২০শে ডিসেম্বর ১৯৭১ –এ, মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পনের পূর্বে পাক-বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে । ১৯৯৪ সালে পুণ:মুদ্রিত বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবি সম্পর্কিত তথ্যকোষ ”শহীদ বুদ্ধিজীবি কোষগ্রন্থ” এ শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা ২৩২ জন উল্লেখ আছে এবং এই তালিকাটি সর্বমোট নয় এমনকি সম্পূর্ণ নয় ।
এই তথ্যকোষে শহীদ আখ্যায়িত হয়েছেন তারা যাদের পাক-বাহিনী এবং দোসরেরা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) বিভিন্ন সময় নির্বিচারে হত্যা করেছিল এবং যারা ২৫শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ৩১শে জানুয়ারী ১৯৭২ সময়কাল থেকে নিঁখোজ । লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, সংগীত শিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, উকিল, চিকিৎসক, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, নাট্য-কর্মী, জনসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বুদ্ধিজীবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ”বাংলাদেশ” নামক প্রামান্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ-শিক্ষককে হত্যা করা হয়।
এ ব্যাপারটি পরিস্কার ছিল যে, পরাজয় সন্নিকটে জেনে, পাক-বাহিনী এবং তার দোসরেরা বুদ্ধিজীবি নিধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং শিক্ষক, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন পেশাজীবির মানুষদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে আসে এবং একজনের পর একজনকে হত্যা করে এবং তা বেশীর ভাগই সংগঠিত হয় এই ১৪ই ডিসেম্বরে। এই হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল মূলত জাতি হিসেবে আমাদের মেধাহীন, পঙ্গু করে দেয়া।
দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গোপন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে, ১৮ই ডিসেম্বরে একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে, রায়ের বাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষত-বিক্ষত লাশের একটি গণ-কবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একে-অন্যের নীচে চাপা পড়ে ছিল । লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একটি বন্দীশালা আবিস্কার করে, যা ছিল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামালউদ্দিন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী, আবুল খায়ের এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতার - পচনশীল লাশগুলো পরিবার কর্তৃক সনাক্ত করা হয় সেদিনই । সাংবাদিক সেলিনা পারভিন এর লাশ সনাক্ত করা হয় পরের দিন। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ফাইজুল মহি এবং চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলী’র লাশ পরবর্তীতে চিহ্নিত করা হয়। লাশ সনাক্তকরণের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবিদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
এরকম আরো বধ্যভূমি ছিল মিরপুর এবং রায়ের বাজার এলাকায়, তেঁজগাঁও এর কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি.বি. হাসপাতাল সহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক লাশই পরবর্তীতে সনাক্তকরণের পর্যায়ে ছিলনা । এসময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবিদের (নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপহরণ অথবা গেফতারকৃত) নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল।
পাক-বাহিনী এদেশের তরুণ ছেলে-মেয়েদেরকে হত্যা করা শুরু করেছিল সেই ২৫শে মার্চের সময় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য এবং অনেক প্রফেসরদের হত্যা করা হয় । মূলত যুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়েই চলে বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ড। এমনকি পাক-বাহিনীর দোসরদের (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ১৯৭২ এর জানুয়ারীতেও।
চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার অপহরণকৃত ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে (পাক-বাহিনীরা তাকেও হত্যা করেছিল বলে ধারনা করা হয়) খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তাকে শেষ দেখা যায় মিরপুরে বিহারী ও পাক-বাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে। পরবর্তীতে তার সম্পর্কে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ডা: মনসুর আলীকে ২১শে ডিসেম্বর এবং সাংবাদিক গোলাম রহমানকে ১১ই জানুয়ারী হত্যা করা হয়।
*** *** *** *** *** *** *** ***
ব্লগার খোমেনী ইহসান -এর পুরো পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার একটি মন্তব্য তুলে ধরছি :
