জীবন্যাস
দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু
গত দুইদিন অথবা দুই শত বছর যদিও তুমি পিরামিডের মতো স্থির থাকতে চেয়েছে, ভেতরে অনুভূত হয়েছে ফেরাউনের মমির কম্পন। মরুতাপে উচ্চকিত ধ্বনি বারবার মিশে গেছে বারির প্রপাতে- খু ফু রে, রে ফেরাউন... ঈষৎ হেঁটে যাওয়া মমির ভেতর ঢুকে পড়েছে কয়েকটি উইপোকা; তোমার মনে পড়েছে শৈশবের ইতিহাস বইয়ের সবুজ মলাটটির কথা। গত দুইদিন তুমি স্থির থাকতে চেয়েছ অথচ দেখলে তাড়া খাওয়া পূর্ণিমা হঠাৎ ঢুকে পড়েছে তোমাদের কলাপসিবল গেটের ভেতর- আহারে জ্যৌৎস্নী! এমন সুন্দরী রাতে কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করে। তুমি ভাব, সুন্দরী চৌঠায় নদীটি যেভাবে মারা গেল... আর ঐ যে নারী কোন এক ডুবন্ত বিকেলে বউ হয়ে চলে গেল অদূরের গ্রামে। দূর পর্বতে দৃশ্যমান হলো ঝর্ণাগুলি- শুধু আত্মহত্যা করছে গড়িয়ে গড়িয়ে। রক্তাক্ত তুমি ছায়া সন্ধান কর। দৃশ্যমান হয় ফাল্গুনের চাঁদের আলোয় তোমাদের গ্রামের উঠোনে আড়াআড়ি পড়ে আছে ডালিম ডালটির চিরল ছায়া। বাতাস বইছে ছেঁড়া ছেঁড়া। ছায়াগুলি ছায়ার শিরোচ্ছেদ করছে ধীরে। দেখতে পাও তোমাদের বাগিচা বাজারে লণ্ঠনের নিম আলোয় ইলিশের পেটির মতো চিকচিক করছে ঘাতকের ছোরা। এ দৃশ্যে তুমি নিদ্রা যেতে পার না। বরং শুনতে পাও তোমাদের শিথানের পাশে লাল পাকুড়ে বৃক্ষে বয়স্ক পায়ের আওয়াজ। তারা হাঁটচলা করছে; গুড়ি-কন্দের শব্দ থেঁতলে দিচ্ছে নৈঃশব্দ্য। দৃশ্য উচিয়ে চলে যাও দৃশ্যান্তরে। লোহার গালিচায় বিষণœ বালিকারা বসে আছে। তাহাদের হাতে নীল নয়নের নুড়ি। বুঝে উঠতে সামান্য সময় লাগে- বালিকারা কোটর হতে চক্ষুদ্বয় খুলে ফেলেছে, বালিকাদের হাতে এখন মার্বেলের মাছি; তারা চক্ষু খেলায় মনোযোগী হয়- দক্তা এক, দক্তা দুই.. .নির্ঘুম সারারাত ভাবিত হও ঐ বনমর্মর আর হরপ্পা নদীর নির্মাণ শৈলী নিয়ে। তোমার হাতের কাছে প্যারামাকন, পাখিদের ঠোঁট; তোমার হাতের পাশে ম্রিয়মাণ খাগড়ার কলম ছিল। যুদ্ধ করেছ সারারাত অথচ কিছুই লিখতে পারনি। তাকিয়েছ হাতের কৈশিক শিরা উপশিরা আর রক্তপ্রবাহের দিকে। হস্তদ্বয় গুটিয়ে গেছে কেঁচোর মতো। তোমার হাতে রঙিন কোন কমলা নেই; শিশিরের স্তন নেই। আপাতত তোমার কোন হাত নেই; পৃথিবীতে আর কোন হাতের অ¯িতত্ব নেই। তোমার চোখ নেই, কান নেই; তোমার চারপাশে মুণ্ডুহীন জোলেখা সুন্দরী কুহু কুহু রবে... তুমি তাকিয়েছ দূরতম দেশের দিকে- ঐ দেশে কিছুই নাই, বন্যাকবলিত পিতার কবর ব্যতিরেকে। তোমার ঘাড়ের ডানদিকে শিলং শহর। কে যেন বলে যায়- ঐ শহরে সরকারী দিঘিতে একটা নীলপদ্ম ফুটেছে; আর যে নারী যুবতী, তার জানালায় সামান্য ঝুলে পড়েছে জুঁই আর শেফালির ঝোঁপ, বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরাতেই তুমি বিমর্ষ হও। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলা আলোর ভেতর একপাল জন্মান্ধ পতঙ্গ উড়ছে, উড়ছে.. .
