অনেক দিন পর আজ একটু ঘেমেছি, কেমন যেন অন্য রকম একটা অনুভুতি হচ্ছে ! জীবনে আবার কোন দিন ঘেমে যাব ভাবতে পেরেছিলাম কখনও ? মনে করতে পারিনা । আজ কত দিন পর সূর্য দেখছি সেটাই তো মনে করতে পারছি না। এক সময় বন্ধুদের বলতাম তোদেরই তো দিন । যখন জিজ্ঞাস করত তোর কি রাত ? আমি বলতাম শুধু রাত না , অমাবস্যার রাত। সেই আমি কি ভেবেছিলাম আমার জীবনটা শুধু রাতময় হবে ?
খুব গাধা মনে হয় নিজেকে, ছোট বেলায় শুনতাম অতি চালাক এর গলায় দড়ি, সেরকম অতি চালাক মনে হয় নিজেকে। বন্ধুময় জীবনটা তো দারুন ছিল ! ক্লাস, ভার্সিটি, আড্ডা, বাসা এসব করে তো দারুন ছিলাম। ইশ আমাদের তিনজনের হিমু হওয়ার কথা মনে পরছে, একদিন তিন হিমু মিলে হলুদ তিনটা পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে খালি পা নিয়ে বের হয়ে গেলাম । নিয়ম হল পকেটে কোন টাকা থাকবেনা, মোবাইল থাকবে না, শুধু দুই প্যাকেট সিগারেট থাকবে আর একটা দিয়াশলাই ।
মনে পরে দোস্ত যেদিন প্রথম তোদের বললাম তাহিতির কথা ? কি কি বলেছিলাম মনে আছে ? আমার সব মনে আছে, বলেছিলাম না মেয়েটা খুব বোকা ? বলেছিলাম না ওর হাতের লম্বা আর চিকন আঙ্গুল গুলোর কথা ? ওর পায়ের নখের কথা ? মনে আছে ওর মুখেরে উপর হাতটা নিয়ে হাসার ভঙ্গিটা কেমন বলেছিলাম ? আমার সব মনে আছে । সেদিন যেভাবে তোদের বলেছিলাম আজও ঠিক একই ভাবে বলতে পারব ।
একটা মেয়ের দিকে আমি দিনের পর দিন তাকিয়ে থেকেছি, দিনের পর দিন সামনে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি, শুধু একবার চেয়েছি দৃষ্টিটা । হায় রোবট মেয়ে ! আমি নিজেকে জীবনে কখনও এতও শরমিন্দা ভাবি নি । আর কোন উপায় না পেয়ে, “ পুরুষ মানুষের শরমের কি ?” – এই ভেবে সাহস আনলাম বুকে ।
তাহিতি তোমার মনে আছে ঐ দিনের কথা, তোমার পায়ের নিচ থেকে কলম তুলে গলাটা পরিষ্কার করে বললাম, “ এক্সকিউজ মি, কলমটা মনে হয় আপনার তাই না ?” তুমি আকাশ থেকে পরে বললা, “ও আল্লাহ্ এইটা আমার কলম হবে কেন?” ব্যাস আমার দৌড় শেষ হয়ে গেল । এদিকে দেখি কপাল ঘেমে, বুক কেঁপে আমার দফারফা । মাথাটা চুলকে বললাম ও আচ্ছা তাইলে মনে হয় আমারই কলম, বলে তারাতারি ঘুরতে ধরে দিলাম তোমার হাতের চটপটির প্লেটটা ফেলে । আমি তো শেষ ! কোন স্যরি বলার ক্ষমতা আমার ছিলনা, ছুটে পালালাম কোন মতে ।
দ্বিতীয় দিন কি করেছি মনে আছে ? তোমার ব্যাগে আমার একটা খাতা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, তোমাকে গিয়ে বললাম, “এক্সকিউজ মি, আমার খাতাটা দিবেন প্লিজ। আবার তুমি আকাশ থেকে পড়লা, শুধু আকাশ থেকে না এবার তুমি যেন উল্কা পিণ্ড হয়ে আকাশ থেকে পড়লা ! আমি আমার ম্যাথের নোট খাতার মায়া ছেড়ে আবারও পালিয়ে বাঁচলাম ।
মনে আছে তাহিতি, এরকম কয়টা এক্সকিউজ মি এর পরে একদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ পেলাম “ এক্সকিউজ মি , আর কয়টা ‘এক্সকিউজ মি’ লাগবে আপনার?” আমার মনে আছে, গুনে গুনে ১৩টা এক্সকিউজ মি'র পর !
