাথেই তেমন কথা বলে না।
এই উত্তপ্ত দুপুরে সিঙ্গাড়া খাচ্ছে ও।খাওয়া শেষ করে পানি খেতে গিয়েই মোহনা বমি করে দিলো।
আরে কি করলেন আপনি! বিরক্ত মুখে বলল, দোকানের কর্মচারী।ক্যাশে বসে থাকা লোকটি বলল,"আপু আপনারা একটু সরে দাঁড়ান।" কর্মচারীর উদ্দেশ্যে বলল,এই জায়গাটা জলদি পরিস্কার কর।আমার হাতে থাকা পানির বোতলটা মোহনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,তোমার চোখে মুখে একটু পানির ছিটা দাও।
আমাদের তিনজনের গন্তব্য এক না হলেও একই রুটে হওয়ায় একই বাসে উঠলাম।মোহনাকে জানালার পাশে বসতে দিয়ে আমি আর তিথি ওর পাশের সিটে বসলাম।ও শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।এতক্ষন পর্যন্ত ও আমাদের সাথে একটা ও কথা বলেনি।
তোমাদের পরীক্ষা কেমন হলো? মোহনা জিজ্ঞেস করল।
ভালোই।তোমার? আমি বললাম।
মোটামুটি।শেষদিকে এসে শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিলো।গতকাল একটা চাকরির পরীক্ষা ছিলো।পরশু রাতের ট্রেনে ঢাকায় যায়।পরীক্ষা শেষে গতকাল রাতের ট্রেনে আবার ফিরে আসি।সকালে বাসায় পৌঁছে কিছুক্ষণ বাদেই আবার পরীক্ষা দিতে ছুটে আসলাম।দুইদিন ধরে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া হয়নি।তার উপর ঢাকায় যাওয়া আসার সময়ে সাথে ছোট বাচ্চা থাকায় বাড়তি একটা পেরেশানি।
তুমি পরীক্ষার মধ্যে চাকরির পরীক্ষা কেন দিতে গেলে? আর বাচ্চা! কার বাচ্চা?
আমার তিন বছরের একটা মেয়ে আছে।যার দায়ভার বহন করার জন্য আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।বাচ্চার প্রতি দায়িত্ব পালন আর নিজের জীবন চলার জন্য একটা চাকরি আমার বড় প্রয়োজন।তাই ক্লাস পরীক্ষার মধ্যে চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়া।মোহনা শূন্য দৃষ্টিতে পুনরায় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম হয়তো ওর হ্যাজবেন্ড বেঁচে নেই।কিন্তু ওর বাবা-মা! তাদের কাছে তো কিংবা ওর অন্য কোন আত্মীয়ের কাছে তো ছোট মেয়েটাকে রেখে যেতে পারতো।তুমি খুলনা থেকে ঢাকায় এত দূরে পরীক্ষা দিতে গেলে; কারোর কাছে মেয়েটাকে রেখে যেতে পারতে।
এমন কেউ নেই যার কাছে রেখে যেতাম।একদিন নিজের ইচ্ছায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে যে ভুল করেছিলাম; তার জন্য আজও আপনজনদের কাছ থেকে দূরে সরে আছি।সেদিন বুঝিনি যার হাত ধরে ঘর ছাড়লাম; সেই একদিন আমায় ছেড়ে চলে যাবে।নিজের আসল আপনজনদের অসম্মতিতে একটি অজানা অচেনা মানুষকে আপন করার শাস্তি ভোগ করে চলেছি প্রতিটা মুহূর্ত।
আজ কার কাছে রেখে এসোছো ওকে?
ঘরে তালাবন্দি করে রেখে এসেছি।হয়তো এতক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ক্ষুধা পেটে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।
হেল্পার চিৎকার করে বলছে, কেউ নামার থাকলে জলদি নামেন।এখানেই নামতে হবে মোহনাকে।আমাদের বিদায় জানিয়ে ও চলে গেল।আমি তাকিয়ে ছিলাম ততক্ষণ অবধি; যতক্ষণ পর্যন্ত ও আমার দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:০০