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. হুমায়ুন কবির আমার ফুফাতো ভাই। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলায় তার মামা আমিমুল ইহ্সানের (আমার পিতা) শ্বশুর বাড়িতে থেকে তিনি এখানে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেন ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। প্রয়োজনীয় কাজে ঢাকায় আসলে হাতির পুল বাজারস্থ বাড়ি থেকে বের হয়ে ১৫ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাওয়ার পথে তিনি নিখোঁজ হন। পরবর্তীতে মতিঝিলে তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।
তার নামে শরীয়তপুর জেলার ভেদর উপজেলার চর ভাগা ইউনিয়নে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা, হুমায়ুন কবীর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ স্কুলটি শরীয়তপুর জেলার শ্রেষ্ঠ স্কুল। এ বছরের বর্ষায় নদী ভাঙ্গনে স্কুলটি বিলীন হয়ে গেছে। তবে সখিপুরে স্কুলটি স্থানান্তর করা হয়েছে।
আমাদের পরিবারে তৎকালীন সকল সক্ষম পুরুষই মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। এর মধ্যে আমার বড় জ্যাঠা ডা. আবুল কালাম আজাদ মোল্লা চাঁদুপুরে পাকিস্তানীদের একটি জাহাজ লুট করায় নেতৃত্ব দেন।
*** *** *** *** *** *** *** ***
মফিজউদ্দিনের (লাশ বহনকারী বাহনের চালক) স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আশরাফুজ্জামান খান, ইসলামি ছাত্র সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য এবং পাকিস্তান রেডিও’র সাবেক কর্মী, নিজ হাতে সাত জন শিক্ষককে গুলি করেন। মফিজউদ্দনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এমন দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মৃত্যুবরণকারী শিক্ষকদের লাশ উদ্ধার করা হয় রায়ের বাজার বধ্যভূমি এবং মিরপুরের শিয়াল বাড়ির গণ কবর থেকে। তার ডায়রীতে ২০ জন শিক্ষক সহ আরো অনেক বাঙালির তালিকা ছিল। তার ডায়রীতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল যারা পাক-বাহিনীকে সহযোগীতা করেছিল।
বুদ্ধিজীবি হত্যা পরিকল্পনায় পাক-বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাসেম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিল মূল হোতা । নভেম্বর মাসের কোন এক সময় তারা মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসগৃহে মাদ্রাসা শিক্ষক সংঘের প্রেসিডেন্ট সহকারে বৈঠক করে। এই আলোচনাতেই সম্ভবত বুদ্ধিজীবিদের হত্যার মূল পরিকল্পনা করা হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* এ.এন.এম. মুনির চৌধুরী
* ডা: জি.সি. দেব
* মুফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী
* আনোয়ার পাশা
* জোতীর্ময় গুহ ঠাকুর
* আব্দুল মুক্তাদীর
* এস.এম. রাশিদুল হাসান
* ডা: এ.এন.এম ফাইজুল মাহি
* ফজলুর রহমান খান
* এ.এন.এম মনিরুজ্জামান
* ডা: সেরাজুল হক খান
* ডা: শাহাদাত আলী
* ডা: এম.এ. খায়ের
* এ.আর. খান কাদিম
* মোহাম্মদ সাদিক
* শারাফত আলী
* গিয়াসউদ্দিন আহমেদ
* আনন্দ পবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* প্রফেসর কাইয়ূম
* হাবিবুর রহমান
* শ্রী সুখ রঞ্জন সমদ্দার
এম.সি.এ
* মশিউর রহমান
* আমজাদ হোসেন
* আমিনুদ্দিন
* নাজমুল হক সরকার
* আব্দুল হক
* সৈয়দ আনোয়ার আলী
* এ.কে. সর্দার
সাংবাদিক
* সিরাজুদ্দিন হোসেন
* শহীদুল্লাহ কায়সার
* খন্দকার আবু তালেব
* নিজামুদ্দিন আহমেদ
* এ.এন.এম. গোলাম মোস্তফা
* শহীদ সাবের
* সরকার আব্দুল মান্নান (লাদু)
* নাজমুল হক
* এম. আখতার
* আব্দুল বাশার
* চিশতী হেলালুর রহমান
* শিবসাধন চক্রবর্তী
* সেলিনা আখতার
চিকিৎসক
* মো: ফজলে রাব্বী
* আব্দুল আলীম চৌধুরী
* সামসুদ্দিন আহমেদ
* আজহারুল কবীর
* সোলায়মান খান
* কায়সার উদ্দিন
* মনসুর আলী
* গোলাম মর্তোজা
* হাফেজ উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
* আব্দুল জব্বার
* এস.কে. লাল
* হেম চন্দ্র বসাক
* কাজী ওবায়দুল হক
* আল-হাজ্ব মমতাজউদ্দিন
* ঘাশিময় হাযরা
* নড়েন ঘোষ
* জিকরুল হক
* শামসুল হক
* এম. ওহমান
* এ. গফুর
* মনসুর আলী
* এস.কে সেন
* মফিজউদ্দিন
* আমূল কুমার চক্রবর্তী
* আতিকুর রহমান
* গোলাম সারওয়ার
* এর.সি. দাস
* মিহির কুমার সেন
* সালেহ আহমেদ
* অনীল কুমার সিনহা
* গুনীল চন্দ্র শর্মা
* এ.কে.এম. গোলাম মোস্তফা
* মাকবুল আহমেদ
* এনামুল হক
* এনসুর (কানু)
* আশরাফ আলী তালুকদার
* লেফ: জিয়াউর রহমান
* লেফ.ক. জাহাঙ্গীর
* বাদল আলম
* লেফ: ক. হাই
* মেজর রেজাউর রহমান
* মেজর নাজমুল ইসলাম
* আসাদুল হক
* নাজির উদ্দিন
* লেফ: নুরুল ইসলাম
* কাজল ভাদ্র
* মনসুর উদ্দিন
শিক্ষাবিদ
* জহির রায়হান
* পূর্নেন্দু দস্তিদর
* ফেরদৌস দৌলা
* ইন্দু সাহা
* মেহেরুন্নিসা
শিল্পী ও পেশাজীবি
আলতাফ মাহমুদ
দানবীর রানাদা প্রসাদ সাহা
জোগেষ চন্দ্র ঘোষ
ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত
সামসুজ্জামান
মাহবুব আহমেদ
খুরশিদ আলম
নজরুল ইসলাম
মাহফুজুল হক চৌধুরী
মহসিন আলী
মুজিবুল হক
--------------
তথ্যসূত্র :
১. জেনোসাইড বাংলাদেশ
২. বিদ্রোহী