স্বল্প বা দীর্ঘ, প্রবাস জীবন যতটুকু সময়েরই হোক না কেন, দেশ থেকে কেউ আসবে জানলে সবার খুবই ছোট্ট ছোট্ট চাহিদাগুলো, আব্দার বললে ভাল শোনাবে হয়ত, শুনলে বড় মায়া লাগে।আব্দারের তালিকায় উঠে আসে সন্দেশ, লাড্ডু, বইমেলা থেকে হুমায়ুনের বই এর সাথে "অপর বাস্তব", বাঙলা গানের সিডি; কারো আবার আমের আচার তো কারো রসুনের আচার । তালিকানুযায়ী সব এক এক করে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম ব্যাগে। দেশে থাকা স্বজনরাও সাথে কিছু দিয়ে দিতে চায় বিদেশে অবস্থানরত তাদের প্রিয়জনদের জন্য। যেমন, আমার এক পুরোন সহকর্মী কুয়ালালামপুরে এক নামকরা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে; ওর হাসব্যান্ড আছেন দেশে। ভদ্রলোক একদিন দেখা করে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন, হাতে নিয়ে যতটুকু মনে হলো সালোয়ার কামিজ।
ভিসা, অফিস থেকে ছুটি নেয়া, কেনাকাটা- প্রতিদিন একটু একটু করে সেরে নিলাম। ব্লগারদের ২১ তারিখের বিকালের আড্ডাটা মিস্ করলাম রাতের ফ্লাইটের কারনে। রাত ১:৪০ এ ফ্লাইট, মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্স ; আগেরবারও তাই ছিল। প্রায় ১১টার দিকে জিয়া (জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট)'তে পৌছে গেলাম। ক্যাব ঢালু সিড়ি দিয়ে উপরের টার্মিনালের দিকে হালকা গতিতে যাচ্ছিল, পুলিশ গাড়ি থামিয়ে, জানালার সমান্তরালে মুখ নামিয়ে বলল, "যাত্রী ছাড়া বাকীরা নেমে যান, শুধু যাত্রীই ক্যাব নিয়ে উপর পর্যন্ত যেতে পারবে বাকীরা হেঁটে" । সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এবং আমরা সবাই নেমে পড়লাম ক্যাব থেকে। ছোট্ট একটা তর্ক করল আব্বা । ওদের ভাষ্য ছিল, আজকাল একটু নিয়মকানুন আরোপিত হয়েছে, তবে শুধু মহিলা যাত্রী বুঝলে তারা এভাবে বলতনা। এর মাঝে আরেকটা ক্যাব গতি না কমিয়ে হুশ করে উপরে উঠে গেল; পুলিশগুলো হা করে দাঁড়িয়ে। আব্বা সেদিকে হাত তুলে দেখিয়ে হালকা খোঁচা দিতে ছাড়লনা।
আমরা হেঁটেই উপরে উঠে আসলাম। এবার আরেক নিয়ম এর মুখোমুখি । আগেরবার আমি ভেতরে গেলে আব্বা-আম্মা-ভাইয়া কাঁচের গ্লাসের এপাশ থেকে যতক্ষণ, যতদূর দেখা যায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এবার সে পর্যন্ত যাওয়া যাবে না; আরেক নিয়ম। অনেকেই দেখি বিরক্ত । একজন বলেই বসলেন, "খালি নিজের দেশ, জন্মভূমি বলেই... না হলে এই দেশে কোন কিছুতেই হয়রানি ছাড়া শান্তি পেলাম না..." ।
আমি বিদায় নিয়ে ভেতরের দিকে যাওয়া শুরু করলাম । মায়েদের ক্ষেত্রে বোধহয় তাবত নিয়ম কানুন শিথিল হয়ে যায় । আম্মাকে খানিকটা ভেতরে যেতে দেয়া হলো। আম্মা আগেরবারের মত সেই কাঁচের এপাশ থেকে আমাকে দেখতে থাকলেন।
মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্স ৩২ কেজি পর্যন্ত লাগেজ বহন করতে দেয় এটা জানলাম বোর্ডিং পাসের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে। আমি বেশ মাপঝোক করে লাগেজ এনেছিলাম যাতে মাঝরাতে কোন ঝামেলা না হয়। (স্যরি, সারিয়া আপু, আগে জানলে আপনার প্যাকেটটাও নিয়ে আসা যেত...তবে যেমন বলেছি, "নেক্সট টাইম"...যদিও জানিনা সেই নেক্সট টাইম আগামী ১০ বছরেও আর আসবে কিনা ! )
ইমিগ্রেশনের নিয়ম-কানুন পার হতে বেশ ঝামেলা হলো ; দু'জন অফিসার বেশ ভাব নিয়ে এসে পাসপোর্ট দেখল। কাউন্টারের অফিসার কাগজপত্র দেখে আবার আরেকজনকে দেখিয়ে বলে, "ট্যুরিস্ট ভিসা, আগেও একবার গিয়েছিল..." । ক'দিন আগে আমার সহকর্মী অফিসের কাজে একদিনের জন্য বাহরাইন গিয়েছিল; বেচারীর প্রথম বিদেশ ভ্রমনে ইমিগ্রেশনে এমনভাবে আটকে গিয়েছিল যে যাওয়াটা নাকি বাতিলই হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। আমাকে এক সিনিয়র মহিলা অফিসারের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। মাঝরাতের এইসব টানাহেঁচড়া সয্য হচ্ছিলনা; আমি পুরোপুরিই বিরক্ত এবং তা অবলীলায় আমার গলার স্বরে প্রকাশ করলাম । কি, কেন, কোথায় এইসব প্রশ্নের উত্তর শুনে মহিলা অফিসার আমার সাথের অফিসারকে বললেন, "আমার মনে হয় ছেড়ে দেন..." । কেমন জানি অপমান লাগল কথাটাতে; "ছেড়ে দেন" মানে কি ! আমি কি আটকানো ছিলাম তাহলে!!! কেউ কেউ বলে আমার চেহারা নাকি "ভাজা মাছ উল্টেপাল্টে খেতে পারে না" টাইপ; সেটা নিয়ে আমার নিজেরই এখন সন্দেহ হলো । কারন কত রাঘব-বোয়াল ফসকে যায় আর আমি চুনোপুঁটি মাঝরাতে একগাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হই ! কাউন্টারের কাছে ফিরে আসার সময় আমি বেশ একটু ক্ষোভ প্রকাশ করতেই সাথের অফিসার বললেন, "ম্যাডাম, আসলে ইদানীং একটু কড়াকড়ি করা হয়েছে..." ।
ইমিগ্রশনের ঝামেলা শেষ করে একটুক্ষণ বসতে হলো; তারপর কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো, তারপর ফ্লাইটের সময় পর্যন্ত আবারও ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা । আব্বা-আম্মা ততক্ষনে বাসায় পৌছে গেছে; আমি মাঝে মাঝেই ফোনে তাদের আপডেট দিচ্ছিলাম । অবশেষে ব্রীজ পার হয়ে প্লেনের ভেতরে প্রবেশ; বোর্ডিং পাস নেয়ার সময় কাউন্টারে বলেছিলাম উইন্ডো সিট দিতে । ডাবল সিট তবে ঠিক জানালার পাশেরটা পাইনি দেখে মনটা খারাপ হলো । আগের বার যাওয়ার সময় সাথে সদ্য পরিচিত ছোট ভাই টাইপ এক বন্ধু ছিল- মোসাদ্দেক; আমাদের যাত্রা উদ্দেশ্যও এক ছিল । দেশে ফেরার সময় আমার পাশের সিট খালি ছিল । এবার পাশে কে বসবে কে জানে ! এবার শেষ পর্যন্ত এক মেয়ে এসে বসল; গন্তব্যস্থল আমেরিকা । প্লেনে উঠে শেষবারের মত আব্বা-আম্মার সাথে কথা বলে ফোনটা অফ করে দিতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ।
