পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিলবোর্ডটি স্থাপনের জন্য শতাধিক শ্রমিক, একটা বিশালকায় ক্রেন জমায়েত হয়েছে ফাইভস্টার হোটেলটির সামনে। গ্রীনিজ বুক অব রেকর্ডের প্রতিনিধি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রিপোর্টাররা তো আছেনই। প্রধান উদ্বোধক হিশেবে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত হয়েছেন। সেই সাথে আছে সেনাবাহিনী প্রধান আর অন্যান্য সব উপদেষ্টা, সচিব ও সুশীল সমাজ। বিলবোর্ডের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার একবার ফাইভ স্টার হোটেলটির গাড়ীবারান্দায় গিয়ে চুলচেরা হিশেব করেন, পর্যটকদের আইসাইটে কোন বিভ্রম তৈরী করে কিনা আলোর প্রক্ষেপন, তা বিচার করেন। দিনরাত মিলিয়ে মোট সাত ধরণের বহিঃআলো এই বিলবোর্ডে পতিত হবে। সকালের আলোতে বিলবোর্ডের লেখাগুলো একটা কোমল দ্যুতি ছড়াবে, দুপুরের রোদে এর শব্দের উপরে ফ্লোরেসেন্ট জ্বলজ্বল করবে। বিকেলের স্বর্নাভায় বর্ডারের কালো রঙটা বেশ চমৎকার লাগবে। আবার বিদ্যুতহীন রাতের আলোতে আর মাঝরাতের স্ট্রিটলাইটের সময়টাতেও ফ্লোরেসেন্ট আলাদা ভেলকি দেখাবে।
প্রজেক্ট ম্যানেজার ক্রেনের উপরে দাড়িয়ে। পুরো লোহার ফ্রেমটা দাড়িয়ে গেছে। এখন বিশাল একটা পিভিসি ব্যানার রোল করে ঠিক উপরের এডজে লটকানো হচ্ছে। চারদিকে হৈচৈ। কোন কোম্পানী এই বিশাল বিলবোর্ডে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন সে নিয়ে একটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানীর বিশেষ কৌশল।
আপাতত বোঝাও যাচ্ছে না কোন পন্যের এই বিজ্ঞাপন। চারদিকের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীরা জনস্রোত ঠেকাতে ব্যস্ত। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হবার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে রাজী নয়। লাইভ ব্রডকাস্ট হচ্ছে দেশের দশটি চ্যানেল এক যোগে। সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরা, জি নিউজ, জিও নিউজে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে, ফলোআপ হচ্ছে। সে এক এলাহী কারবার!
বিশাল স্ক্রিনটার উপরের দিকের রোল খুলে দিলেই পিভিসি পুরো বিলবোর্ড জুরে নেমে যাবে। কাজ মোটামুটি শেষ। বিলবোর্ড প্রজেক্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার, প্রধান উপদেষ্টা আর সেনাবাহিনী প্রধান ক্রেনে করে একদম বিলবোর্ডের উপরে পৌঁছুলেন। দশতলার সমান উঁচু এই বিলবোর্ডটা চওড়ায় দেড় মিটার হবে। প্রধান অতিথিরা সেখানে দাড়িয়ে বিলবোর্ডের নীচের তিনকোনা রাস্তায় কেবল জনসমুদ্র দেখতে পেলেন। হাজার হাজার মানুষ। বেশীরভাগই হতদরিদ্র। বিলবোর্ড ঘিরে তাদের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই।
বিলবোর্ডের সামনের রাস্তার মোড়ে একটা স্টেজ করা হয়েছে। দেশের নামীদামী যন্ত্রশিল্পীরা সেখানে মিউজিকের সিম্ফনী তুলছে। হালের জনপ্রিয় উপস্থাপিকা তার বিশুদ্ধ উচ্চারণে ঘোষণা করলেন, এবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বিলবোর্ডটি উন্মোচন করে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিলবোর্ডের রেকর্ড গড়ার সুযোগ করে দেবেন! দর্শকমন্ডলী - এই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত! আপনাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে সেই পন্য যার জন্য এখন আপনাদের সবচেয়ে বেশী আগ্রহ!
