ইদানিং রাত এলেই নীরুর খুব ভয় লাগে।ঘুমাতে ইচ্ছে করে না।মনে হয় সারারাত জেগে বসে থাকি।কারন ঘুম মানেই স্বপ্ন।তবে স্বপ্ন না বলে দুঃস্বপ্ন বললেই বোধকরি ঠিক হবে।স্বপ্নে নীরুর ভীষণই কষ্ট হয়।নীরু লাইটটা অন করলো।দেওয়াল ঘড়িটির দিকে তাকালো।এগারোটা বাজে।ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসছে নীরুর।কিন্তু ঘুমালেই যদি আবার সেই দুঃস্বপ্নটা.....উফ!
নীরু পাশের রুমের দিকে তাকায়।লাইট অফ।নিশ্চয় বাবা-মা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।আচ্ছা!মাকে ডাক দিবো।না,কত ভোরে মাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়।সকালের নাস্তা,নীরুর স্কুলের টিফিন,সংসারের টুকিটাকি কাজ সেরে তারপর রেডি হয়ে স্কুলে যাওয়া।নীরুর মা গ্রামের সরকারী স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা আর বাবা প্রধান শিক্ষক।
নীরু কি হয়েছে মা!এতজোরে চিৎকার করলি কেন?
নীরু হাঁপাচ্ছে।ত্রিশ মিনিটের মত হয়েছে নীরু ঘুমিয়েছে।আর এর মধ্যেই সেই দুঃস্বপ্ন।মা আমার খুব ভয় করছে।তুমি আজ আমার কাছে ঘুমাবে।
নীকিতা নীরুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল,"আচ্ছা! কিন্তু তুই ভয় পাচ্ছিস কেন,কি হয়েছে আমাকে বল।"
নীরু চুপ করে আছে।নীকিতা বলল,"মনে না পড়লে থাক,কষ্ট করে মনে করতে হবেনা।"
নীরু টিফিনের সময় টিফিনটা খেয়ে নিও,ফিরিয়ে এনোনা আবার।আর ছুটি হলে সোজা বাড়ি চলে আসবে,কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে না।
নীরু তুই আমাদের সাথে খেলবি।কতদিন আমাদের সাথে খেলিসনা।
গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে ভৈরব নদী।নদীর ধারে উত্তরন কোচিং সেন্টার।বিকেলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভৈরবের বিস্তীর্ণ চরে দলবেঁধে খেলতে আসে।ছেলেরা ক্রিকেট,মেয়েরা খেলে গোল্লাছুট, কানামাছি আরও কত রকমের মজার খেলা।নীরু ও আগে কোচিং শেষে ওর বন্ধুদের সাথে খেলতো।কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে ও আর ওর বন্ধুদের সাথে খেলতে পারেনা।রিতা ম্যাডাম এতক্ষণে হয়তো এসে গেছে।অন্যদিন ও কোচিং শেষে এক মিনিট ও দেরী করে না।মা বার বার করে বলে দেয় ম্যাডাম এসে বসে থাকবে তুমি কোচিং শেষ হলেই তাড়াতাড়ি চলে আসবে।আগে নীরু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গোসলের পর খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর কোচিং এ পড়তে আসতো।কোচিং শেষ হলে ভৈরবের চরে সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে খেলতো।কিন্তু ক্লাস ফাইভে উঠার পর থেকেই মা ওর বাড়তি টেক কেয়ারের জন্য রিতা ম্যাডামকে বিকেলের এই খেলার সময়টুকুতে ওকে পড়ানোর জন্য নিযুক্ত করেছে।
দাঁড়িয়ে আছিস যে,আয় আমাদের সাথে খেলবি।
নারে! ম্যাডাম পড়াতে আসবে তোরা খেল।
সেই প্রথম স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই নীরুর রোল নম্বর কখনো এক থেকে নড়চড় হয়নি।ফাইভে উঠার পর থেকে মা বারবারই সতর্ক করছে,তুমি আর ছোট নেই সামনে সমাপনী পরীক্ষা।আর পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে তোমাকে আগের তুলনায় বেশি পড়াশোনা করতে হবে।তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান।তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন।তোমাকে বৃত্তি পেতে হবে।তুমি তো জানো তোমার বাবা হাই পেশারের রোগী।তুমি যদি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল না করো....
নীরু!তোমার কি মন খারাপ?
নাতো,মা।
তাহলে বইয়ের পাতায় মন না দিয়ে,অন্যদিকে তাকিয়ে কি ভাবছ?
নীরু চুপ।
কি হলো তুমি কথা বলছো না কেন?মুখটা কেমন শুকনা দেখাচ্ছে,গতকাল রাতে ঘুমের মধ্যে ওভাবে চিৎকার করে উঠলে।তুমি কি কোন ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিলে?
হ্যাঁ মা! আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই আমার ঘুমে খুব ডিস্টার্ব হচ্ছে।রাতে ভালো ঘুম হয় না।ঘুমালেই একই স্বপ্ন বারবার দেখি।
এ কারণেই তোমার চোখের নিচে কেমন কালো দাগ পড়েছে।তুমি আমাকে কিছু বলোনি কেন?স্বপ্নে কি দেখো বলো তো।নীরু!চুপ করে থেকো না,বলো মা।দুঃস্বপ্নের কথা আপনজনদের সাথে শেয়ার করতে হয়।
মা তুমি বলেছিলে আমি যদি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল না করি তাহলে বাবা....
কিন্তু তার সাথে তোমার স্বপ্নের কি সম্পর্ক।
আমি স্বপ্ন দেখি পরীক্ষার হলে আমি পরীক্ষা দিচ্ছি।কিন্তু আমার হাতের কলম স্থির হয়ে আছে।শত চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারছি না।যার ফলে আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি।আর আমার ফেলের সংবাদ শুনে বাবা স্টোক করেছে।আমার বান্ধবী শিলা,সাদিয়া,বৃষ্টি ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে আর বলছে তুই না ভালো রেজাল্ট করার জন্য বিকেলে আমাদের সাথে খেলতিস না পর্যন্ত।তাও শেষপর্যন্ত ফেল করলি।
মা এরকম কিচ্ছু হবে না।নীকিতা নীরুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল।আমি তোকে তোর বাবার কথাটা বলেছিলাম যাতে তুই পড়ার প্রতি আর একটু মনোযোগী হোস।কিন্তু তুই এভাবে...।তোকে এখন থেকে আর এতো চাপ নিতে হবেনা।
পরেরদিন নীরু কোচিংয়ে যাচ্ছে।নীকিতা বলল,"নীরু কোচিং শেষে তুমি নদীর চরে বন্ধুদের সাথে খেলো।"
রিতা ম্যাডাম আজ বিকেলে পড়াতে আসবে না?
শুধু আজ নয়।আর কোন বিকেলেই সে তোমাকে পড়াতে আসবে না।তুমি আগে যেমন স্কুল শেষে শুধু কোচিং করতে এখনও তাই করবে।