একটা চাপাতি - টপ টপ করে রক্ত পড়ছে সেটা থেকে। কিসের রক্ত? মুরগির? গরুর? ছাগলের? — নাকি মানুষের? এই রক্ত আপনার ব্যাচমেটের, আপনার বড় ভাইয়ের - শ্রদ্ধায় আর আস্থায় ছিল যে আপনার ছায়ার স্থান, আপনার ছোট ভাই - স্নেহে ভরপুর আপনার মন যার জন্য। একসাথে বসে তার সাথে কত সময় কাটিয়েছেন আপনি, আড্ডায় - গানে, প্রেমে-বিরহে যে ছিল আপনার সঙ্গী তার রক্তই ঝড়ছে টপ টপ করে চাপাতি দিয়ে... এরকম আরো কাউকে পিটানো হয়েছে রড দিয়ে, চাপকানো হয়েছে ধাতব শিকল দিয়ে। শিউরে উঠছেন? হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, আপনার বন্ধুর এরকম হলে আপনার অনুভূতি কি হইতো? শিরদাঁড়া বেয়ে হিম রক্ত বেয়ে যাচ্ছে কি? এখনই না আরো আছে গল্প।
আপনাকে মারতে এসেছে যে, সে কে? আপনারই ছোট ভাই - এই সেদিনও যাকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলেন, গত পরশু যে আপনার পাশেই বসে চা খাচ্ছিল। হয়তো কখনো একটু তর্ক হয়েছে, কখনো তাও হয় নি; আপনার সাথেই সে ক্লাস করে, বা আপনার আশে পাশের ক্লাসে। আপনার বন্ধুকে মারতে দেখে আপনি এগিয়ে যাবার সাহস পান নি, বরং প্রাণভয়ে নিজের ইনস্টিংক্টেই লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন; তারপরও ঠিকই তো খুঁজে পেল আপনাকে... ঘরের ভেতর থেকে টেনে হিঁচড়ে, এমনকি খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন তো - সেখান থেকেই বের করে মারতে মারতে পাঁচতলায় আপনার ঘর থেকে বের করে নিচে নিয়ে গেলো — পিটাতে... মনের সুখে পিটালো তারা আর সেখানে মার খেলেন আপনি... দুইজন তিনজন, পাঁচ-ছয়জন মিলে আপনাকে পিটাচ্ছে - বাঁধা দেবার সাহস আছে? ক্ষমতাই তো নেই! এতক্ষণে অবসন্ন পুরা শরীর, ব্যাথাটাও ঠিকমত অনুভব করা যাচ্ছে না। "বেশ মেরেছি এবার - চল আরেকটারে ধরি, বানাতে হবে" - বলে আরেকজনের দিকে ধেয়ে গেলো তারা।
এসব ঘটনায় আপনারা কি করবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আপনি - আপনার শিক্ষকদের উপর ভরসা রাখবেন তো? হ্যাঁ ছিলও তারা আপনার পাশে - আপনাকে বাঁচাতে এসে নিজেরাই জখম হয়ে গেলো - তাদের কেউ কেউ আইসিউই তে শুয়ে এখন লড়ছে।
তাহলে উপাযার্চ, ছাত্র কল্যান পরিচালক - আরও যারা আছেন তারা। গতকাল রাতে "সাধারণ ছাত্রদের কারো কিছু হবে না, হলে তার দায়িত্ব আমার" বলে আজ ক্যাম্পাসেই নেই উপাচার্য স্যার। ছাত্রকল্যান পরিচালক যিনি, তিনিও এলেন পুলিশ সাথে নিয়ে ঠিক তখনি - যখন কালপ্রিটরা সব তাদের কাজ সেড়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেছে।
আপনি কুয়েটের একুশে হলের ছাত্র, ফিস্টের খাবারের বাজেট এতো বেশি হইলেও খাবারের মান এতো খারাপ কেন সেটা গতরাতে জানতে চাওয়ায় আজ দুপুরে আপনার ভার্সিটির ছোটভাই, বড়ভাই, ব্যাচমেটরা আর তাদের রাজনৈতিক দোসর বি.এল. কলেজের ছাত্ররা আপনাকে পিটিয়ে, মেরে কেটে, জখম করে, আধা আতুর করে রেখে গেলো। তখন জনগণের সেবক পুলিশ ঠিক বাহিরেই বসে আয়েশ করছিল - অনুমতি নেই বলে কিছু বলে নাই কাওকে। তারপর, সিনেমার শেষ দৃশ্যে যেমন, তেমনি সব শেষ হবার পর তারা আসলো।
কুয়েটের ছাত্রদের লীগের ছেলেরা পিটাচ্ছে? তাহলে এরপর কি হবে, লীগের ছেলেদের উপর কেও হাত তুলবে? না সে সাহস নাই... তারপরও দিই হল ভ্যাকেন্ট করে, তাহলে বিচার চেয়ে আন্দোলন করতে পারবে না! ভ্যাকেন্ট করতে একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং করা লাগবে? কি দরকার, কেউ কিছু তো আর বলার সাহস পাবে না, দিয়েছি কয়েকটাকে আচ্ছা করে - বেশি তেড়িবেড়ি করলে বাকিদেরও দেবো।
তাও সাধারন ছাত্ররা ভিসি'র বাসার সামনে অবস্থান নেয় ঘটনার সুষ্ঠু সমাধানের আশায় - কিন্তু তাদের উপর টিয়ার শেল মেরে, হামলা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। তারপর জোর করে হল ভ্যাকেন্ট - যে যেমনে পারো জান নিয়ে পালাও।
পাঠক আপনিই বলেন, যে ক্যাম্পাসে একসময় কোন রাজনীতি ছিল না, কারো গায়ে কেও কোনদিন হাত তুলার কথা চিন্তাও করে নি, সেখানে নির্মম ভাবে আজ কেন পিটানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের? এমনকি শিক্ষকদেরও? এ ঘটনার যদি কোন সুষ্ঠু সমাধান না হয় তবে কেও কি ক্যাম্পাসে ঠিকমত চলতে পারবে? যে শান্ত ছেলেগুলো এ তাণ্ডব দেখে আজ বাড়ি বা অন্য কোথাও গিয়ে রয়েছে - সে কি ঘুমের মাঝে ভয়ে শিউরে শিউরে উঠবে না - যদি আদতেই ঘুমাতেও পারে?
কুয়েটের পরিবেশ ঠিক করতে আপনাকেও এগিয়ে আসতে হবে, আপনাদের সঙ্গ না পেলে আমরা আমাদের এ কুয়েটকে আর ঠিক করতে পারবো না - আর বাঁচাতে পারবোনা ভালোবাসার গর্বের এই ক্যাম্পাসকে। আর কোন বাবা-মা তার সন্তানকে ইঞ্জিনিয়ার হতে এখানে আর পাঠাবে না।
আপনার সমর্থনের আশায় রইলাম॥