বদ্ধ কাঁচের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পিছলে যায় প্রাণীগুলোর শরীর। মেরুদণ্ডহীন শরীরটাকে বাঁকিয়ে আবার দেয়ালে ঘষা দেয়। টলটলে জলের ভেতর কালো কুচকুচে টোপা টোপা শরীরর তাদের। সেদিকে তাকিয়ে বিজাতীয় ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠে পারভীনের। বাসরঘরে ফুল নয়, লতাপাতা নয়। ঘরভর্তি বারো চৌদ্দটা আজব প্রাণীভর্তি কাঁচের বয়াম। আতঙ্কে আর ঘৃণায় তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়
কি এই গুলা?'
নতুন বউয়ের অজ্ঞতায় যেন খুবই আনন্দ পায় কদম রসুল। গ্রামের মাইয়া হইয়া জোঁক চিন না! এই গুলা হইল জোঁক।কবিরাজী ওষুধ বানাইতে হয়...। কদমরসুল বাক্যটা শেষ করে না। এ এলাকায় কবিরাজ হিসাবে কদমরসুলের খুবই নামডাক। এটা পারভীনও জানে। জানে তার মতো আরো জানে তার মতো আরো অনেকেই। কিন্তু জানলে কি হইব। ঘরের মধ্যে এমুন বিদঘুইট্যা প্রাণীর সঙ্গে রাত কাটাতে হবে তা কি সে জানত?
পারভীন আরেকবার ভাল করে বয়ামগুলো দিকে তাকায়। গা ঘিন ঘিনে ভাব তৈরি হয় তার মধ্যে এইগুলা জোঁক? ছি! এতো বড় জোঁক হয় নাকি! এ গুলান দিয় কি হয়? কদমরসুল নতুন বউয়ের কানে কানে জোঁকগুলো রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে। নতুন বউয়ের কান গরম হয়ে যায়। আর একবার সে জোঁকভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকায়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। এদের সরাতেই হবে।
জোঁকগুলা এইখানে রাখন যাইব না।' পারভীনের দৃঢ় কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে যায় সে।
ক্যান এই ঘরে থাকলে অসুবিধা কি?
অসুবিধা আছে। তুমি এই গুলারে ঐ ঘরে থুইয়া আসো।'
এইডা কি কও তুমি? এই গুলাই তো আমাগো জীবন। অন্যঘরে রাখলে চুরি হইয়া যাইব।'
কেউ তোমার ঐ জোঁক চুরি করতে আইব না। আর তুমিও এই জোঁকের ব্যবসা ছাইড় দেও। দুনিয়াতে কতো কাম আছে। তা না জোঁকের ব্যবসা।'
আমার জোঁকের ব্যবসা না। আমি হইলাম কবিরাজ।'
ঐ একই হইল। মাইনষে জিগাইলে কওন যাইব না কিসের কবিরাজী করো তুমি।'
বাসর ঘরে এইরকম পরিস্থিতির জন্য মোটেও তৈরি ছিল না সে। নতুন বউ এতো কথা কয়! কদমরসুল মুখে কিছু বলে না। বয়ামগুলো একটা একটা করে পাশের ঘরে রেখে আসে। খুব কষ্ট হয় তার। এতাদিন তারা একসঙ্গে ছিল। এখন বলে অন্য ঘরে রাখতে হইব। খালি মনে হয় তার জিনিসে অন্যে ভাগ বসাইছে। আল্লঅয় বাঁচাইছে তার মা বইন নাই। নইলে পয়লা রাইতেই কইত তোমার মা বইনের লগে থাকুম না।
কদমরসুল অবশ্য আগে কবিরাজী করত না। পুরোদস্তুর কবরাজ হিসেবে দমরসুলের অভিষেক হয় এই হরিনঞাটা গ্রামেই। এগ শহরের ওস্তাদের সঙসঙ্গে সঙ্গে থাকত সে। ওস্তাদ তাকে শেখায় কেমন করে কথা বলতে হয়। প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ হলে সে পসরা নিয়ে বের হয়। চৈত্রের মধ্যাহ্নে সবাই যখন ভাতঘুম যাচ্চিল সেই বিরাণ দুপুরে হরিণহাটার লোকজন প্রথম দেখে কদমরসুল কে। ডিএনডি বাঁধের ওপর দিয়ে গ্রামের যে একমাত্র সড়কটি চলে গেছে তার পাশে চট বিছিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে সে। একপাশে একটি টিনের বাক্স। তার ওপর চায়ের ফ্লাক্স। অন্য পাশে ছোটবড় বেশ কিছু কাঁচের বয়াম। বয়ামের ভেতর অদ্বুত দর্শন প্রাণী। তাদের পিচ্ছিল শরীর কাঁচের বয়ামে ঘষা খায়। নদীর পাড়ে গ্রাম হওয়া স্বত্তেও তারা এমন প্রাণী দেকেছে কিনা মনে করতে পারে না। কেননা তাদের দেখা কোন প্রাণীর সঙ্গেই এগুলোর মেলে না। লোকজন ফিসফিস করে।
