ইংরেজি ভাষায় আমি খুবই দুর্বল ছিলাম। এ জন্য অনেক ভুগেছি। মূলত সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে যোগদানের পর চিন্তা ছিল-যে দুর্বলতাগুলো আমাদের সময় ছিল তা যদি কোনভাবে পুষিয়ে দিতে পারি!
ভাষা শেখার জন্য প্রয়োজন চারটি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন: ক. শোনা, খ. বলা, গ. পড়া, ঘ. লেখা
আমাদের সময় শুধু গ ও ঘ মানে পড়া আর লেখাটাই ছিল। লিসেনিং বা শোনার জন্য ল্যাব কোন স্কুলেই ছিল না তাই এই দিকটা অপূর্ণ থেকে যেতো।
যেহেতু লেসেনিং-এর জন্য যন্ত্রপাতি এখন অনেক সহজলভ্য, ঠিক করলাম ভাষা শেখার জন্য আমি লিসেনিং-এর ক্লাস নেব।
প্রেক্ষাপটে
স্কুলে নতুন এসেছি, যে স্কুলটায় আমি যোগদান করি স্কুলটা শহরে হলেও শ্রমজীবি লোকদের বাচ্চারা পড়াশোনা করে। কারো বাবা হয়তো খুচরা দোকানদার, কারো বাবা মিস্ত্রি, আবার কারো বাবা হয়তো রাজমিস্ত্রী, রিকশা চালক, গার্মেন্টসের শ্রমিক, ইল্কেট্রিক মিস্ত্রি, ঝালমুড়ি বিক্রেতা ইত্যাদি। অনেক ছেলেমেয়ের মা কিংবা বাবা নেই। ভাঙ্গা সংসার।
স্কুলটি যদিও সরকারি খাস জমিতে অবস্থিত তবে বাহিরের কোন অনুদান নেই। সমস্ত শিক্ষকদের বেতন হয় ছাত্রছাত্রীদের পয়সায়। মোট ৭টি কক্ষের একটিতে অফিস/শিক্ষকদের বসার জায়গা। বাকী ৬টি শ্রেণিকক্ষ। শ্রেণিক্ষগুলো লম্বা আর গুমোট। দিনেও বাতি জালাতে হয়। গরমের দিনে ভ্যাপসা ঘামের গন্ধে ক্লাস করা দায় হয়ে পড়ে।
লিসেনিং-এর জন্য -
১. নিজের মতো করে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করলাম।
২. বাসার সাউন্ড সিস্টেমটা ক্লাসে ব্যবহার করব।
৩. অন্তর্জাল থেকে কন্টেন্ট নামালাম।
ইচ্ছা ছিল পাঠ্য বইয়ের লিসেনিং কন্টেন্টগুলো নেব। কিন্তু কোথায় তা পাওয়া যাবে তা জানা নেই। অন্তর্জালে খুঁজেছি পাই নি। শুনেছিলাম একটি গাইড বইয়ের সাথে লিসেনিং-এর সিডি ফ্রি দিয়ে থাকে, সেটা সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি পাই নি।
২০১৬-৬ষ্ঠ শ্রেণির মেয়েদের শাখায় এই লিসেনিং ক্লাসটা শুরু করেছিলাম। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০-এর মতো ছিল। সঠিক সংখ্যাটা এখন আর মনে নেই। এই স্কুলটা যদিও ছেলে ও মেয়ে একত্রে পড়াশোনা করে। এ বছর অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার কারনে ছেলে ও মেয়ে আলাদা করে ভাগ কর দু’টি শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে।
স্কুল
আধাপাকা স্কুল অর্থাৎ চারপাশে ইটের গাঁথুনি উপরে টিন। ক্লাসের কোন আদর্শ মাপ অনুসরন করা হয় নি। ক্লাসগুলো দুপাশে চাপা কিন্তু লম্বা। দুই সারি বেঞ্চের একপাশে ছেলে অন্য পাশে মেয়েরা চাপাচাপি করে বসে। মাঝখানের সরু জায়গাটুকু দিয়ে একজন শিক্ষকের হাঁটা কষ্টকর।
