অস্টাদশ শতকে মণিপুর থেকে আসা বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙন(মণিপুরী মুসলিম) সম্প্রদায় বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটে এসে দুর্গম পাহাড় জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে তোলে। উত্তরগাঁও, মাঝেরগাঁও, ছনগাঁও, কোণাগাঁও ও মাঙখেইমাখঙ - এই পাঁচটি প্রাম নিয়ে গঠিত ভানুবিল মৌজায় সর্ববৃহৎ অভিবাসন ঘটে মণিপুরীদের। ৭৫২টি পরিবার অন্তর্ভূক্ত ছিল ভানুবিল মৌজায়। নতুন আবাসে কৃষি হয় তাদের প্রধান জীবিকা। নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে ভ্রাতৃপ্রতীম বাঙালী জনগোষ্টির সাথে শান্তিপুর্ণ বসবাস শুরু করে মনিপুরীরা। কিস্তু সহজ সরল মানুষগুলোকে প্রকৃতি পরম মমতায় বরন করে নিলেও রাস্ট্র তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয় না, ক্রমশ তারা শিকার হতে থাকে নিষ্ঠুর শাসক ও শোষকবর্গের, চিনে নিতে থাকে একের পর এক শত্রুর মুখ।
গত শতাব্দীর প্রথম দশক (১৯০১-১৯০৭)। ঔপনিবেশিক শাসক বৃটিশদেরকে সরাসরি নয়, তারা পেয়েছিল বৃটিশদের পোষ্য পৃথ্বিমপাশার জমিদার আলী আমজাদ খাঁ ও তার নায়েব রাসবিহারী দাশকে। জমিদার আর নায়েব মিলে কৃষকদের উপর চালায় অন্যায় জুলুম ও শোষন। রাসবিহারী রসিদ ছাড়াই খাজনা আদায় করতো। একদিন কৃষকরা হতবাক হয়ে দেখতে পায় হিসাবের খাতায় তাদের খাজনা পরিশোধের চিহ্ন নেই, দলিল নেই। শত শত প্রজার উপর প্রহসনের নোটিশ জারী হয়। মণিপুরী কৃষকরা বাঙালি কৃষকদের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে এই বেইমানীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। একজন কৃষকও এগিয়ে এলনা খাজনা দিতে। ফলে অনিবার্য হয়ে উঠে সংঘাত এবং প্রতিরোধ আন্দোলন। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে রাসবিহারীকে হত্যা করা হলে তখনকার মতো মণিপুরী প্রজারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, কিন্তু পরোক্ষভাবে চলতে থাকে অন্যায় ও শোষনের ধারা।
এরপর বিশ শতকের ত্রিশের দশকে শাসকগোস্ঠী আবার ফিরে গেল সেই পুরোনো চেহারায়, এবার আরো সতর্ক এবং দ্বিগুন নিষ্ঠুরতা নিয়ে। গোটা বিশ্বে তখন পুঁজিবাদের বিরোধ, সাম্রাজ্যবাদের প্রকট রূপ, অন্যদিকে সমাজতাণ্ত্রিক সোভিয়েতের অভ্যুদয়, আশা নিরাশার দোলাচলে বিশ্বের শোষিতশ্রেণীর বিপ্লবচিন্তা কম্পমান। এদিকে গোটা ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন। ১৯৩১ সালের দিকে শোষিত প্রান্তজনের বিদ্রোহের সাথে একিভূত হতে ভানুবিলের পঞ্চানন ঠাকুর, বৈকুন্ঠনাথ শর্মা, নাবদ্বীপ সিংহ, কাসেম আলী, গিরিন্দ্রমোহন সিংহদের সাথে যোগ দিলেন কংগ্রেস ও কমিউনিষ্ট পার্টির অনেক বিপ্লবী। দ্বারিকা গোস্বামী , নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী, পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত, চারুবালা দেবী প্রমুখ নেতাকর্মীর সক্রিয় অংশগ্রহনে ভানুবিলের কৃষকবিদ্রোহ পেয়ে যায় মুলধারার সংগ্রামের মর্যাদা ও তাৎপর্য।
শোষন নিপীড়নের বিরুদ্দে ভানুবিলের মণিপুরী কৃষকদের এই বিদ্রোহ ধারন করে শোষিত-নির্যাতিতের জাতীয়তাসূচক এক মহাবিপ্লবের রূপ, যা উপনিবেশ থেকে মুক্তির মহাভারতীয় সংগ্রামের সাথে কোনো না কোনোভাবে এক হয়ে যায়, যার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় কৃষকসমাজ বা নিপীড়িতের মুক্তি। গনপ্রেপ্তার এবং নির্যাতন সে আন্দোলনে বাধা হতে পারেনি। প্রায় তিন বছর ধরে চলে সেই আন্দোলন।
ভানুবিলের কৃষক আন্দোলনে মণিপুরী নারীদের অংশগ্রহন ছিল ব্যাপক। এমনকি নেতৃত্বে শরিক হয়েছিলেন এমন অনেক মহিয়সী নারী। লীলাবতী শর্মা, সাবিত্রী সিংহ , শশীপ্রভা দে, যোবেদা খাতুন এমন অসংখ্য বিদ্রোহিনীর সদর্প পদক্ষেপে কেঁপে উঠেছিল অত্যাচারীর ভাঙোনোন্মুখ দুর্গ। এতে বিষ্ময়ের কিছু নেই, মণিপুরী মেয়েরাতো সবকাজেই পুরুষদের সাথী, কৃষিকাজে পুরুষদের সাথে সমানভাবে অংশনেয়া মনিপুরী নারী তো গর্জে উঠবেই। বৈকুন্ঠ শর্মার মাত্র ষোল বছরের মেয়ে লীলা। তার অগ্নিশ্রাবী বক্তৃতায় নারীপুরুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠতো। ষোলো বছরের এই তরুনী মণিপুরী চাষীদের মনে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতো। জোয়ান অব আর্কের মতো লীলার কাহিনী গল্প গাঁথা ভানুবিলের সীমানা ছাড়িয়ে সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে । ভানুবিলের আন্দোলন তাই লীলার সাথে অচ্ছেদ্য সুত্রে গাঁথা হয়ে যায়।
