যুদ্ধাপরাধ কি ?
চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ১৪৭ অনুচ্ছেদে যুদ্ধাপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, ”ইচ্ছাকৃত হত্যা, অত্যাচার অথবা অমানবিক আচরণ যেমন ইচ্ছাকৃত ভাবে শারীরিক আঘাত, আইনবিরোধী ভাবে কাউকে বন্দী করা অথবা জোরপূর্বক কোন ব্যক্তিকে নিষ্ঠুর কাজে নিয়োজিত করা অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে মানবাধিকার লংঘন করা, ... কোন রকম কারণ দর্শানো ছাড়াই এবং অবৈধভাবে কারো সম্পদের বৃহৎ ক্ষতি সাধন অথবা অপব্যবহার করা ”
যুদ্ধাপরাধের মূল ধারণা এই যে, কাউকে দায়ী করা যাবে পুরো দেশে অথবা দেশের সৈন্যদের সাথে সংগঠিত কার্যকলাপের জন্য। গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধারণ মানুষ বা যোদ্ধাদের সাথে অমানবিক আচরণ - এসবই যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তন্মধ্যে গণহত্যা সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম অপরাধ ।
১৯৭১ -এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, পাকিস্থানি সৈন্য বাহিনী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ও সহকর্মীদের নেতৃত্বে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ বিরোধী চক্রের (জামাত, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য কিছু ধর্মীয় রাজনৈতিক দল) সহায়তায় প্রায় ৩ মিলিয়ন নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়, নির্যাতন এবং ধর্ষণ করা হয় প্রায় ৪,৫০,০০০ বাঙালি মহিলাদের এবং বাঙালির বিজয়ের প্রাক্কালে শত শত বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয় এই জাতিকে মেধাগত ভাবে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য । এই অনাচার সীমা ছাড়িয়ে যায় হিটলার, মিলোসেভিক (Slobodan Milosevic ), নাজিস এবং ফ্যাসিস্টদের (the nazis and the fascists) অত্যাচারকেও ।
যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার
রাজাকার শব্দটি মূলত একটি আরবী শব্দ যার অর্থ স্বেচ্ছাসেবক ।(উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেখা যায়, রাজাকার একটি পারসিয়ান অর্থ্যাৎ ফার্সী শব্দ ) ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজাকার হলো সেইসব স্বেচ্ছাসেবক যারা ইসলামিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজাকার অর্থ দেশদ্রোহী বা পাক-বাহিনীর সহযোগী (Collaborators) যারা ১৯৭১ -এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-বাহিনীকে সহায়তা করেছিল লাখ লাখ বাঙালিকে চিহ্নিতকরণ এবং হত্যাযজ্ঞে । রাজাকারেরা মূলত মুসলিম লীগ, জামাত-ই-ইসলামি এবং ধর্ম ভিত্তিক অন্যান্য কিছু দলের সদস্যবৃন্দরাই ছিল ।
”রাজাকারেরা...মূলত সাহায্য করবে গ্রামাঞ্চলে, যারা চিহ্নিত করতে পারবে মুক্তিযোদ্ধাদের”, একজন পাকিস্তানি আর্মি অফিসারের ভাষ্য; সরকার ইতিমধ্যে পরিকল্পনামাফিক ৩৫,০০০ এর মধ্যে ২২,০০০ রাজাকার নিয়োজিত করেছে । [নিউ ইয়র্ক টাইমস, জুলাই ৩০, ১৯৭১]
এক নজরে :৭১ –এ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র
সাধারণ আর্মি - ৮০,০০০
র্যাঞ্জার এবং মিলিশিয়া - ২৪,০০০
সিভিলিয়ান ফোর্স - ২৪,০০০
রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস – ৫০,০০০ (প্রায়)
স্থানীয় সহযোগী
শান্তি কমিটি
স্থাপিত : এপ্রিল ১৯৭১
আহ্বায়ক – খাজা খায়রুদ্দিন
ব্যবস্থাপক – প্রফেসর গোলাম আযম, এ.কিউ.এম. শফিকুল ইসলাম, মওলানা সৈয়দ মাসুম
রাজাকার
স্থাপিত : মে ১৯৭১ (খুলনা)
ঘোষিত : জুন ১৯৭১
আহ্বায়ক : মওলানা এ.কে.এম. ইউসূফ
পরিচালক : এ.এস.এম জহিরুল হক
আল-বদর, আল-শামস
ইসলামিক ছাত্র সংঘের সদস্যবৃন্দদের সমন্বয়ে, পাক বাহিনী সাথে জড়িত জামাত-ই-ইসলামী ছাত্র গোষ্ঠিদের খুনী দল- হিটলারের এস.এস. (SS of Hitler ) অনুরূপ ।
মিলিটারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তথ্যানুসারে, সেসময় ৫০০০ রাজাকার ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, তার মধ্যে ৩০০ ছিল খুলনা জেলায়। তাদেরকে দিনে তিন টাকা করে দেয়া হতো (২৫ পয়সা করে অফিসিয়ালি ধার্য ছিল) এবং সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো যা মূলত ছিল কিভাবে Lee-Enfield রাইফেল চালনা করতে হয় । তাদের কাজ ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন করা- পশ্চিম পাক বাহিনী দলকে বিশেষত আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঘর-বাড়ি চিনিয়ে দেয়া । এই সব রাজাকারেরা মূলত স্থানীয় শান্তি কমিটির আজ্ঞাবাহী ছিল, যা অবশ্যই নির্ধারিত হতো পাকিস্থানের প্রতি বিশ্বস্ততার নিরিখে।
যুদ্ধচলাকালীন সময়ে রাজাকারেরা -
১. মুক্তিবাহিনী, তাদের সমর্থক এবং সহানূভূতিজ্ঞাপন কারিদের বিরুমেন্ত্রন্ত্রণা দিত
২. অপহরণ, বন্দী এবং পরিশেষে হত্যা করত পাকবাহিনী কিনবা দলীয় কর্মীদের সহায়তায় তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে বা হত্যা কেন্দ্রে ।
৩. ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিত এবং অবাধ লুটতরাজ করত
৪. অপরহন করেছিল হাজার হাজার রাঙালি মহিলাদেও এবং তুলে দিয়েছিল পাকিস্থানী মিলিটারি বাহিনীর হাতে
৫. নির্যাতন এবং ধর্ষণ করেছিল ৪,৫০,০০০ বাঙালি মহিলাদের
শীর্ষ রাজাকার তালিকা
মওলানা ওয়াদুদ,
গোলাম আযম ,
আব্দুল মান্নান,
মতিউর রহমান নিজামী ,
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ,
দেলোয়ার হোসেন সাঈদী,
মইনুদ্দিন চৌধুরী,
আনোয়ার জাহিদ,
ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী,
আব্বাস আলী খান,
মুহাম্মদ কামরুজ্জামান,
আব্দুল আলীম,
আব্দুল কাদের মোল্লা,
এ.এস.এম. সোলায়মান,
মওলানা আব্দুস সোবহান,
মওলানা এ.কে.এম. ইউসূফ,
মওলানা এস.এফ. ফাজলুল কারিম,
মোহাম্মদ আয়েন উদ্দিন,
এ.বি.এম. খালেক মজুমদার,
আশরাফুজ্জামান খান,
ড: সাঈদ সাজ্জাদ হোসেইন
প্রসংগ : সাধারণ ক্ষমা
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে, আওয়ামী লীগ সরকার বেশীর ভাগ রাজাকারদের হাজতে নিতে সক্ষম হয়। হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধী বঙ্গবন্ধু হত্যার এবং জিয়া’র ক্ষমতা দখলের পূর্বে কারাগারেই ছিল । অনেকেই ধারণা করে থাকে, বঙ্গবন্ধু সার্বজনীনভাবে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেছিলেন, যা প্রকৃতপক্ষে সত্য নয় । বরং আভ্যন্তরীর চাপে (মওলানা ভাসানী) এবং বৈদেশিক চাপের (আমেরিকা, সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশ) মুখে শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমার আওতায় কিছু সাধারণ অপরাধের রাজাকারদের মুক্তি দেন ।
বঙ্গবন্ধু শীর্ষ রাজাকারদের কখনই ক্ষমা করেননি। সেসময় জামাত-ই-ইসলামির নেতা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় । গোলাম আযমকে পাকিস্তানে আশ্রয় নিতে হয়েছিল । অন্যান্য শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ হয় কারাগারে বিচারের আওতাধীন ছিল নয়তো পাকিস্তানের আশ্রয়ে ছিল।
শেখ মুজিবের হত্যার পর পুরো রাজনৈতিক পটভূমিতে পরিবর্তন আসে। শাসক জিয়া গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পূণর্বহাল করেন; এমনকি তিনি গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। সেই সাথে মুক্তি দেন সকল রাজাকারদের এবং অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীদের । এমনকি সংবিধানের পরিমার্জনা করে তাদের জন্য রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করেন ।
অস্বীকার থেকে উপলব্ধী
পাক বাহিনী কর্তৃক গঠিত, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং বেতনভুক্ত রাজাকারদের ভুলে যাওয়া কখনই উচিৎ হবে না এবং এরা ভবিষ্যতে গণহত্যার বিচার কার্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ।
১৯৭১ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ইতিহাস আজকে এইসব হত্যাকারী রাজাকারদের নির্লজ্জ অস্বীকারের কারণে হুমকির সম্মুখীন। এর ফলশ্রুতিতে দেশের যুব-সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি না আমাদের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমরাই কোন পদক্ষেপ না গ্রহণ করি।
*** *** ***
তথ্যসূত্র :
১. জেনোসাইড বাংলাদেশ
২. মুক্তধারা
৩. ঘাতক দালাল