পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক সীমাহীন অবহেলা, উপেক্ষা, বঞ্চনা ও নিপীড়ন মণিপুরীদের চরম অস্তিত্বসংকটে ফেলে দেয়। এর সাথে যোগ হয়েছিল দেশমাতৃকার টান এবং অন্যায় আর শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চিরন্তন মণিপুরী ঐতিহ্য। স্কুলে পড়া তরুণ থেকে শুরু করে ক্ষেতে খামারে কাজ করা অশিক্ষিত মণিপুরী কৃষক হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। কেউ নেয় সংগঠকের ভূমিকা। কেউ সীমান্তে বাস্তুহারা মানুষ পারাপারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। সম্ভ্রম বাঁচাতে দীর্ঘ নয়মাস মণিপুরী নারীকে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে হয়। মণিপুরী বৃদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান ও সহযোগিতা করে। মণিপুরী গৃহবধু আহত মুক্তিযোদ্ধার সেবা শুশ্রুষার দ্বায়িত্ব নেয়। যারা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত, তারা সীমান্তের ওপারের আসাম ত্রিপুরা হাইলাকান্দি আগরতলায় গান গেয়ে নেচে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহে নামে। এরা সবাই নিজেদের মতো মাতৃভুমি রক্ষার সংগ্রামে অংশ নিয়েছে, কারো অবদান কারো থেকে কম নয়।
এ লেখায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা সিলেট বিভাগের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মীর কথা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হবে।
শ্রীকৃষ্ণকুমার সিংহ, পিতা : শ্রীরতন সিংহ, গ্রাম: উত্তর ভানুবিল, ডাকঘর: আদমপুর বাজার, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
কৃষ্ণকুমার সিংহ এমন পরিবারের সন্তান যার পুর্বপুরুষরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখেন। ১৪ই আগস্ট ১৯৭১ তার বাড়িতে পাক বাহিনীর দোসররা হানা দিয়ে লুটপাট ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পরদিনই রাগী এই তরুন দা হাতে বেড়িয়ে পড়েন এবং দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ভারতের কৈলাশহরে পৌছান। হাতে দা থাকায় ভারতীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে কৈলাশহরের ভারতের আইবিএ'র জেরায় উত্তীর্ন হন এবং হাফলং এ ট্রেনিং নেন। কৃষ্ণকুমার মাইননিক্ষেপে দক্ষ ছিলেন। তিনি গুয়াইসনগর, ওয়াপাড়া, ভাড়াউড়া, ফুলবাড়ী. ধলাই ক্যাম্প এবং কামারছড়া ক্যাম্পের অভিযানে সাহসী ভুমিকা রাখেন।
১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে কৃষ্ণকুমার শ্রীমংগলে সরকারের প্রতিনিধি দলের কাছে অস্ত্র জমা দেন। স্বাধীনতার পর সরকারের রেভিনিউ বিভাগে তিনি একটি ছোট চাকরি পান। তবে এরপরে তার শরীর ভেঙে পড়ে এবং কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। বর্তমানে বাকশক্তি হারিয়ে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছেন।
শ্রীসার্বভৌম শর্মা, গ্রাম: ভানুবিল, ডাকঘর: আদমপুর বাজার, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
শ্রীসার্বভৌম শর্মা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সমাজের বিখ্যাত একজন পুরোহিত। তার পুর্বপুরুষ বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা ছিলেন ১৯৩০ সালে পৃথিমপাশার জমিদার আলী আমজাদ খাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। মুক্তিযুদ্ধে তার অবস্থান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে ১২ ই আগষ্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর চোখ বাধাঁ অবস্থায় ভানুবিলের পুর্বদিকে জংগলে তার লাশ পাওয়া যায়।
শ্রীসতীশচন্দ্র সিংহ, পিতা: মুরুলীচাঁন সিংহ, গ্রাম: তিলকপুর, ডাকঘর: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
