১৯৭১ সালের ৩মে আমি যখন পাকিস্তান আর্মির অতিথি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পরিদর্শন করি, তা ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো। জানতে পারলাম আমাদের সুবিধার্থে পুরো জায়গাটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। অবশ্য তার পরেও সব মুছে যায়নি, যতটুকুই বা চিহ্ন ছিলো তা ই গভীর ছাপ ফেলেছিলো আমার সচেতন, অবচেতন এমনকি অচেতন মনে।
ঐ বছর ২৫ ও ২৬ মার্চের ভয়ানক রাতে ঠিক কি হয়েছিলো তা দেখতে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম সেখানে। পরিদর্শনের শুরুতেই দেখলাম হলের বাইরের দেয়ালে বোমার আঘতে তৈরী গর্তগুলি। হলের ভেতর ঢুকে যা দেখলাম তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটি জিনিস আমি আজও ভুলিনি।
আমার মূল ধারণা ছিলো পাকিস্তান আর্মি নির্বিচারে ঐ রাতে অসংখ্য ছাত্রকে হত্যা করেছে। কিন্তু সব দেখার পরে বুঝলাম যে এলোপাতাড়ি কিছুই করা হয়নি, সব কিছুর মধ্যে ছিলো পরিকল্পনার ছাপ যা ঘটনার এতদিন পরেও মুছে যায়নি।
পুরো জায়গাটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে এবং আমি সেখানে গিয়েছিলাম ঘটনার ৪৩ দিন পরে। সিড়ির পাশের দেয়ালে লেগে থাকা রক্তের ছাপ প্রমান দিচ্ছিলো যে মৃতদেহগুলো সিড়ি দিয়ে টেনে নামানো হয়েছে।
শরীরের নানা অংশের যেমন চুল, আঙ্গুল, নাক বা কানের টুকরা হওয়া বিচ্ছিন্ন অংশগুলো তখনও লেগেছিলো দেয়ালে।
আগে বলেছি যে আমার ধারণা ছিলো হত্যাকান্ড হয়েছে এলোপাতাড়ি, কিন্তু সব কিছু দেখে আমার ভুল ভেঙ্গে গেলো। প্রতিটি কক্ষেই আলাদা করে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রদের। ঘরগুলো ধোয়া মোছার পরেও সেখানে প্রচুর ছেড়া বই খাতা কাগজ পড়েছিলো। বাংলা ও ইংরেজীতে লেখা কিছু চিঠি দেখতে পেলাম যার কিছু হয়তো বাবা মায়ের আর কিছু প্রিয়তমার।
সবকিছুতেই নির্দিষ্ট একই ধাঁচ ছিলো; প্রতিটি ঘরের সব জানালায় ঠিক একই অংশ ভাঙ্গা যা কিনা রাইফেলের বাটের আঘাতের চিহ্ন বহন করে। ঘরগুলোর বিছানার পাশের দেয়ালে ঠিক একই রেখায় গুলির দাগ(যা কিনা বিছানায় বসলে মাথা যে উচ্চতায় যায় সেই পর্যন্ত) দেখে বোঝা যায় ছাত্রদের বিছানায় দেয়াল মুখী হয়ে বসতে বলা হয়েছিলো।
প্রতিটি ঘরের একই জায়গায় বড় কালো ছোপ দেখেছি যাতে অনুমান করা যায় চারপাশে থেকে রক্ত গড়িয়ে সেখানে জড় হয়ে জমাট বেঁধে গেছে।
এটা বুঝেছি যে তাদের একই সাথে একই সময়ে হত্যা করা হয়েছে তা না হলে তাদের কেউ কেউ হয়তো পালানোর চেষ্টা করতো বা অন্য কিছু যাতে ঘরের অন্য কোথাও গুলির চিহ্ন দেখা যেতো, কিন্তু প্রতিটি ঘরেই দেখেছি সেই একই রকম নিদর্শন; জানালার নির্দিষ্ট অংশ ভাঙ্গা, দেয়ালে গুলির দাগের তৈরী রেখা, মেঝেতে রক্তের দাগ- এসব ই ঐ রাতের এক ভয়ঙ্কর ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলো।
এসব বলে কি আমার ভার কিছু কমলো? এ দুঃস্বপ্ন প্রায় রাতে আমার ঘুম ভাঙ্গায়। ১৯৭১ সালের বেদনাতুর স্মৃতিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম যা আজও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি।
প্রয়াত পাকিস্তানী সাংবাদিক এম বি নাক্বভীর এই লেখা ইংরেজী দৈনিক ডেইলী স্টার ছেপেছিলো কিছুদিন আগে। এ লেখা পড়ে বুকটা কেবলই মুচড়ে উঠছিলো, তাই অনুবাদ করে ব্যথাটা ছড়িয়ে দিলাম সবার মাঝে। বিজয়ের এই মাস যতবার আসবে ততবার যেন আমরা স্মরন করি এ দেশের ভাষা থেকে শুরু করে ভাত কাপড়ের অধিকার ও পবিত্র ভূ-খন্ড রক্ষার্থে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা কেমন অকাতরে প্রান দিয়েছিলেন। তাঁদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে দলমত নির্বিশেষে সবাই চেষ্টা করি নিজেদের জায়গা থেকে এ দেশকে কিছু দেবার।
লেখাটির মূল লিঙ্ক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ২:৪১