কিন্তু আর একটাও লাগালাম না আমি, তোমার এক্সকিউজ মি'টাকে একবারেই ধরে ফেললাম ।
প্রথমবার হাত ধরাধরির কথা মনে আছে ? তুমি ধরতে দিয়েছিলে তোমার হাতটা, আমি বুঝে উঠতে পারছিলামনা এই তুলতুলে নরম জিনিসটা নিয়ে আমি কি করব, শক্ত করে ধরতে ভয় হয়,আলতো করে ধরতে ইচ্ছা করেনা । কি বিপদ ! কি বিপদ !! একটু খানি হাত ধরতেই আমার যে কি ঘামাঘামি অবস্থা ! মনে হচ্ছিল আমি বুঝি সীতার মত কোন অগ্নি পরীক্ষা দিচ্ছি । বাবারে !
এরপর থেকে প্রতিবার দেখা হওয়ার সময় ঐ নরম তুলতুলে জিনিসটা তুমি নিজে থেকে আমার হাতে না দিলে কিভাবে গাল ফুলিয়ে থাকতাম ভাবলে কেমন হাসি পায় । ও আল্লাহ্ আমি কি রকম বাচ্চাদের মত ছিলাম !
এর পর কত দ্রুত সব কিছু ঘটতে লাগলো তাই না ? তুমি আমি, আমাদের চাওয়া-পাওয়া, ভালবাসাবাসি, নির্ভরশীলতা । একজন ছাড়া অন্যজনকে ভাবতেই পারতামনা আমরা তাইনা ? কি অদ্ভুত ! কি অদ্ভুত !!
কত দ্রুত আমার মনটাও পরিবর্তন হল তাই না ? আমি তোমাকে এরিয়ে যেতে শুরু করলাম । তোমার প্রত্যেকটা কথা আমাকে গরম লোহার শিকের মত খোঁচাতে লাগলো যেন, তুমি তো তাই ভাবতে, তাইনা তাহিতি ? কথায় কথায় তোমাকে গালাগালি আর জঘন্য ভাষায় বকতে শুরু করলাম । কত তারাতারি আমি তোমাকে ছেড়ে আর দশটা মেয়ের সাথে ঘুরতে শুরু করলাম তাইনা ? কত দ্রুত আমার ফেইসবুক রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেল করে ফেললাম ! তোমার চোখের পানিগুলো আমার কাছে ওয়াসার পানির থেকেও সস্তা হয়ে গেল !
সমস্যাটা কোথায় থেকে শুরু হয়ে গেল জানো ? থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার সময়ে যখন তুমি আমাকে বললা তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, ঠিক ঐ রাত থেকেই।
পরীক্ষার সময় আমার মাথাটা খুব অদ্ভুত আচরন শুরু করে জানইতো । নতুন নতুন থিওরি আবিস্কার করে ফেলি, আর নিজেকে খুব জিনিয়াস কেউ মনে হতে থাকে । মনে হয় সারা জীবন ক্যান পরীক্ষা চলেনা, তাহলে আমিও তো মহাপুরুষ টাইপ কিছু একটা হয়ে যাই !