সতীশচন্দ্র ১৯৭১ সালে শ্রীমংগল কলেজে বি.এ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। শ্রীমংগলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশের পরদিনই তিনি আসামের লোয়ার হাফলং চলে যান। সেখানে এম. ভি কৃষ্ণন নামের ভারতীয় সামরিক অফিসারের অধীনে তিনি গেরিলা ট্রেনিং গ্রহন করেন। জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন ফখরুলের অধীনে মুজিববাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের পাথরখোলায় প্রবেশ করেন। তারা ছিলেন ৩১ পলিটব্যুরোর। সতীশচন্দ্র শমশেরনগর বিমান ঘাঁটির অপারেশনে অংশ নেন। ঐদিন ত্রুটিপুর্ণ ডিরেকশনের কারণে হেলিকপ্টারের ব্রাশফায়ারে তিনি আহত হন, তবে তার ৫ জন সহযোদ্ধা নিহত হন। স্বাধীনতার পর মৌলবীবাজারে সতীশচন্দ্র অস্ত্র হস্তান্তর করেন।
শ্রীনীলকান্ত সিংহ, পিতা: চাউরেল সিংহ, গ্রাম: নয়াবালুনগর, থানা: কোম্পানীগঞ্জ, জেলা: সিলেট
ছাতক হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র নীলকান্ত যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কুইঘাট হয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথে একটি শরনার্থী দলকে অসম সাহসিকতায় দস্যুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদে শরনার্থী ক্যাম্পে পৌছে দেন। সেখানে তার সহপাঠী সাংবাদিক অতীশচন্দ্র দাসের সাথে দেখা হয় এবং কিছুদিন ক্যাম্প পরিচালনার দ্বায়িত্বে থাকেন। তারপর চন্দ্রনাথপুরে মি. বাগচী নামের সামরিক অফিসারের অধীনে প্রশিক্ষন নেন। সিলেটের বড়লেখার লাঠিটিলা বর্ডারে মেজর ডালিমের নেতৃত্বে কয়েকটি যুদ্ধ অংশ নেন। এরপর হাকালুকির হাওরে পাকিস্তানিদের সাথে ভয়াবহ একটি সংঘর্ষ হয়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের পরাজয় বরন করতে হয়। নীলকান্তসহ মাত্র ৬ জন প্রানে রক্ষা পেয়ে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার পর সিলেট জামিয়া মাদ্রাসায় মেজর সি আর দত্তের কাছে অস্ত্রসমর্পন করেন। বর্তমানে জৈন্তাপুর থানা হাসপাতালে একজন কর্মচারী হিসাবে কাজ করছেন।
শ্রীব্রজমোহন সিংহ, পিতা: শ্রীবটা সিংহ, গ্রাম: ছড়াপাথারি, ডাকঘর: পাত্রখোলা, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
সহজ সরল কৃষক ব্রজমোহনকে জমিতে হালচাষ করা অবস্থায় রাজাকারেরা আটক করে এবং চোখ বেধেঁ মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ব্যাংকার খনন করার কাজে লাগানো হলে তিনি কৌশলে পালিয়ে ত্রিপুরার কৈলাশহর চলে যান। ট্রেনিং নেয়ার পর ক্যাপ্টেন আব্দুস সালামের অধীনে সিলেট শহরে অপারেশনে অংশ নেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমাদের অধীনে কৈলাশহর ও কমলপুর সীমান্তে কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর শ্রীমংগল ওয়াপদা অফিসে অস্ত্র জমা দেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আয়োজিত প্রথম ঢাকা সম্মেলনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। কয়েক বছর আগে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করতে করতে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
শ্রীগিরীন্দ্র সিংহ, গ্রাম: মাধবপুর(আউলেকি), ডাক কেরামতনগর, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
মনিপুরী ঘোড়ামারা গ্রামের পেছনে নদী সংলগ্ন শ্বশানঘাট থেকে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের সাথে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার সংগঠন ও নেতৃত্তে ছিলেন গিরীন্দ্র। সাধারন অস্ত্র লাঠি, বর্শা এবং আরো নানান প্রাচীন অস্ত্রকে সম্বল করে পরিচালিত হয় এই লড়াই। গিরীন্দ্র ছিলেন অসম সাহসি ও অসাধারন দৈহিক ক্ষমতার অধিকারী। যুদ্ধের পাশাপাশি মাধবপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবারদাবার সরবরাহের দ্বায়িত্ব ছিল তার উপর। মাধবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অপারেশনের সময় শত্রুসৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন । ধলাই ক্যাম্পে সপ্তাহখানেক আটকে রেখে নৃশংসভাবে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েও তার কাজ থেকে কোন তথ্য বের করতে না পেরে তাকে হত্যা করে লাশ ধলাই নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকবাহিনী ও তার দোসররা। শহীদ গিরীন্দ্র সিংহ কে নিয়ে একটি লেখা পড়ুন - এখানে
