বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী ও শিশু পাচার বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) গবেষণায় দেখা গেছে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ লাখ নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়েছে।
এদিকে সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে দেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ নারীকে নানাভাবে পাচার করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া এসব নারীর কিছু অংশ মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরলেও মিলছে না এদের স্বাধীনতা। স্বাধীনভাবে চলাফেরাতো দূরের কথা, পরিবারের সদস্যদের কাছেও এরা অবহেলার পাত্র। এ অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কারণে অনেক পাচার হওয়া নারী পরিবারের কাছে ফিরতে চায় না। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে পতিতা পল্লীগুলোতে বিক্রি হওয়া নারীদের ক্ষেত্রেও ঘটছে একই ঘটনা। পাচার রোধে সংশি¬ষ্টদের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া পাচার হওয়া নারীদের ফেরত আনার পর যথাযথ পুনর্বাসনের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রও জরুরি। এক শ্রেণীর মানুষ নারী ও শিশু পাচারকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। তাদের এ ব্যবসা চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতেই চলে এবং পাচার হওয়া অধিকাংশ নারীকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়।
জানা যায়, গ্রামের সহজ-সরল নারীদের চাকরিসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভারত-পাকিস্তানে পাচার করা হয় এবং দেশের পতিতা পল্লীতে বিক্রি করে দেয়া হয়। এছাড়া কাজের জন্য যারা বিদেশ যায়, তাদেরকে দেশ বদল করে পাঠানো হয় ভিন্ন দেশে এবং কাজ বদলে করা হয় সম্ভ্রমহরণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ ঠিক থাকলেও সম্ভ্রমহরণ বন্ধ থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরি করতে গিয়ে নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয় হাজার-হাজার নারী। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া ছাড়াও করা হয় শারীরিক নির্যাতন। অনিরাপদ এই শ্রম অভিবাসনের নামে কার্যত নারী পাচারের ঘটনাই ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় প্রতারণার শিকার হওয়া বেশির ভাগ নারী লোকলজ্জার ভয়ে মামলা করতে চায় না, আবার অনেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা পেলেই খুশি। তবে এসব নারী কোনোভাবে মুক্তি পেলেও বিভিন্নভাবে সামাজিক সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়।
জানা গেছে দেশের ১৮ টি রুট দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার নারীও শিশু অবৈধ পথে পাচার হচ্ছে ভারতে। পাচারের শিকার বেশির ভাগ নারীদের স্থান হয় ভারতের পতিতা পল্লিতে। ভারতীয় সমাজ কল্যাণ বোর্ডের এক তথ্য থেকে জানা যায়, সেখানের বিভিন্ন পতিতা পল্লিতে প্রায় ৫ লাখ পতিতাকর্মী রয়েছে এর বেশির ভাগ বাংলাদেশী। বিয়ে চাকরি এবং আর্থিক প্রলোভনে পড়ে অনেকে পাচার হয়ে থাকে। ভারতের মোম্বাই পতিতা পল্লীতে ৪ মাস এবং কারাগারে ৪ বছর কাটানোর পর সেখান থেকে ফিরে এসে সেখানের অমানুষিক নির্যাতনের চিত্রতুলে ধরে নূরানীগঞ্জের (না.গঞ্জ) ফতুল্লার মেয়ে তানিয়া আক্তার (২০) পুলিশ ও সাংবাদিকদের জানায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নানা প্রলোভেন আর মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তরুণীদের কৌশলে ভারতে পাচার করে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। পতিতা পল্লীগুলোতে দেহ ব্যবসার জন্য তরুণীদের শারীরিক নির্যাতন সহ নানা প্রকার নির্যাতন চালানো হয়। তানিয়া আরো জানায়, পতিতাপল্লীর বাড়িতে অবস্থানকালীন দেহ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য তানিয়া ও তার চাচাতো বোন বকুলকে নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। গায়ে গরম পানি ঢেলে, ব্লেড দিয়ে জখম সহ ওই স্থানে লবণ দিয়ে নির্যাতন করা হত। ওই পতিতা পল্লীতেই ৬০ থেকে ৬৫ জন বাংলাদেশী কিশোরীদের সঙ্গে তানিয়ার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে ফতুল্লা ও এর আশপাশ এলাকার ১০ থেকে ১২ জনও রয়েছে। তবে তাদের নাম পরিচয় বলতে পারেনি। রুবেল নামের এক পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে তানিয়া ও বকুল ভারতে পাচার হয়। পাচারের শিকার তানিয়ার বক্তব্যের সাথে ভারতের সমাজ কল্যাণ বোর্ডের তথ্যের মিল পাওয়া যায়।
এদিকে পাচারের শিকার শিশুদের ব্যবহার করা হয় মরুভূমির উটির জকি হিসেবে। শিশুদের সুন্দর শৈশব মিলিয়ে যায় দুঃস্বপ্নে। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে পাচার হওয়া শিশুদের অনেককে হত্যার পর অঙ্গ প্রতঙ্গ বিক্রি করা হয়। সূত্রে জানা যায় , বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৪ হাজার ২’শ ২২ কিলোমিটার এবং মায়ানমার সাথে ২’শ ৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। পাচারকারিরা বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করে নারী ও শিশুদের পাচার করে থাকে। উত্তরের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাপাইনবানগঞ্জ জেলার সীমান্ত পথ দিয়ে নারীও শিশুদের পাচার করা হয়। ওই অঞ্চলের সীমান্ত এলাকার ১১টি রুট দিয়ে নারীও শিশু পাচার হয়ে থাকে। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য যশোরের বেনাপোল সীমানা অত্যন্ত সহজ রুট। বেনাপোল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম বঙ্গের বনগাঁও শহর। এ শহরে রাখা হয় পাচারকারিদের পরে সুবিধা মত তাদের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। যশোর থেকে পাচারকারিরা ভোমরা কলোরোয়া, দর্শনা জীবননগর ও ঝাউডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তবর্তী ফরিদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল, কুষ্টিয়া, যশোরের ঝিকরগাছা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ, নূরানীগঞ্জের (না.গঞ্জ) ফতুল্লা পার্বত্যাঞ্চলের কক্সবাজার, জেলাগুলো পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
জানা গেছে, পাচারের শিকার ৬০ ভাগ কিশোরীর বয়স ১২ বছর থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার নারীও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, বেশিরভাগ নারী বিয়ে বা চাকরির প্রলোভনে পড়ে পাচার হয়ে থাকে। পাচার হওয়ার আগে বোঝার কোন উপায় থাকেনা । কারণ সবার চলার স্বাধীনতা আছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ভারতে দায়িত্ব পালনকারি বাংলাদেশের দূতাবাসকে খোঁজ রাখতে হবে বাংলাদেশিরা কে কি আবস্থায় আছে। এদিকে সম্প্রতি সর্বোচ্চ মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও বন্ধ হয়নি মানব পাচার।
প্রসঙ্গত, আমরা মনে করি যে, শুধু আইনের বল প্রয়োগেই মানব পাচার রোধ করা যাবে না। কারণ মানুষের তৈরি আইনের গোলকধাঁধায় মানুষ সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় হলো- মানুষের সৃষ্টিকর্তা, খালিক্ব ও মালিক মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি অনুগত হওয়া ও উনার প্রতি অন্তরে ভয় লালন করা এবং এ সম্পর্কিত মূল্যবোধ ও চেতনা জাগ্রত করা।
মূলত, আজকের যুগে ধর্মব্যবসায়ী তথা উলামায়ে‘ছূ’দের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব থাকায় বাঞ্ছিত ইসলামী চেতনা কারো মাঝে নেই বললেই চলে। বরং উলামায়ে ‘ছূ’রাও যেভাবে অসততায় আর দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে তা দেখেই মানব পাচারকারীরা আরো সাহসী ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এক্ষেত্রে যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার নেক ছোহবতে শামিল হওয়া ও উনার তাজদীদী কার্যক্রমকে বিস্তার করা সবার জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।