ঐ রাতেই আমার মাথায় খুব অদ্ভুত একটা ভালবাসার সংজ্ঞা আসলো । আমি মাথায় চিন্তা চলতে লাগল যদি ঠিক ঠিক তোমার বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে আমার কেমন লাগবে ? আমি ভাবতে পারছিলামনা, খুব কষ্ট হচ্ছিলো শুধু এটুকুন ভাবতেই । কিন্তু নিজেকে বোঝালাম , নিশ্চয়ই ভালবাসার মানুষের বিয়ের রাতটাই ভালবাসা বোঝার সব থেকে উত্তম সময় । সেদিন থেকে শুরু হল আমার গবেষণা, আর আমাদের ভালবাসা হল আমার গবেষণার গিনিপিগ । কিন্তু তুমি তো আমাকে ছেরে যাবেনা এটা আমি জানি, খুব ভাল করেই জানি ।
আমি শুরু করলাম আমার এক্সপেরিমেন্ট ।
কসম বলি তাহিতি, যতবার আমি তোমাকে একটা করে খারাপ কথা বলেছি ততবার আমি মনে মনে দুইবার করে স্যরি বলেছি ।
তোমাকে অধৈর্য করতে করতে নিজের ধৈরযের বাঁধটই ভেঙে যাচ্ছিল । মাঝে মাঝে মনে হয় এই সব মিথ্যা অভিনয় ফেলে তোমার কাছে দৌড় দিয়ে চলে যাই, মনে হত তোমাকে শক্ত করে বুকে নিয়ে বুঝিয়ে দেই এগুল সব মিথ্যা । কিন্তু আমার জেদ আর আমার কৌতূহলের কাছে আমি পারিনা , আমার ভালবাসাটাও পারেনা ।
সেদিন শুনলাম তোমার বিয়ের কথা । জীবনে একি সাথে খুব কষ্টের আর খুব আকাঙ্ক্ষার কথা কখনও শুনেছ ? আমি শুনলাম সেদিন । মনে হচ্ছিলো কে জানি আমার বুকের ভিতরে খামচে ধরেছে ! ওহ আল্লাহ্ আমি কি করব !
পরের দিন এসে তুমি তোমার বিয়ের কার্ড দিয়ে গেলে । একটা কথাও বললে না মুখে, একটাবার বললেনা আমাকে কিছু । মনে হচ্ছিল কার্ড টা তোমাকে গিলে খাওয়াই, মনে হচ্ছিল তোমাকে ধরে বেঁধে রাখি । মনে হচ্ছিলো চিৎকার দেই একটা !
কিচ্ছু করলাম না আমি, কিছুই না ।
আমার আর মাত্র তিনটা দিনের অপেক্ষা, তার পরেই আমি পেয়ে যাব আমার আকাঙ্খিত সেই মুহূর্ত ।
সন্ধার পর থেকে আমার পৃথিবীটা দুলছে । পেটের ভিতরতা বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । মনে হচ্ছে কি জানি নাই, কি জানি একটা হারিয়েছি । চড়কিতে করে অনেক উঁচু থেকে নামার সময় যেমন অনিভুতি হয় পেটের মাঝে ঠিক তেমন । কিন্তু পেট তো আমার ভরা, একটু আগেই তো খেয়ে আসলাম তোমার বিয়ের দাওয়াত। রান্নাটা দারুন ছিল !
আমি এখন কোথায় জানো ? ইচ্ছা করলেই তোমার ঘরের রাস্তার দিকের জানলাটার পর্দা সরিয়ে আমাকে দেখতে পারবে । দেখ ফুটপাথের উপরে বসে আছি আমি, হলুদ পাঞ্জাবি আর খালি পা নিয়ে । অপেক্ষা, আমার অপেক্ষা ! আমার এতও দিনের অপেক্ষার সেই মুহূর্ত আর একটু দূরে, অল্প একটু।
আমি দেখলাম তোমার ঘরে তোমাকে নিয়ে আসা হল, জানালার ঘসা কাঁচটাও যথেষ্ট না তোমার অবয়ব চিনতে আমাকে বাঁধা দেবার জন্যে । আমি দেখলাম তোমার ঘর থেকে সবার এক-এক করে বেরিয়ে যাওয়া । আমি দেখলাম তোমার ঘরে অন্য একটা অপরিচিত পুরুষ অবয়বের প্রবেশ । আচ্ছা কেন, আমার চোখে পানি কেন ? নিজের হাতে আমি এরকম করেছি । সম্পূর্ণ নিজের চাওয়ায় আমি এটা করেছি, তাহলে ! নাহ এটা কান্না নয় !