স্কুলটির কোন ধরণের সামাজিক সংশ্লিষ্টতা নেই। সম্পূর্ণ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা অত্যন্ত দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহকারি প্রধান শিক্ষক ও স্কুলের প্রতিষ্ঠা থেকে সংশ্লিষ্ট বলে প্রধান শিক্ষক কোন ক্লাস নেন না যদিও অন্যান্য শিক্ষকরা ক্লাস নিতে নিতে ক্লান্ত থাকেন। তাদের স্বেচ্ছাচারিত স্পষ্ট।
সিলেবাস বা শ্রেণির পাঠের সাথে তুলনা
যখন থেকে পরিকল্পনা করলাম যে লিসেনিং-এর ক্লাস নেব। তখন থেকে লক্ষ্য চছল পাঠ পরিকল্পনাটি হবে পাঠ্যবই সংশ্লিষ্ট। প্রথমত, যাতে অভিযোগের মুখে পড়তে না হয় যে পাঠ্যবর্হিভুত পড়া আমি পড়াচ্ছি। পাঠ্যবইয়ে লিসেনিং-এর যে সেকশনগুলো আছে ঐগুলো অডিও সংগ্রহ করতে আমি ব্যর্থ হই। আসলে আমাদের ক্লাসে পাঠ্যবইগুলোর চেয়ে সহায়ক বা নোট বইযের মডেল প্রশ্নগুলোকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। অন্তর্জালে খুঁজলাম পেলাম না। শুধু একটি কবিতার আবৃত্তি পেলাম। লক্ষ্য ছিল সিলেবাসের সাথে পাঠ পরিকল্পনাটি সংশ্লিষ্ট রাখার। তাই সিলেবাস হতে ইংরেজি লেখা দক্ষাতা অর্জনের অংশটি হতে একটি গল্পের অডিও সংগ্রহ করলাম। আর সংলাপ চর্চাও অংশ হতে বাছাই করে এমন একটি ডায়লগ বাছই করলাম যার অডিও অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ করা যায়। বিশেষ কিছু ্অন্তর্জালে পেলাম না তাই বিবিসি একটি সংলাপ নিলাম।
পরিশ্রম
এ কাজটি করতে গিয়ে আমাকে যতটুকু শ্রম দিতে হয়েছে তা পুরোপুরিই ছিল আমার ব্যক্তিগত। ইন্টারনেট থেকে আমি কন্টেন্ট নামিয়েছি। কম্পিউটার ফরম্যাট করে প্রিন্ট করেছি। যাতে করে ফটোকপি করে সাবাইকে এককপি করে দেয়া যায়। বাসা থেকে রিকশায় করে সাউন্ড সিস্টেম বহন করা, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা সব কিছু আমাকেই করতে হয়েছে। স্কুল শুধু আমাকে লিসেনিং-এর ক্লাস নেয়ার অনুমতি দিয়েছে। সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস নিতাম। যেদিন ক্লাস করার জন্য বাসা থেকে সাউন্ড বক্স নিয়ে গিয়েছি, কোন সহকারি শিক্ষক এগুলো দেখে হয়তো বলেছেন এগুলো কেন এনেছি। আমি তখন বলেছি যে লিসেনিং-এর ক্লাস করার জন্য- ব্যস এতটুকুই। প্রধান শিক্ষক বা অন্য কেউ কোন দিন সেটাও জানতে চান নি।
আর্থিক সাপোর্ট বা লজিস্টিক সাপোর্ট
স্কুলের একটা সাউন্ড বক্স ছিল কিন্তু সেটা নষ্ট। ইন্টারনেট সংযোগ নেই স্কুলে। এমনকি একটা কমিপউটার ছিল তাও নষ্ট। যা সামান্য আর্থিক ব্যয় হয়েছিল, যেমন রিক্সা ভাড়া, তা নিজেই খরচ করিছিলাম। লিসেনিং-এর টেক্সট কম্পিউটারে ফরম্যাট করে প্রিন্ট বের করে ফটোকপি করে দিয়েছিলাম। ফটোকপির টাকাটা শিক্ষার্থীরা দিয়েছিল। আর বছর শেষে সফলভাবে পাঠ কর্মসূচি শেষ হলে ছাত্রীদের উৎসাহিত করার জন্য সবাইকে একটি করে পেন্সিল দিয়েছিলাম।