যে তোমার বন্ধু ছিল । প্রিয় কিশোয়ার এখন মৃত্যুর রাজা.. .
... সুবে সাদিক ভরা মাঠ। অশ্বারোহী তুমি যাচ্ছ প্রভাতের দিকে। দূর গাঁয়ে ঝুলে আছে কুয়াশার রেখা। শিশির শিক্ত মাঠে হৃদকম্পন থেকে থেকেই শুনতে পাচ্ছ তুমি। আর দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে অচিন পশুদের মগ্নতার শীৎকার। দুরন্ত তোমার হস্তদ্বয়কে যেন ঝাপটে ধরে হঠাৎ প্রাণপণ যুদ্ধ করো তুমি। কিছুতেই মুক্ত হতে পারো না। সে এক কালো মানুষের হাত, দু’হাতে কব্জি তার.. .শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখো- লাল ঘোড়াটি তোমায় ফেলে রেখে কুয়াশার গ্রামে মিলিয়ে গেল।
কোন এক শাকিলা পাখির ডাকে তুমি ইচ্ছে করলেই এখন তুমি জেগে উঠতে পার না। এখন তুমি আর কেউ না। অথচ একদিন ছায়ার ঘনত্ব খুঁজতে যেয়ে লুকিয়ে পরেছিলে ঝুনা নারকেলের পেটের ভেতর নারকেলের ভেতরে জল; আসলে জল নয় মেঘের মগজ। তুমি বসে থাকলে ফলের পূর্ণিমায়। নিজকে মনে হলো অনেক অনেক কুচবর্ণ অথচ অভিজ্ঞ, প্রাচীন শিলাখণ্ডের মতো; মনে হলো তুমি এক কুকুাপণ্ডিত, বসে আছো কুকাশাস্ত্র হাতে; দুই কাঁধে দুইখণ্ড অজগর যাদের রয়েছে নয়শত মাথা। মাঝে মাঝে উলঙ্গ দুপুরে তুমি আসন পেতেছ নীল নদের তীরে। প্রাচীন গুণীন তুমি, উড়ন্ত কবুতর দুইখণ্ড করে প্রেয়সীর পায়ের কাছে ফেলে দিয়েছিলে। আর ঘর্মাক্ত তুমি শিশির খুঁজেছিল নারী সর্বংসহার বুকের গহীনে।
সময় চলে গেছে; মহাকালের হা করা গর্তের ভেতর সময় অনেক তো চলে গেছে। বহুবর্ষ আগে ঐ সুবে সাদিকের মাঠে তোমায় চেপে ধরেছিল ঐ যে হস্তদ্বয়, থামিয়ে দিয়েছিল রথ যাত্রা তোমার, পাঁজর ফুঁড়ে সর্বভূক যে শেকরগুলি মুখের দিকে ধাবমান তা হলো বৃক্ষের দাঁত, জিহ্বাবলী। ঠিক দুইদিন নয়, দুইহাজার বছর ধরে তুমি মানুষ নও; তুমি মূলত বৃক্ষের আহার।