উপস্থিত জনতার মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে চলে। বিলবোর্ডের উপর দিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল। ক্যামেরায় ধারণ চলছে। বিশাল লাউডস্পীকারে গমগম করে উঠলো প্রধান উপদেষ্টার কণ্ঠস্বর। সেনাবাহিনীর প্রধান পিভিসি ব্যানারের নট খুলছেন। প্রধান উপদেষ্টা এখন এই নটে হাত দিয়ে উদ্বোধন ঘোষণা মাত্রই পুরো বিলবোর্ডটি উন্মোচিত হবে লাখো দর্শকের চোখের সামনে। বাংলাদেশের নাম ঢুকে যাবে ইতিহাসের পাতায়।
প্রধান উপদেষ্টা তার গুরুগম্ভীর স্বরে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন। তারপরে বললেন, সুধীমন্ডলী, বাঙালীর সৌভাগ্য যে তাদের সবচয়ে প্রয়োজনীয় পন্যের ছবিতে এই বিলবোর্ডটা সাজানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এই বিলবোর্ডটা তৈরী করেছে। আপনাদের যখন খুব ইচ্ছে করবে তখন এই বিলবোর্ডের সামনে এসে দাড়াবেন, দেখবেন এক চমৎকার অনুভূতিতে দেহমন আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। পেটের ও মনের ক্ষুধা দূর হয়ে যাবে নিমিষেই।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে সমবেত জনতার মধ্যে ফিসফিসানী বাড়তে থাকে। আগ্রহ চুড়ান্ত রূপ ধারণ করে। কি রয়েছে এই বিলবোর্ডের অন্তরালে! প্রধান উপদেষ্টা তার রাষ্ট্রনায়োকচিত জলধ কণ্ঠে বলতে থাকেন, এটা পন্যের বিপননের জন্য শুধু নয়, এটা আপনাদের ইনস্টান্ট অভাবও দূর করবে! এই বিশাল বিলবোর্ড বিদেশীদের আকৃষ্ঠ করবে, বৈদেশিক বাণিজ্যের পথ সুগম করবে! তাছাড়া এই বোর্ডের জন্য খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক আমাদের লোন দিয়ে চিরকৃতজ্ঞ করেছে। এই বিলবোর্ডে প্রয়োজনীয় পন্যের কোটি কোটি ছবি আছে যার প্রতিটার জন্য খরচ পড়েছে হাজার হাজার টাকা। এর এক একটা একক আপনাদের একবার দর্শনেই সব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম! চমৎকার গ্রাফিক্সে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সবচেয়ে সুস্বাদু পন্যের ছবি।
দেশবাসী, আমি এই ঐতিহাসিক বিলবোর্ডের উদ্বোধন ঘোষণা করলাম।
লাখো জনতা উৎসুক তাকিয়ে আছে। স্টেজে মিউজিসিয়ানরা একটা কোরাস যন্ত্রসুর বাজাতে থাকে। পুরো প্রান্তর সে সুরে মোহিত হয়ে পড়ে। প্রধান উপদেষ্টাকে এবার সেনাবাহিনী প্রধান নটের অংশটা ধরিয়ে দেন।
এরপরে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের মঙ্গল কামনা করে নটটা খুলে ফেলেন। বিশাল স্ক্রিনটা হেলতে দুলতে গড়িয়ে নামতে থাকে নীচের দিকে। পুরোটা একটা ঝাঁকি খেয়ে সমান্তরাল লেপ্টে যেতে থাকে বিলবোর্ডের গায়ে।
অধীর জনতা মুগ্ধ হয়ে যায় এ বিশাল শিল্পকর্ম দর্শনে। পুরো বিলবোর্ড জুড়ে গোটা গোটা ভাতের ছবি। গরম গরম ভাপ উঠছে। সমবেত জনতা সেদিকে তাকিয়ে ভুলে যায় ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা। বুভূক্ষের মত তাদের খিদে মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।