মণি সিংহ, গ্রাম: মাঝের গাঁও, থানা: ছাতক, জেলা :সুনামগঞ্জ
ছাতক এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর হত্যা লুঠতরাজ শুরু হলে মণি সিংহ তার কয়েকজন বন্ধ ধের সিংহ, ব্রজ সিংহ, মনে সিংহ, হীরেন সিংহসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে সীমান্তবর্তী নামাইল ক্যাম্পে হাজির হল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে। বুটাং এবং শিলঙে প্রশিক্ষন গ্রহনের পর প্রথম অপারেশনে যান ৫ নং সেক্টরে ভোলাগঞ্জে। ১২ ডিসেম্বর সিলেটের শালুটিকর বিমান ঘাটিতে ৩ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শত্রুসেন্যদের আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করা হয়, সেই অভিযানে অগ্রনী ভুমিকা রাখেন মণি সিংহ। দেশ স্বাধীন হবার পর সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় কর্ণেল শওকত আলীর কাছে অস্ত্র হস্তান্তর করেন। যুদ্ধের সুখস্মৃতি নিয়ে মণি সিংহ এখন কৃষিকাজ করে জীবন চালান।
ভুবন সিংহ, গ্রাম: ঘোড়ামারা, ডাক: আদমপুর বাজার, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
ভুবন সিংহকে যুদ্ধকালীন সময়ে জরুরি বার্তা সংগ্রহের কাজ করতেন। কৈলাশহর, আগরতলা এবং ভানুগাছ ছিল তার কর্মক্ষেত্র। বাড়ীতে পরিবার পরিজন রেখে একাই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। এরপর সংবাদ সংগ্রহ এবং শরনার্থী পারাপারের কাজে নিয়মিত সীমান্তের এপার -ওপারে যাতায়াত করতে থাকেন। সেপ্টেম্বর মাসে পাথরখোলা বর্ডারে পাকছাউনির কাছে তিনি শত্রুসৈন্যের হাতে ধরা পড়েন। তারপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার হাত পা বেঁধে শমসেরনগর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে জোড়ামন্ডপের রাস্তার সামনে এক বৃদ্ধকে দেখে তিনি শেষবারের মতো চিৎকার করে তার পরিবারের কথা জানতে চান। শমসেরনগর ক্যাম্পে নির্যাতনের পর তাকে মেরে ফেলে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
রবীন্দ্র কুমার সিংহ, পিতা: ফাল্গুনী সিংহ, গ্রাম: তিলকপুর, ডাক: কমলগঞ্জ, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
১৯৭১ সন সিলেট এম সি কলেজের গণিত বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন রবীন্দ্র কুমার সিংহ। যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথেই ভারতে চলে যান মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। সেখানে স্বল্পকালীন ট্রেনিং শেষ করে শমশেরনগর ও কামারছড়া এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণকুমার সিংহের বয়ান থেকে জানা যায় কামারছড়া অঞ্চলের পাঞ্জাবি ছাউনিতে গেরিলা আক্রমনের সময় তিনি ঐ অঞ্চলের ম্যাপ রবীন্দ্র কুমার সিংহের হাতে হস্তান্তর করেন। যুদ্ধের পাশাপাশি স্হানীয় রাজাকার ও পাক বাহিনীর দোসরদের চিহ্নিত করে তাদের খুজেঁ বের করার কাজ করতেন।
স্বাধীনতার পর অনার্স ও মাস্টার্স ১ম শ্রেনীতে পাশ করার পর তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে সেকশন অফিসার এবং পরে তার সততার কারণে তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রীন একান্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৭৯ সনের ২৭ আগষ্ট ঢাকার আজিমপুরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সশস্ত্র হামলায় তিনি নিহত হন।
