গত নভেম্বরে নির্বাচনকালীন সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় অনেকটা অনুমেয় ছিল। জো বাইডেনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার এবং কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করায় ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কিছুটা হলেও সামনে এসেছিল
কমলা নিজেও তার পরাজিত হওয়ার বিষয়টি অনুমান করতে পেরেছিলেন। এজন্য দেখা যায়, শেষ মুহুর্তে মুসলিম ভোটার টানার জন্য শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দিতে, কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। বলা বাহুল্য ট্রাম্পকে নানাভাবে বিচারিক হয়রানি করা এবং মূল ধারার গণমাধ্যম থেকে একরকম "অচ্ছুৎ" করে রাখাটাও দেশটির জনগণ ভালভাবে দেখেনি।
ট্রাম্পের অভূতপূর্ব বিজয়ের সাথে সাথে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নানা আলোচনা ও রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ চলতে থাকে, দেশগুলোও সেভাবে তাদের নীতি ও কৌশল সাজাতে থাকে।
ট্রাম্পের বিজয়ের পর আমি জার্মান টেলিভিশন ডয়চে ভেলের প্রোগ্রামগুলোর উপর চোখ বুলাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম কীভাবে সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে! এছাড়া ট্রাম্প এসেই কানাডা এবং ডেনমার্ক অধীনস্থ গ্রীনল্যান্ডকে প্রদেশ করার ঘোষণা বা পানামা খালকে পুনরায় দেশটির নিয়ন্ত্রণে নিতে চাওয়ার মতো বিষয়গুলো এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে।
ট্রাম্পের পাগলামির প্রতিক্রিয়ায় মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শিনবাউমও আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মেক্সিকোর দাবি করেছেন এবং সেগুলো মেক্সিকো একদিন উদ্ধার করবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ট্রাম্প মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে আমেরিকান উপসাগর রাখেন। সেখানে তিনি বলেন, আমেরিকা উপসাগর নামটি জাতীয় গৌরবের প্রতীক এবং এটি আরও আকর্ষণীয় শোনায়।
ট্রাম্পের হুমকির মুখে ডেনমার্ক গ্রীনল্যান্ডে সামরিক বাজেট প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার করেছে। কানাডা দৌড়ের উপর আছে। আরবরা ভাবছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও ট্রাম্পকে খুশি করতে ব্যস্ত।
ভারত ইতোমধ্যে ১৮ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত নিতে রাজি হয়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের মোট অবৈধ অভিবাসীদের তুলনায় সংখ্যাটা সামান্য। তারপরও দেশটি ট্রাম্পকে খুশি করতে চাচ্ছে।
এদিকে বছরে ৫০ লাখ মেট্রিক টন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার এই হেডস অব অ্যাগ্রিমেন্ট করেছে। বাংলাদেশ চাইলে এটা আগেও করতে পারতো, কিন্তু সরকার ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদলের সুবিধা নিয়েছে সিরিয়ার বিপ্লবীরা। তারা মোক্ষম সুযোগ বুঝে দেশটির ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তুরস্কের সাথে সাথে ইউক্রেনও বিপ্লবীদের রাশিয়ার বন্ধু আসাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করেছিল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ট্রাম্প নেতানিয়াহুকেও যুদ্ধ বন্ধ করার চাপ দিয়ে চুক্তি করাতে বাধ্য করেছে বলে মনে করা হয়। তবে এর পেছনে দুরভিসন্ধি থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয় গাজ্জা উপত্যকার অধিবাসীদের মিশর ও জর্ডানে পাঠাতে চাওয়ায়।
চীনের সাথে স্বভাবসুলভ বাণিজ্য যুদ্ধ, অন্যান্য দেশের উপরও শুল্ক আরোপ, প্রতিবেশীদের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব, ন্যাটো ও ইইউ দেশগুলোকে দৌড়ের উপর রাখা- সব মিলিয়ে ট্রাম্প বেশ চিল মুডে আছে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর ট্রাম্পের কর্মকান্ডের কিছু নমুনা-
➤কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে শেষ পর্যন্ত "খেয়ে দেওয়া"
কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছে, কানাডা কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হবে না। এটা একেবারে অসম্ভব । এর জবাবে ইলন মাস্ক কটাক্ষ করে বলেছে, বেটি! তুমি আর কানাডার গভর্নর না, তাই তোমার কথার কোন দাম নেই। এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছে, আমি সামরিক শক্তি ব্যবহার করে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছি না। তবে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হতে পারে।
➤গ্রিনল্যান্ড দখলে সামরিক শক্তি ব্যবহারে প্রস্তুত ট্রাম্প
ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ডের দখল নেয়ার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তুত বলে জানা গেছে। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ওয়াল্টজ এক বিবৃতিতে বলেন, "গ্রিনল্যান্ড নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ট্রাম্প সমস্ত সম্ভাব্য বিকল্প বিবেচনা করতে প্রস্তুত, যার মধ্যে শক্তি ব্যবহারের পরিস্থিতিও অন্তর্ভুক্ত।" এছাড়া গ্রিনল্যান্ডকে কিনে নেয়ার বিল প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসে।
➤হামাসের সাথে ইসরায়েলের বন্দি বিনিময় চুক্তি
➤"অবৈধ অভিবাসী" বিতারিত করার কর্মসূচি
➤স্টারগেট প্রকল্প
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে আধিপত্য ধরে রাখতে এই প্রকল্প। এখানে আগামী ৪ বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে। তবে চাইনিজ স্টার্টআপ ডিপসীক এসে ইতোমধ্যে পশ্চিমের এআই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় "১ ট্রিলিয়ন ডলার" ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছে।
➤বৈদেশিক সাহায্য স্থগিত
ইউএসএআইডি এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তবে এই স্থগিতাদেশ ইসরাইল, জর্ডান এবং মিশরের জন্য প্রযোজ্য হবে না। নেটিজেনরা কটাক্ষ করে ইসরায়েলের পাশে থাকা দুটি মুসলিম দেশ সহ ওই অঞ্চলকে 'ইহুদি ক্রিসেন্ট' বলে অভিহিত করছেন।
➤"ওয়ান ফ্ল্যাগ" পলিসি
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নতুন নীতি চালু করেছে। এই পলিসির আওতায় শুধু আমেরিকান পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প।
যার অধীনে মার্কিন দূতাবাস ও সরকারি স্থাপনাগুলোতে আমেরিকান পতাকা ছাড়া অন্য কোনো পতাকা, যেমন LGBTQ প্রাইড বা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার পতাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
➤সৌদি আরবের ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা
আগেরবার এমবিএস খুশি হয়ে ১১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। এবার সৌদি সেটা প্রায় ৬ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ কী হতে পারে? এতেও ট্রাম্পের মন ভরছে না, তিনি নাকি সৌদিকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অনুরোধ করবেন।
➤তালেবান থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ফেরত আনা
ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছে, তিনি আফগানিস্তানে ২০২১ সালে ফেলে আসা ৭ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম তালেবান থেকে ফেরত আনবেন। তবে, তালেবান স্পষ্ট জানিয়েছে যে তারা এই সরঞ্জাম ফেরত দেবে না। উল্টো তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আরও অস্ত্র দাবি করে বলেছে, আইএসের সাথে যুদ্ধ করতে তাদের নাকি আরও অস্ত্র দরকার
➤মেক্সিকো সীমান্তে আরও ১,৫০০ সৈন্য পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষরের মাত্র দুই দিনের মধ্যে মেক্সিকো সীমান্তে আরও ১,৫০০ সক্রিয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে হোয়াইট হাউস। নতুন পাঠানো সৈন্যদের মধ্যে ৫০০ মেরিন, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ক্রু এবং গোয়েন্দা বিশ্লেষক রয়েছেন। তারা ইতোমধ্যে সীমান্তে অবস্থানরত ২,২০০ সক্রিয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈন্য এবং হাজারো ন্যাশনাল গার্ড সৈন্যের সঙ্গে যুক্ত হবেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে মেক্সিকো সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৫,২০০ সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
➤কলম্বিয়াকে অবৈধ অভিবাসী নিতে বাধ্য করা
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রথমে রাজি ছিলেন না। তিনি যাচাই বাছাই ও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের এতকিছু শোনার সময় ছিল না। শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই কলম্বিয়া ট্রাম্পের কথায় রাজি হতে বাধ্য হয়।
তাইওয়ানের উপর শুল্প বসানোর ঘোষণা!
ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছে, তিনি তাইওয়ান থেকে আনা চিপ এবং ওষুধ তৈরির পণ্যের ওপর ২৫-১০০% শুল্ক বসাবে। এর মাধ্যমে তিনি মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বিশেষ করে TSMC-কে, তাদের পণ্য তৈরির কাজ যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে চাপ দিতে চান।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পাগলা ঘোড়া কতখানি দৌড়াবে এবং সে কখন থামবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:৪০