শিক্ষার্থীদের উপভোগ
ছাত্রীরা বেশ মজা পেত ক্লাসটায়। নিয়মিত চক-ডাস্টারের বাইরে সাউন্ড সিস্টেম শুধু কোন অনুষ্ঠানেই ব্যবহৃত হতো। তাই ক্লাসে স্পিকারের মাধ্যমে কিছু শেখা তাদের জন্য ছিল নতুন। নির্ধারিত তারিখে তারা টেক্সট-এর ফটোকপি পাতাটা নিয়ে আসতো। যেহেতু কন্টেন্ট-এ ছিল নেটিভ স্পিকারের ভয়েস সে জন্য তাদের অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনতে হতো Rythem বা Toneটা বোঝার জন্য, আর এ জন্য আমাকে বার বার টেনে টেনে দিতে হতো। গলার ওঠা-নামায় বা বলা ভঙ্গির জন্য মাঝে মাঝে ওরা হাসিতে ফেটে পড়তো।
কিছু কথা
ঐ স্কুলে আমি পরে আরো দুটি বছর চাকরি করেছি কিন্তু আর লিসেনিং-এর ক্লাস নেই নি। স্কুল আর ব্যক্তিগত নান কাজের চাপ, স্কুলটি মাসের পর মাস বেতন আটকে থাকা ইত্যাদি সমস্যা মধ্যে থেকেও ক্লাসটি হয়তো চালানো যেতো যদি স্কুল কর্তৃপক্ষের আগ্রহ থাকতো আর নূন্যতম লজিস্টিক সাপোর্ট পেতাম।
বাসা থেকে নিয়মিত হেঁটে যেতাম স্কুলে। ১৫/১৬ মিনিটের পথ। যেদিন লিসেটিং-এর ক্লাস থাকতো ঐ দিন স্পিকারগুলো রিকশায় করে নিয়ে যেতাম। তারপর তা ক্লাসে বসাতে হতো। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ থাকতো না।
আর একটা বিষয়, পাঠ্যবইগুলোতে লিসেনিং ক্লাসের ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলা নেই। হয়তো টিচার্স ম্যানেয়েলে এ বিষয়ে বলা থাকতে পারে। তবে আমার সে ম্যানুয়েলটা এখনো দেখা হয় নি। স্কুলগুলো পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর চাইতে মডেল টেস্ট নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে।
ব্যবহৃত সাউন্ড বক্স
স্পেসিফিকেশন
উপসংহার
ভাষা যোগাযোগের বড় মাধ্যমে। আমাদের দেশে প্রচিলিত পদ্ধতিতে ইংরজি শিখে যখন বিদেশে যায় তখনতারা ইংরেজিতে কথা বললেও নেটিভরা তা বুঝতে পারে না। তাই এখানে যতো ভালো ব্যাকরণই জানুক না কেন যোগাযোগটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আবার নেটিভদের কথাও আমাদের বুঝতেও সমস্যা হয়। তাই ভাষার যে প্রধান কাজ যোগাযোগ সম্পূর্ণ করা তা ব্যর্থ হয়। ভাষা শেখার জন্য চারটা বিষয়কেই গুরুত্ব দিতে হবে। আরা শোনা, আমাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ, Rythem বা Tone অর্জনে সহায়তা করে। বর্তমানে অনেক কম খরচ করেও লিসেনিং-এর ক্লাস নেয়া যেতে পারে ফলে আমাদের আর ভাষা শেখার জন্য ল্যাব স্থাপন করতে হয় না। সামান্য খরচেই দারুণ একটা ব্যবস্থা করতে পারি অত্যন্ত সহজে। এ সুযোগটা আমাদের হাতছাড়া করা উচিত নয়।
মূল লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০২০ দুপুর ১২:৪৬