থইবা সিংহ, গ্রাম: তেঁতইগাও, ডাক: আদমপুর বাজার, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জের মহকুমা সদরে কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন। তিনি মেঘালয়ের শিলং এর বালা ক্যাম্পে ১৫/২০ দিন থাকার পর ভারতীয় মেজর বাথ সিং এর তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং নেন। প্রথম অপারেশন ছিল ঢাউকির মুক্তাপুরে, তারপর তাহেরপুর রাতাছড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে কমান্ডার মানিক চৌধুরীর অধীনে দিরাই, কর্ণফুলী. শাল্লা ও জয়কলস এ গেরিলাযুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমানে কৃষিকাজ করে সংসার চালান।
নন্দলাল সিংহ. গ্রাম: নয়াবালুচর, থানা: কোম্পানিগঞ্জ, জেলা: সিলেট
১৯৭১ যু্দ্ধ শুরু হবার পরপরই নন্দলাল সিংহ সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানে পরিবারের সদস্যদের ইছামতি ডিঙরায় শরনার্থী ক্যাম্পে রেখে মেঘালয়েল জোয়াই তে প্রশিক্ষনের জন্য চলে যান। প্রথম অপারেশন ছিল ভোলাগঞ্জের বিলাজোড়ে। তারপর বাদঘাটে এবং পরে প্লাটুন কমান্ডার মুসলিম মিয়ার অধীনে গোয়মারায় যুদ্ধ করেন। শালুটিকর বিমান ঘাটি ও তেলিঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ে অগ্রনী ভুমিকা রাখেন নন্দলাল। স্বাধীনতার পর সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় কর্ণেল শওকত আলীর কাছে অস্ত্র জমা দেন। পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পেয়েছিলেন কিন্তু তা ছেড়ে বাড়ীতে কৃষিকাজ করছেন।
বিদ্যাধন সিংহ, গ্রাম: ভানুবিল, ডাক: আদমপুর বাজার, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা মৌলবীবাজার
১৯৭১ সালের এপ্রিলে বিদ্যাধন সিংহের বাড়ীতে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হামলা চালায়। সেদিন সন্ধ্যায় ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে ভোররাতে ডলুগাও পৌছান। সেখানে স্বেচ্ছায় ডিআইবির হাতে আটক হন। তারপর নিজের ইচ্ছার কথা জানালে তাকে ট্রেনিং এর জন্য হাফলং পাঠানো হয়। বিদ্যাধন সিংহ কমলপুরের বালিগাও ক্যাম্পে এবং পরে গুরুত্তপুর্ন ধলাই ক্যাম্পের একটি অপারেশনে অংশ নেন। ভারতীয় সীমান্ত থেকে চরাশ গজ দুরের এই আউটপোস্টে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানীবাহিনীর মধ্যে কয়েকদফা সংঘর্ষ হয়েছিল। এই ধলাই আউপোস্ট শত্রুমুক্ত করতেই প্রাণ দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। দেশ স্বাধীন হলে বিদ্যাধন শ্রীমঙ্গল ওয়াপদায় এসে অস্ত্র জমা দেন। ১৯৯১ সালে তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা রেখে মারা যান।
ব্রজমোহন সিংহ, গ্রাম: মাঝের গাঁও, থানা: কোম্পানিগঞ্জ, জেলা: সিলেট
টেইলার ব্রজমোহন সিংহ পেশাগত কাজের জন্যে আগরতলায় থাকতেন। যুদ্ধ শুরু হলে বাড়ীতে বাবা-মাকে দেখার জন্য দেশে আসেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবেন। তারপর মেঘালয়ের শিলং এ ভারতীয় সামরিক অফিসার রলরাম সিং এবং ইম্ফালের কুঞ্জ সিং এর তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং রাভ করেন। জৈন্তা অঞ্চলের মুক্তাপুর এবং কালাইনছড়ি ছিল ব্রজমোহন সিংহের প্রথম অপারেশন। এরপর কমান্ডার আলমগীরের নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জে কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। বর্তমানে হতদরিদ্র হয়ে অন্যের জমি বর্গাচাষ করে দিনযাপন করছেন।
নিমাই সিংহ, গ্রাম: মাধবপুর, ডাকঘর: পাত্রখোলা, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
ছাত্রাবস্থায় নিমাই সিংহ ছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী। প্রথমে ভারতে একটি শরনার্থী শিবিরের জীপগাড়ীর হেলপার হয়ে কাজ করতেন। পরে হাফলং লোয়ার বনে ভারতীয় সামরিক অফিসার হনুমান সিং এর কাছে ৩ মাস ২১ দিন প্রশিক্ষন নেবার পর ৪ নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের অধীনে কমলপুর সীমান্তে নিয়োজিত হন। এরপর কমান্ডার আবুল কাশেমের অধীনে কুমারঘাট, শ্রীমঙ্গল, আখাউরা এবং খোয়াই এ কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শ্রীমঙ্গলে অস্ত্র জমা দেন। পরে ১৫ দিনের মিলিশিয়া ট্রেনিং এ অংশ নেন। বর্তমানে আনসার বাহিনীর সাথে যুক্ত আছেন।