টেকনিক্যাল কিনবা সাধারণ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকায় বিমান উড্ডয়নের নাটকীয় বর্ননা দিতে পারছিনা। তবে গতবার কানে প্রবল চাপ পড়েছিল সেটা আর এবার অনুভব করলাম না তেমন । আমার সামনের সিট দু'টো খালি দেখে আমি চটজলদি সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে গেলাম । জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে আলো-আঁধারিতে মায়াময়, রহস্যময় রাতের ঢাকা দেখলাম। মাস্ (মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্স সার্ভিস) এর দিনের ফ্লাইট নেই; তাই দিনের আলোতে নিজের পরিচিত শহরটাকে উপর থেকে দেখার শখটা এবারও পুরণ হলোনা।
ওদিকে তেমন কিছু খেয়ে আসিনি বলে পেটে পুরোদস্তর ছুঁচোর নাচন শুরু হয়ে গেছে। আমি খাবারের জন্য হা করে বসে থাকলাম । একটা কড়া গন্ধে পেটটা ভয়ানক মোচড় দিয়ে উঠল; মাথা-ঘাড় ঘুরিয়ে কোনাকুনি বসে থাকা এক চাইনিজের সামনে বিয়ারের ক্যান দেখলাম (এই ব্যাটা গিলেছিল অনেক...) । অবশেষে খাবারের ট্রলি দেখা গেল। খুব সুন্দর করে জিগেষ করা হলো "ভেজ" নাকি "নন-ভেজ"। "নন-ভেজ" সার্ভ করা হলো- ভাত, বেগুণের তরকারী, পাঠার মাংস ভুনা, সালাদ, এক টুকরা ফল (গন্ধের কারনে আমি ভেবেছিলাম এটা মালয়শিয়ান ফল ডুরিয়ান, তবে পরে শুনলাম প্লেনে নাকি ডুরিয়ান নিষিদ্ধ; অবশ্যই গন্ধের কারনে)। আগেই বলেছি, প্রচন্ড ক্ষুধার্থ ছিলাম, তাড়াহুড়ো করে খাবার মুখে দিতেই মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল। আগেরবারের খাবার ভালই লেগেছিল, আর বেশ কয়েক মাস থাকার কারনে আমি মালয় খাবারের সাথে কম-বেশী অভ্যস্ত ছিলাম । কিন্তু এবার আর কিছুতেই গলাধ:করণ করা গেল না ; অগ্যতা রেখে দিলাম ; সামনের সিটের পেছনের অংশটার সাথে সাঁটা ছোট্ট মনিটরে চলতে থাকা মুভিতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম, তবে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল দেখে গায়ে বিমানের দু'টো চাদর জড়িয়ে চোখ বুঁজলাম ঘুম দেবার জন্য।
ঘুম ভাঙল গন্তব্যে পৌঁছনোর পর । বিমান থেকে নেমে তৃতীয়বারের মত পা দিলাম মালয়শিয়ান এয়ারপোর্টের চকচকে মেঝেতে; বেশ খানিকটা হেঁটে দিকনির্দেশনামত ইমিগ্রেশন কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ালাম (৭:২৬ পার হয়েছে ততক্ষণে) । মনে মনে ভাবলাম এখানে না জানি আবার কত-শত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় ! আমার পাশের কাউন্টারে টুরিস্ট ভিসায় আগত এক বাঙালীকে হালকা পাতলা প্রশ্ন করা হচ্ছিল (সাথে কত ডলার আছে, কোথায় উঠবে এইসব) দেখে আমিও প্রস্তুত হয়ে গেলাম । কিন্তু মহিলা ইমিগ্রেশন অফিসার আমার দিকে একবার তাকিয়ে পাসপোর্টে দরকারী ছাপ মেরে আমার মালয়শিয়ায় প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন বিনা বাক্য ব্যয়ে।