এরমধ্যে পরিবর্তন ঘটে শাসককুলের। জমিদার আলী আমজাদ খাঁর মৃত্যূ ঘটলে তার পুত্র আলী হায়দার খাঁ আর তার নায়েব প্রমোদ ধর যথারীতি দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রাখে। জমির খাজনা বাড়িয়ে দেয়া হয় দ্বিগুন। পুকুর কাটা বা মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। নিজ ভিটায় গাছ লাগানোর অধিকারটুকুও হরন করা হয়। তীব্র ক্ষোভে ফুঁসে উঠেও কংগ্রেসের তথাকথিত অহিংস নীতির ফরমান পালন করতে গিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা ও বিভৎসতার মুখামুখি হতে হয় মণিপুরীদের । কৃষকের ঘরবাড়ী লুট হতে থাকে, মেয়েদের ছিনিয়ে নেয়া হয়, হাতীর পায়ে মাঠের ফসল মাড়িয়ে দেয়া হয় । জমিদারের পাগলা হাতিকে তাড়াতে নিজস্ব ঢাক করতাল শঙ্খ বাজিয়ে মণিপুরী কৃষক-কৃষানী নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেস্টা করে। কিন্তু অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে চরম বিড়ম্বনার মুখামুখি দাঁড়ানো কৃষকরা কংগ্রেসের গালভরা "সত্যাগ্রহ" আর তার শূন্যমার্গীয় ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারল না এবং নিজেদের পরিচিত ও অভ্যস্ত সক্রিয় প্রতিরোধের পথে ফিরে গেল।ফলে ভানুবিল পরিণত হলো রণভূমিতে। বহু কৃষক , সরকারী সৈন্য, পুলিশ হতাহত হলো। কৃষকের ঘরবাড়ী পুড়লো, ৭৫২টি ঘরের ৩০০টিই হাতি দিয়ে মাড়িয়ে দেয়া হলো। এরপর গনগ্রেফতারে বহু গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ল।
এদিকে কৃষকদের এই প্রতিরোধ শুরু হতেই কংগ্রেস নেতারা "হিংসা!" "হিংসা!" বলে চীৎকার জুড়ে দিল এবং আন্দোলনের দায় নিতে অস্বীকার করলো। কিন্তু এবারে কৃষকরা কংগ্রেস নেতৃত্বের শঠতার কাছে আর মাথানত করেনি, বিদ্রোহী কৃষকরা তাদের নেতৃত্ত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বীর বিক্রমে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে গেল। এরমধ্যে তখনকার দুর্বল ও অক্ষম কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে জনৈক বঙ্কিম মুখার্জ্জী ভানুবিল ঘুরে গেলেও ভানুবিলের কৃষক-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তেমন উচ্চকিত আওয়াজ তুলেনি। তাই ভানুবিলের বিদ্রোহীদের সাথে কমিউনিস্টদের যোগাযোগ তেমন তাৎপর্য বহন করেনি।
এরপর দেশে বিদেশে ভানুবিলের কৃষকদের উপর সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠে। বৃটিশ পার্লামেন্টে খোদ লেবার পার্টি সরকারের সমালোচনায় ও নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। আইনসভার একদল সদস্য নিয়ে তারা ভানুবিল পর্যন্ত ছুটে আসে হয়তো নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই। অবশেষে সফল কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দে সিলেট জেলা প্রজাসত্ত আইন পাশ হয়। কৃষক ফিরে পায় জমিজমার উপর তার স্বত্ব।
ছবি ক্রমানুসারেঃ
১. কৃষকদের ঘরবাড়ী উচ্ছেদের দৃশ্য - সজলকান্তি সিংহের ড্রয়িং
২ .কৃষকবিদ্রোহে অংশনেয়া গিরীন্দ্রমোহন সিংহ, বলরাম সিংহ ও পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত
৩. ভানুবিল কৃষকপ্রজা আন্দোলনের পর প্রজাদের দেয় খাজনার রসিদ
তথ্যসূত্রঃ
১. ভানুবিলের কৃষকবিদ্রোহে অংশগ্রহনকারী প্রয়াত শ্রী বলরাম সিংহের পরিবার
২. ভানুবিল কৃষকপ্রজা আন্দোলন স্মৃতি পরিষদের সদস্যবৃন্দ
৩. ইথাক (বিঃ মঃ পত্রিকা), ডিসেম্বর ১৯৯৭ সংখ্যা
৪. নানকার বিদ্রোহ (১ম খন্ড) - অজয় ভট্টাচার্য
৫. ভানুবিল কৃষকপ্রজা আন্দোলন বারোহ মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সমাজ - রণজিত সিংহ
৬. হাওর করাইয়ার কৃষক আন্দোলন - মাহফুজুর রহমান
৭. বৃহত্তর সিলেটের দুইশত বছরের আন্দোলন - তাজুল মোহাম্মদ
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১:৩১