মনে হচ্ছে একটা ঢিল দিয়ে তোমার জানলার কাঁচটা ভেঙে ফেলি, ইচ্ছা করছে তোমার বাসায় একটা গ্রেনেড মারতে । ইচ্ছা করছে একটা স্টেন গান নিয়ে তোমার বাসার প্রত্যেকটা মানুষকে তিনটা করে গুলি করি । ইচ্ছা করছে... আমার ইচ্ছা করছে, আমি জানি না আরও কত কি ইচ্ছা করছে । জানি না, জানি না, জানি না । চিৎকার দেই একটা, খুব জোড়ে দেই একটা চিৎকার ?
যখন তোমার ঘরের জানালার পর্দা গুলো সরে এসে বন্ধ হতে দেখলাম, আমি কিছুই করলাম না, শুধু বসেই থাকলাম । কিছুক্ষণ পরে লাইটটা যখন নিভে গেল, আমি আর পারলাম না , আর পারলাম না বসে থাকতে । ছুটতে লাগলাম, কোন দিকে সেটা জানিনা আমি । কোন দিক আমি চিনতে পারছিনা, চোখ ভর্তি পানি আমার, কিছু দেখতে পারছিনা না ...শত সহস্র আলো আমাকে ঘিরে উরে বেরাচ্ছে । আমি মরে যাচ্ছি, নিশ্চয় আমি মরে যাচ্ছি ! সব গুলো আলোর মাঝ থেকে একটা আলো হঠাৎ একটু বেশী কাছে এসে পড়ল ।
আলোগুলো কোথায় হারাচ্ছে, আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে কেন সব ? আয়, আলো আয়, ঘিরে ধর আমাকে । আমি হাসব, উৎসব করব, আমি উল্লাস করব । কারন আমি যে জেনেছি ভালবাসা কি ।
তারপরে ? তারপরে তো আর জানিনা ।
পরিশেষঃ এরপর শুধু মনে করতে পারি অনেকদিন, অনেকদিন আমি বিছানা ছেড়ে উঠিনি । মনেপড়ে অনেকদিন, অনেকদিন আমি আমার নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখিনি । মনেপড়ে অনেকদিন, অনেকদিন আয়নাতে আমার মুখটা দেখিনি, ভুলতে বসেছিলাম আমার নিজের মুখ আমি নিজেই । অনেক দিন তোমার কথা আমার মনে পড়েনি তাহিতি । আজ পড়েছে, তাই আজ বলার পড়ে যখন ওরা আমাকে বারান্দায় এনে বসাল, একটু ঘেমে গেলাম আমি । আজ বারান্দায় বসলে, একটু ঘাম গড়ালেও আমার কিছু যায় আসেনা, কারন সময়ের ব্যাপারটা তো আমার জানা হয়েই গেছে । আজ যখন ওরা আমাকে একটা আয়না দিল, মুখের দাড়িগুলোকে ধূসর দেখেও কিছুই মনে হল না আমার, কিছুই না ।
আমার কথাঃ ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন । আমি প্রফেশনাল নই, তাই হয়ত অনেক জায়গায় অনেক সামঞ্জস্য রাখতে পারিনাই । আর আমার আরেকটা দুর্বলতার জায়গা হল জ্যোতিচিন্হ, এই জিনিষটা আমি একদমি ঠিক ভাবে ব্যাবহার করতে পারিনা ।
উৎসর্গ পত্রীঃ একজন মানবী । সেই মানবী, যে আমাকে বুঝেও বুঝতে চায়না ।