চোখে-মুখে হালকা পানির ঝাপটা দিয়ে সাথের লাগেজ দু'টো নিতে গেলাম । ধীর গতিতে ঘুর্ণায়মান চওড়া বেল্টের উপর রাখা সবার লাগেজগুলো এক এক করে চোখের সামনে দিয়ে পার হয়ে আবার ফিরে ফিরে আসতে লাগল । আমার সবসময়ই মনে হয় একসাথে অনেক লাগেজের ভিড়ে নিজেরটা চিনবনা, তাই সাবধানী হয়ে লাগেজের উপর নিজের নামের ট্যাগ বসিয়ে নিয়েছিলাম । যাই হোক, লাগেজগুলো ঠিক মতই পেলাম । লাগেজের ওখানেই একজন বাঙালী কাজ করছিল দেখলাম । আমাকে দেখে জিগেষ করল , "ঢাকা...?" । আমি মাথা নাড়লাম । আমার পরবর্তী কাজ ছিল কেলিয়া (KLIA) এক্সপ্রেসে (ট্রেন সার্ভিস) করে কে.এল (KL) সেন্ট্রাল পৌছনো। এই লোককে জিগেষ করেই জেনে নিলাম কোন দিকে গেল ট্রেন পাব ।
তবে বিমান বন্দরে দিকনির্দেশনাগুলো এমন দরকারমত এবং চোখে পড়ার মত জায়গাতে থাকে যে কাউকে জিগেষই করতে হয়না আসলে। আমি ঠিকমতই কেলিয়া (KLIA) এক্সপ্রেস টিকেট কাউন্টারের সামনে পৌছে ৩৫ রিংগিত দিয়ে টিকেট নিলাম। পরে জেনেছিলাম বিমান বন্দর থেকে কে.এল (KL) সেন্ট্রাল রুটে বাস সার্ভিসও আছে, ১০ রিংগিত লাগে মাত্র। একটু দ্বিধায় সামনে দাঁড়ানো ট্রেনটা ছুটে গেল। অবশ্য হালকা এসি, চকচকে মেঝে, নানান বেশভূষার বিভিন্ন দেশীয় লোকজনের মাঝে বসে থাকতে খারাপ লাগছিলনা। বোধহয় ৫ মিনিটের মাথায়ই ট্রেন এলো , এই প্রথম কেলিয়া (KLIA) এক্সপ্রেসে পা রাখলাম। ট্রেনের ভেতর মালপত্র রাখার জায়গা আছে, সিটের সামনের দিকে ঝুলানো মনিটরে চলছে লেটেস্ট খবর আর পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থানগুলোর ঝলক । পাহাড়, সারি সারি পাম গাছ পাশ কাটিয়ে ২৮ মিনিটের ট্রেন যাত্রা আমাকে পৌছে দিল কে.এল (KL) সেন্ট্রাল, যাকে "ট্রান্সপোর্ট হাব" বলা হয়।
প্লাটফর্ম পার হয়ে অটোমেটেড মেশিনে হাতের টিকেট প্রবেশ করাতেই হাঁটুর সামনে থেকে ছোট্ট স্লাইডের মত গেট খুলে গিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার অনুমতি দেয়। ততক্ষণে অনেক অপরিচিতের ভিড়ে চোখ খুঁজে পেয়েছে পরিচিত মুখ। কাউন্টার থেকে টোকেন নিয়ে বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি নিতে হলো। জানালার দু'পাশ দিয়ে পরিচিত, অপরিচিত রাস্তা সরে যেতে লাগল । খানিকটা যাত্রা পথের ক্লান্তি, চেনা-অচেনার দোলাচল, একটু বিস্ময়, একটু অন্যরকম ভাললাগা অনুভুতি- সব মিলিয়ে আমি হালকা উত্তেজনার স্বরে বলেই ফেললাম , "হেই, আই এ্যাম ইন মালয়শিয়া এ্যগেইন....!!!" ।