বিশ্বম্ভর সিংহ, গ্রাম: বালিগাঁও,ডাকঘর: কেরামতনগর, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার ভাই কৃপাময় সিংহকে নিয়ে শরনার্থী শিবিরে উঠেন। তারপর নৌমুজা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান।সেখান থেকে শিলচরের লোয়ারবন ট্রেনিং সেন্টারে ১ মাস ১০ দিন ট্রেনিং নেন। ক্যাপ্টেন ধীর সিং এর তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং সমাপ্তির পর কমান্ডার হাবিবুর রহমানের অধীনে চাতলাপুর বর্ডার অপারেশন ডিফেন্সে কাজ করেন। বিওপি, কামারছড়া চাতলাপুরে তিনি অপারেশনে ডিফেন্সে গুরুত্তপূর্ন দ্বায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর মৌলবীবাজার ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে অস্ত্র জমা দেন। ১৯৭৪ সালে শ্রীমঙ্গল কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করার পর চেস্টা করেও একটি চাকুরি জুটাতে না পেরে মনক্ষুন্ন হয়ে কৃষিকাজে মন দেন।
দীনমনি সিংহ, গ্রাম: পুরান বালুচর, থানা: কোম্পানিগঞ্জ, জেলা: সিলেট
'৭১ এ দীনমনি ছিলেন ৯ম শ্রেনীর ছাত্র। মে মাসে কোম্পানিগঞ্জে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ দীনমনিকে উৎসাহিত করে তোলে। বাড়ীর কাউকে না জানিয়ে তিনি তার বন্ধু স্বপন, মণি ও নন্দলালের সাথে সীমান্ত পাড়ি দেন। ইছামতি ইয়ুথ ক্যাম্পে তার ট্রেনিং হয়। ট্রেনিং শেষে ভোলাগঞ্জ ৫নং সাবসেক্টরে অপারেশনে যোগ দেন। কমান্ডার ফখরুলের নেতৃত্বে পরিচালিত ঐ অভিযানে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল এবং তারা সারারাত জেগে ভোলাগঞ্জের মোরায় শত্রুসৈন্যদের ঘাটিতে হামলা করেন। সেদিন গোলবারুদ ও অস্ত্রস্বল্পতার কারণে তারা ব্যাক করেন কিন্তু পরদিন শত্রুসৈন্যদের ঐ ক্যাম্পটি শুণ্য হতে দেখা যায়। তার স্মৃতিচারন থেকে জানা যায়, ঐদিন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সুরমা নদীর পাড়ে কিছু রাজাকারকে ধরে ফেলে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এদের প্রাণে না মেরে সামান্য উত্তমমধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেন এবং 'জয়বাংলা' শ্লোগান দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য করান। বর্তমানেছাতক থানার লাকেশ্বর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত আছেন।
বাপ্পী সিংহ, গ্রাম: বালিগাঁও, ডাকঘর: কেরামতনগর, থানা: কমলগঞ্জ, জেলা: মৌলবীবাজার
সঙ্গীত শিল্পী বাপ্পী সিংহ এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশের গান গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ত্রিপুরায় আমতলী অস্থায়ী ক্যাম্পে ১৫ দিন কাটান। তারপর হাফলং এ ট্রেনিং নেন ও পরে হবিগঞ্জের কমান্ডার মানিক চৌধুরীর অধীনে কয়েকটি অপারেশনে যোগ দেন। যুদ্ধকালীন সময়ে সহযোদ্ধাদের দেশাত্তবোধক গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি জে এল উইং এ ফাস্ট নেলস পাওয়ার, সিলেটের মাইন কালেকশন, আর্মস এন্ড এমুনিশন সাপ্লাই ইত্যাদির কাজ করেন। স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দেন শ্রীমঙ্গলের ওয়াপদাতে। বর্তমানে নানান সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত আছেন।
চলবে...
তথ্যসূত্রঃ
১.দৈনিক সিলেট বাণী (নভে:-ডিসেম্বর '৯৩) - জহিরুক হক চৌ: সম্পাদিত
২. স্বা: সংগ্রামে বা: মণিপুরী সমাজ (১৯০১ -১৯৭১)- রণজিত সিংহ, ১৯৯৭
৩. ইথাক (বিঃ মঃ পত্রিকা), ডিসেম্বর ১৯৯৭ সংখ্যা
৪. বৃহত্তর সিলেটের দুইশত বছরের আন্দোলন - তাজুল মোহাম্মদ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ২:২৬