কী এইগুলা! দেখলেই শরীর গুলাইয়া ওঠে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ কদমরসুলকে প্রশ্নও করে। কদমরসুল নির্বিকার। কারো প্রশ্নেরই সে উত্তর দেয় না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালে। আদা চা লোকজন বিরক্ত হয়।
কেমুন আজব মানুষ। কথা কইলে উত্তর দেয় না। চলো যাই গা।'
আসলে সে অপেক্ষা করছিল ভিড় বাড়ার জন্য। কম লোকের মধ্যে কাজ করে আনন্দ পায় না সে। লোকগুলির চরম ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটলে সে কথা বলে ওঠে। তবে খুব উচ্চস্বরে নয়। তার অনুচ্চ স্বরও সকলে শুনতে পায়। পাতলা হয়ে যাওয়া ভিড় আবার জমে ওঠে। জমতে জমতে কদমরসুল কে ঘিরে এক দূর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে সবাই। যেন তার কথা দেয়াল ভেত করে বাইরে যেতে না পারে। ধীরে ধীরে দিনের আলো ম্রীয়মান হয়।সেই ম্রীয়মান আলোয় জমে ওঠে কদম রসুলের ব্যবসা। আজ যেন একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছে সে। প্রথম দিন বলে কথা। কাল এমন সময় আসবে যেন অন্ধকার নামতে দেরি না হয়। সে জানে দিনের আলোয় গোপন কথা খুব একটা জমে না। মানুষ গোপন কথা শুনতে চায় আড়ালে, অন্ধকারে। পুরুষ মানষের সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গা নিয়ে ব্যবসা তার। সে জানে পুরুষ মানুষ যতই হম্বি তম্বি করুক না কেন মাইয়া মাইনষের কাছে ভিজা বিলাই। আর কোন পুরুষ যদি বউরে খুশী করতে না পারে ত্ইলে তো কথাই নাই। আর একথাটা ফরিদা তাকে ভালই শিখিয়ে দিয়েছে। ওস্তাদ মরে যাওয়ার সময় তাকে কথা দিয়েছিল জোঁকগুলোকে এবং তার মেয়ে ফরিদাকে দেখে শুনে রাখবে। আহা ফরিদা! রাইতের বেলায় মাথায় কদুর তেল দেয়। তারপর অনেক্ষণ ধরে চুল আচড়ায়। বেণী করে, খোলে । আবার বেণী করে। কদম রসুলের খুব ইচ্ছে হয় তার মাথায় একটা গোলাপ ফুল গঁজে দেয়। কিন্তু ফরিদার সামনে গেলেই সে দুধের শিশু। একটা কথাও বলতে পারে না। ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে তাকে চোরের মতো দেখতে থাকে।
কী অমন হাবলার মতো খাড়াইয়া রইছ ক্যান? পাতিলে ভাত তরকারি আছে খাইয়া লও।'
এইরকম সম্ভাষন সে প্রতিদিনই পায়। তাই কিছু মনে করে না সে। নিজেই ভাত বেড়ে খায়। আর ফরিদা চৌকির ওপর আয়নায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুখ দ্যাখে। কদম রসুল বোঝে মুখ দেখার জন্য আয়নাটা খুব ছোট হয়ে গেছে। কালই একটা বড় আয়না কিনে আনবে বাজার থেকে। মুখ ফসকে বেরিয়েও যায় সে কথা।
কাইলই তোমার লিগা একটা বড় আয়না কিনা আনমু।'
লাগব না তুমার আয়না।'
কদমরসুল বুঝতে পারে না আকস্মিক ফরিদার কী হলো। ক'দিন আগেও তো সে তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য উতলা থাকত। মনে হগয় একা একা বাড়িতে থাকে তাই রাগ হইছে।
কদমরসুল খাওয়া ফেলে ফরিদার কাছে গিয়ে বসে। মিনমিন করে বলে দেরি হইছে বইলা রাগ করছ? কাইল থিকা রাইত ৮টার মধ্যে বাড়ি ফিরুম্
ফরিদা যেন বিরক্ত হয়।
রাইত ৮টার মধ্যে বাড়ি ফিরন লাগব না। তুমি সরো। তুমার শরীল থিকা জোঁকের গন্ধ আসে।'
চলবে
শেষাংশ
http://www.somewhereinblog.net/blog/labanyaprava/28873444