অবিভক্ত বিহারের মানভূম জেলার পাকবিড়া গ্রামের মাঠ থেকে শুরু হয়ে, টানা ১৬ দিন পথ হেঁটে একটি মিছিল পৌঁছেছিল কলকাতায়। মিছিলের হাজার খানেক বাঙালির দাবি বলতে ছিল বাংলায় আলাপ করতে চাওয়া। বাংলায় লিখতে চাওয়া। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্কুল কলেজে হিন্দির বদলে তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাংলায় পড়াশোনা করুক। আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আবদুস সালামদের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি মনে রাখলেও, মানভূমের সেই পথ হাঁটা মনে রেখেছেন ক’জন?
মনে রেখেছেন। আজ, জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে শোনা যেতে পারে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের গান। ফি বছর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দফতর। জেলার বর্তমান তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক মানসী মণ্ডল সদ্য দায়িত্ব পাওয়ার পরই জানিয়েছিলেন, এ বছরের অনুষ্ঠানে মানভূমের ভাষা সৈনিকদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। সেই প্রতিশ্রুতি মতো, অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন লোকসেবক সঙ্ঘের সচিব-সহ কয়েক জন সদস্য।
স্বাধীনতার পরে তৎকালীন মানভূম জেলা বিহারের অন্তর্ভুক্ত হয়। কংগ্রেসের জেলার শীর্ষ নেতারা জাতীয় স্তরের নেতাদের কাছে সেই সময় আবেদন জানিয়েছিলেন, মানভূমের বাংলাভাষী মানুষজনকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কিন্তু সেই প্রস্তাব নিয়ে টালবাহানা চলতে থাকায় কংগ্রেসে ভাঙন ধরে। জেলা স্তরের অধিকাংশ নেতা কংগ্রেস ছেড়ে গঠন করেন লোকসেবক সঙ্ঘ। ১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হয়ে যায় ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবিতে আন্দোলন। তারপর ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল সেই ঐতিহাসিক মিছিল শুরু হয়। বাঁকুড়া, বেলিয়াতোড়, সোনামুখী, পাত্রসায়র, খণ্ডঘোষ, বর্ধমান, পান্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, হাওড়া হয়ে মে মাসের ৬ তারিখ প্রায় হাজার খানেক মানুষ পৌঁছন কলকাতায়। অবশেষে ওই বছর ১ নভেম্বর মানভূমের কিছু এলাকা পুরুলিয়া জেলা নাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্ত হয়।
আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে, ২০০৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পুঞ্চার পাকবিড়রা সেই মাঠে এসে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন ভাষা সৈনিকদের। কিন্তু, পুরুলিয়ার মানুষের খেদ ছিল, ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও পুরুলিয়ার ভাষা আন্দোলন তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। সেই আক্ষেপে এত দিন পলি পড়ল। লোকসেবক সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো বলেন, ‘‘তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে এই প্রথম ডাক পেলাম। সুযোগ পেলে সেই মঞ্চ থেকে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরব।’’ ওপার বাংলার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আব্দুল গফফর চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি।
সুশীলবাবু জানান, মানভূমের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল দু’টি টুসু গান— পুরুলিয়ার প্রথম সাংসদ ভজহরি মাহাতোর লেখা, ‘শুন বিহারি ভাই, তরা রাখতে লারবি ডাং দেখাই। ...এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষায় রাজ্য চাই’ এবং অরুণ ঘোষের ‘আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে।’ এ বারের অনুষ্ঠান মঞ্চে মিলে যেতে পারে দুই বাংলার আন্দোলনের সেই সুর।
তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের এ বারের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ভাষা সৈনিক বোরো থানার রাঙ্গামেট্যা গ্রামের নকুল মাহাতো এবং কেন্দা থানার পানিপাথর গ্রামের নারায়ণ মাহাতোরা। তাঁরা বলেন, ‘‘মানভূমের ভাষা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে কেউ শহিদ হননি। কিন্তু আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঘর ছাড়া হয়েছেন অনেকে। অনেককে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। সেই আন্দোলন ২১ ফেব্রুয়ারির পাশে স্বীকৃতি পাওয়ায় ভাল লাগছে।’’
সূত্র আনন্দবাজার
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:১৭