আইএনবি:
পাতাকপির ভেতরে করে ইংল্যান্ডে ২১ কেজি হেরোইন পাচারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জামাতী-রাজাকার বিডি ফুডসের মালিক বদরুদ্দোজা মমিনসহ ৮জনের নামে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। তবে বিষয়টি আসামিপক্ষ গোপন রাখার মরিয়া চেষ্টা চালায়। চার্জশিট দেওয়ার সংবাদটি সংবাদমাধ্যমে সেভাবে আসেনি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ হোসেন সিএমএম আদালতে মঙ্গলবার চার্জশিট দাখিল করেন।
মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন, বদরুদ্দোজা মমিন, নাজমুল হায়দার বুলবুল, মাঈনুদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক মিঠু, আবুল বাশার, কাজী জাফর রেজা, মোখলেসুর রহমান ও মিন্টু (পলাতক)।
আসামিদের মধ্যে শেষোক্তজন ছাড়া বাকিরা উচ্চ আদালত থেকে পাওয়া জামিনে আছেন।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম নৌ বন্দর দিয়ে ফুলকপির ভেতরে করে যুক্তরাজ্যে ২১ কেজি হেরোইন (দুইটি চালানে মোট ৭৫ কেজি হেরোইন পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছিল)পাচার করে বিডি ফুড্স। চালানটি যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর পর সেদেশের পুলিশ তা উদ্ধার করে। এ ঘটনা ইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জানালে সরকার তৎপর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ২১ এপ্রিল মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী ছিলো সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র গুপ্ত।
সূত্র জানায়, চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দায়ের করা এ মামলার মূল আসামিদের বাঁচাতে মামলাটি নিয়ে প্রচুর টালবাহানা করা হয়। নাটকের পর নাটক তৈরি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ বছরে ৬ বার এর তদন্ত কর্মকর্তা বদলি করা হয়। সংশ্লিষ্টদের বাঁচাতে প্রচুর অর্থের লেনদেনও হয় ।
এদিকে ৮ জন আসামির মধ্যে নাজমুল, মোখলেস ও মাঈনুদ্দিন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে বিডি ফুডসের মালিক কর্মকর্তাদের নাম উঠে আসে। প্রসঙ্গত, বিডি ফুডস জামাত নেতাদের মালিকানাধীন বলে সাধারণ্যে ধারণা প্রচলিত।
বিডি ফুডসের হেরোইন পাচারের এ ঘটনায় তখন দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি করে। হেরোইনগুলো পাচারের জন্য অতি-অভিনব কৌশল অবলম্বন করে পাচারকারীরা। এজন্য পাতাকপির ক্ষেতে কপির চারার মধ্যে হেরোইনের প্যাকেট ভরে দেয়া হয়। পরে পাতাকপিগুলো পরিণত হলে হেরোইনের প্যাকেটগুলো সব্জির ভেতরে প্রাকৃতিকভাবেই প্রোথিত হয়ে যায়। এতে এগুলোর ভেতরে হেরোইন আছে তা বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না। তবে দীর্ঘদিন এভাবে পাচারের পর একপর্যায়ে ইংল্যান্ডের পুলিশের নজরে তা ধরা পড়ে।
সিআইডির একটি সূত্র জানায়, মামলার আলামত হিসেবে লন্ডনে আটক হেরোইন পরীক্ষাসহ অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তদন্ত কর্মকর্তার যুক্তরাজ্য যাওয়ার অনুমতি না মেলায় মামলাটির তদন্ত বেশ কয়েকবার আটকে যায়। প্রসঙ্গত, দেশের প্রায় সব মিডিয়ায়ই বিষয়টি আলোচিত হয়। তবে চার্জশিট দাখিলের সংবাদটি দু’একটি পত্রিকা বাদে প্রায় সবাই চেপে যায়। তারা যা ছেপেছে তা-ও খুবই দায়সারাভাবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আইনে এক কেজির বেশি হেরোইন পাচারে মৃত্যুদ-ের বিধান থাকায় তদন্তে যুক্তরাজ্যের সহায়তা মিলছে না। কারণ যুক্তরাজ্যে কোনো অপরাধে মৃত্যুদ- সমর্থন করে না। ২০০৮ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাজ্যের জেনারেল অ্যাটর্নি বিভাগ থেকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে এ মামলায় দোষীদের মৃত্যুদ- দেওয়া যাবে না মর্মে প্রতিশ্রুতি চাওয়া হয়।
বাংলাদেশ অবশ্য অপরাদীদের কিভাবে বিচার করা হবে সে বিষয়ে যুক্তরাজ্যের এ ধরনের প্রতিশ্রুতি চাওয়ার প্রতিবাদ করেছিল।
