বকুলতলা!কেউ আছেন ভাই,বকুলতলা!
হেল্পারের চিৎকারে আচমকাই জেগে উঠল তুতুন!সামান্য বিশ মিনিটের জার্নিতে ও কেন যে ঘুম পায় তুতুনের।
ছায়া সুনিবিড় প্রকান্ড বটগাছ।চারিদিকে তার বিস্তৃর্ণ শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে কত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে।অথচ জায়গাটার নাম কিনা বকুলতলা।কি আজিব! জায়গাটার নাম বকুলতলা না হয়ে বটতলা হওয়াটায় তো অধিকতর শ্রেয় ছিলো।আশপাশের চৌহদ্দিতে যতদূর দৃষ্টি যায় কোন বকুলের চারাগাছটি পর্যন্ত চোখে পড়ে না।
গ্রীষ্মের দুপুরের প্রচন্ড দাবদাহে শ্রান্ত নানান প্রজাতির পাখিরা পরম তৃপ্তিতে বটবৃক্ষের শাখায় আশ্রয় নিয়েছে।ডালে বসে বসে পাকা ফল খেয়ে নিচে বিশ্রামরত পথিকের গায়ে ফেলছে।অন্যদিন এখানে যাকে বাইক নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় আজ সে নেই।
বটবৃক্ষের একটু অদূরেই একটা মুদি দোকান ।দোকান আর বটগাছের মধ্যিখান বরাবর বড়রাস্তা থেকে নেমে দক্ষিণ দিকে একটি লাল ইট বসানো রাস্তা চলে গেছে।রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সবুজ ফসলের মাঠ।এখান থেকে দুই ক্রোশ দূরে রিয়াদের বাড়ি।তুতুনের ক্লাস শেষ হওয়ার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর রিয়ার ক্লাস শেষ হয় তাই একসাথে ফেরা হয়না।
চাচা আমাকে একটা আইসক্রিম দেনতো।
একটু বসো মা।গরমে আসছো,একটু জিরাই নিয়ে তার পর আইসক্রিম খাও।
গরমে সবাই বটের নিচে বিশ্রাম নেওয়াতে দোকানের সামনে পাতানো বেদিটা ফাঁকাই ছিলো।তুতুন বাস থেকে নেমে বাড়ি ফেরার সময় এখানে পাঁচ-দশ মিনিট বসে তারপর বটগাছটার অপজিটে উত্তর দিকে গ্রামের যে মাটির রাস্তাটি কিছুটা একেঁবেঁকে বয়ে চলেছে,সেই রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে বাড়ির পথে রওনা হয়।
সরু মাটির রাস্তা আর পিঁচঢালা রাস্তার সাথে একটি বিশাল দিঘী।কিছুদিন পর গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার জলে দিঘীটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ফুটে থাকবে অজস্র শাপলা শালুকের রং বেরঙ্গের ফুলে।দিঘীর ওপারে একটি দোচালা টিনের ঘর।ঐ যে লোকটা রাস্তার পাশে ছোট্ট ছাউনি দেওয়া চালার উপরে বসে সবজি বিক্রি করছে তার ঘর ওটা।ঘরের সদস্য সংখ্যা তিনজন।তুতুন আসা-যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যেই এদের ঝগড়াঝাঁটি শুনতে পাই।
লোকটার হাতে একটা স্মার্টফোন,গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে।সারাদিনের কাঠ ফাটা রোদে সবজি গুলো শুকিয়ে গেছে।নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে কেউ কিনে না।বিকেলে এই বটের নিচে ছোট্ট করে বাজার বসে।নানা রকমের মিষ্টি-মিঠায়,ভাজাভুজি,পাশের গ্রাম থেকে অনেকেই টাটকা সবজি,ফলমুল নিয়ে বসে এখানে। গ্রামের মানুষজন তখন তাদের প্রয়োজনীয় বাজার সদয় এখান থেকেই সেরে নিতে পারে। একটি শ্যামা দীঘল চুলের মেয়ে একটা দুই বছরের বাচ্চা কোলে নিয়ে দিঘীর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে।ঘন কাজল চোখে এক আকাশ বিষন্নতা।এই মেয়েটি ওই সবজি বিক্রেতার বউ।আজও হয়তো মেয়েটিকে বিদম প্রহর সয্য করতে হয়েছে।ঝগড়ার সময়ে প্রায় লোকটাকে বলতে শোনা যায়-হারামজাদি তোর জন্য আমার বাবা-ভাইদের থেইকা আলাদা হওন লাগছে।পনেরো-বিশ জনার ভাতের পাতিল তুলতে উনার কোমর ভেঙে যায়, নবাবজাদি আমার।আর সেই সময়ে যদি মেয়েটির মুখ থেকে ক্ষীনস্বরে ও কোন কথা বের হয় তাহলে সেই মুহূর্তেই তার উপরে শুরু হয়.....
তুতুন অনেকক্ষন ধরে বসে আছে।অন্যদিন এই সময়ে ও বাড়ি পৌঁছে যায়।
মা!তুমি তো অনেকক্ষণ হলো বসে আছো।কারো জন্য অপেক্ষা করছো?
হ্যাঁ চাচা! আমার বান্ধবীর জন্য।
তুতুন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সচরাচর মিথ্যা বলে না।কিন্তু এখন বললো।গত তিন মাস ধরে তুতুনের ফেরার পথে যে ছেলেটিকে রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, তুতুনের চোখ বারবার তাকেই খুঁজছে।কিন্তু কেন? আর ছেলেটিই বা কেন রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকে?
কিরে তুতুন! তুই এখনো এখানে?তোর তো কত আগেই ছুটি হয়ে গেছে,বাড়ি যাসনি কেন?
এমনিতেই বসে আছি।
দাদা এখনো আসেনি কেন? অন্যদিন তো আগে থেকেই এসে বসে থাকে।এরমধ্যেই লাল ইটের রাস্তাটি দিয়ে সুমন্ত বাইক নিয়ে রিয়া,তুতুনের সামনে এসে দাঁড়াল।স্যরি দেরি হয়ে গেল,তুই কি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছিস?
না।মাত্র এসে দাঁড়ালাম।দাদা ও আমার বান্ধবী তুতুন!
আমি উনাকে চিনি।আপনার তো বেশ আগেই ছুটি হয়।আজ এই সময়ে?
আজও আগেই ছুটি হয়েছে।আমি এমনিতেই এখানে বসে ছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:১৬