মামলার নথিপত্র ও ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি মোতাবেক, লন্ডনের দুটি সমুদ্রবন্দর দিয়ে সবজি ও ফ্লোর টাইলস রপ্তানির আড়ালে হেরোইন পাচার করত বিডি ফুডস। ৭৫ কেজি হেরোইনের চালান ধরা পড়ার পর ২০০৬ সালের ২১ এপ্রিল সিআইডি বাদী হয়ে রাজধানীর মতিঝিল ও সূত্রাপুর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করে। এর মধ্যে মতিঝিল থানায় দায়ের করা হয় ২১ কেজি হেরোইন পাচারের মামলা।
সূত্র মতে, তখন এসব মামলায় বিডি ফুডসের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা মোমিন, কর্মচারী নাজমুল হায়দার বুলবুল, ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক, ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন, তাদের সহযোগী বিমানের কার্গো-শ্রমিক নয়ন ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপর কোম্পানি গ্রিন হ্যাভেনের মালিক আবুল বাশার সেলিম ও তার সহযোগী কাজী জাফর রেজা, দেলোয়ার হোসেন, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া ও ইমদাদুল হক আজাদকে গ্রেফতার করা হয়। প্রধান আসামি বদরুদ্দোজা ২০০৮ সালের ৮ জুন হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পান। এরপর একে একে জামিন পান বুলবুল ছাড়া বাকি সবাই।
গ্রেপ্তারের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া আসামিদের জবানবন্দিতেই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে হেরোইন পাচারের সঙ্গে দেশ বিদেশের কারা কারা জড়িত।
বিডি ফুডসের সাবেক কর্মকর্তা নাজমুল হায়দার বুলবুল ২০০৬ সালের ১৪ মে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আদালতকে জানান, লন্ডনে বাংলাদেশি দু’জন ক্রেতা আছে। হেরোইন পাচারের জন্য বিডি ফুডসকে তারা নিয়মিত টাকা দিতেন। আরেক আসামি কাজী জাফর রেজা স্বীকারোক্তিতে বলেন, তাজউদ্দিন আহমেদ ওরফে মিন্টু নামে একজন বাংলাদেশি পাচার করা হেরোইন ব্রিটেনে জাহাজ বা বিমানবন্দর থেকে খালাস করতেন। তার বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে। মিন্টুর পরিকল্পনা ও অর্থায়নে হেরোইন পাচার করা হতো। মিন্টুকে সহযোগিতা করতেন আরেকজন বাংলাদেশি।
টঙ্গীর গুদাম: বিমানের কার্গো শ্রমিক নয়ন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জানান, বুলবুল তাকে সবজি ও কসমেটিকসের বাক্সে হেরোইন সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য ভাড়া করেন। তিনি টঙ্গীর একটি গুদামে বিভিন্ন কার্টনে হেরোইন সাজিয়ে দেন। এ জন্য তাকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, গুদাম মালিকের সাহায্য ছাড়া হেরোইন পাচার করা সম্ভব ছিল না।
স্বীকারোক্তিতে আরও জান যায়, বিডি ফুডসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে ঢাকার শাপলা চত্বর ও উত্তরার মাসকট প্লাজা থেকে বুলবুল নিজে হেরোইন সংগ্রহ করতেন। একজন পুরুষ ও একজন মহিলা এ হেরোইন সরবরাহ করতেন। বিস্কুটের টিনের বাক্সে করে হেরোইন নিয়ে আসা হতো।
স্বীকারোক্তিতে বুলবুল এসব তথ্য আদালতকে জানান। ওই পুরুষ ও মহিলা কারা, তারাই বা কার কাছ থেকে হেরোইন পেয়ে সরবরাহ করতেন তদন্তে এসব তথ্যের অনেক কিছুই এখনো বেরিয়ে আসেনি।
আসামি কাজী জাফর রেজা স্বীকারোক্তিতে আদালতকে জানান, পল্টনের হোটেল প্রীতম ও মতিঝিলের ক্যাফে ঝিলসহ অন্যান্য স্থান থেকে তিনি হেরোইন সংগ্রহ করতেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি এসব হেরোইন তার কাছে পৌঁছাতো।
শাপলা চত্বর, মাসকট প্লাজার হেরোইন সরবরাহকারী এবং হোটেল প্রীতম ও ক্যাফে ঝিলে ওই ঘটনার সময় কারা আসা-যাওয়া করত বা কোন কোন ব্যক্তি হেরোইন পৌঁছে দিত- এসব তথ্য এখন পর্যন্ত উদ্ঘাটিত হয়নি। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে মোমিনের পেছনের বা কাছের মানুষজন।
তদন্তে জানা গেছে, টাইলস ও শাকসব্জির মধ্যে বিশেষভাবে লুকিয়ে হেরোইন পাচার করা হয়। এগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে জাহাজে বোঝাই করা হয়। বন্দরে তৎকালীন শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হেরোইনগুলো জাহাজ বোঝাই করা হয়েছিল নাকি তাদের সহযোগিতায়ই পাচার হয়েছিল, সে বিষয়ে এখনো তদন্ত হয়নি।