সার্স-কোভ-২ হচ্ছে এক প্রকার করোনাভাইরাস যা চলমান সংক্রামক ব্যাধি কোভিড-১৯ ঘটিয়েছে। সম্প্রতি চীনের গবেষকরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার সম্ভাব্য প্রতিষেধক হিসেবে মৌমাছির বিষের উপর গবেষণার প্রস্তাব করেছেন। ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ ই মার্চ পর্যন্ত চীনের কোভিড-১৯ -এর কেন্দ্রস্থল উহান শহরের ৭২৩ জন সহ মোট ৫,১১৫ জন মৌমাছি পালনকারীদের উপর সমীক্ষা করা হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, মৌমাছি পালকদের কেউ-ই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়নি।
এরপরে গবেষকরা পাঁচজন এপিথেরাপিস্টের সাক্ষাত নেন, যারা ১২১ জন রোগীকে মৌমাছিদের বিষ দিয়ে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। ফলাফল, ১২১ জন রোগীর মধ্যে কেউ-ই সার্স-কোভ-২ দ্বারা সংক্রামিত হয়নি। যদিও তাদের মধ্যে তিনজন ভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছিলো। পাঁচজন এপিথেরাপিস্টের মধ্যে ৩ জন কোনো রকম প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে কোভিড-১৯ রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাদেরও কেউ আক্রান্ত হয়নি।
গবেষকদের মতে, মৌমাছি পালনকারীরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা কম ছিল কারণ তারা কম ঘনবসতিযুক্ত গ্রামাঞ্চলে বাস করত। কিন্তু, পাঁচজন এপিথেরাপিস্ট এবং তাদের রোগীরা উহানের জনবহুল অঞ্চলে বসবাস করতেন। তবে তাদের মধ্যে একটি জিনিস মিল রয়েছে বলে মনে হয়; সেটা হচ্ছে তারা সবাই মৌমাছির বিষ সহ্য করতে পারতেন।
চলুন দেখি, কিভাবে মৌমাছির বিষ ভাইরাস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। মৌমাছির বিষকে বলা হয় এপিটক্সিন ও মৌমাছির বিষ প্রয়োগ করে চিকিৎসার পদ্ধতিটির নাম এপিথেরাপি ৷ চীনে এপিথেরাপি তিন হাজার বছরের পুরনো এবং ২০০৭ সালে এ চিকিৎসা বৈধতা পেয়েছে।
হোমিওপ্যাথির মতো এপিথেরাপির কার্যকরিতা সম্পর্কে প্রথাগত বিজ্ঞানের সন্দেহ থেকে গেছে৷ এপিথেরাপিতে মৌমাছির হুল ফুটিয়ে চিকিৎসা করা হয়, যা অনেকটা আকুপাংচারের মতো। তফাৎ শুধু এই যে ডাক্তাররা শরীরে সুঁচ না ফুটিয়ে মৌমাছির হুল ফোটান। এই চিকিৎসায়, চিমটে দিয়ে ধরে একটি একটি করে মৌমাছি বসানো হয়। মৌমাছিটি হুল ফুটিয়ে বিষ ঢেলে দিয়েই প্রাণত্যাগ করে। রোগীর শরীরে কয়েক ঘণ্টা ধরে হুল এবং বিষ থেকে যায়। তবে, যাদের মৌমাছির বিষে এ্যালার্জি থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
মৌমাছির বিষের অন্যতম উপাদানটি হচ্ছে মেলিটিন; যাহাতে ৫২% পেপটাইড আছে। নিচের চিত্রে প্রাণীর বিষের পেপটাইড কিভাবে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরিতে বাধা দেয় তা আমরা দেখতে পাই।
উপরের চিত্রটি সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলে, প্রথমে বিষের পেপটাইড (1b ও 1c), ভাইরাসের গ্লাইকোপ্রোটিনকে মানবকোষের রিসেপ্টরের (CD4) ও কো-রিসেপ্টরের (CCR5 ও CXCR4) সাথে সংযুক্তিতে বাধা দেয়। এতে ভাইরাসটির এনভেলপ ভেঙে যেতে পারে (1a) । ফলে, ভাইরাসের এনভেলাপ কোষের মেমব্রেনে প্রবেশে বাধা প্রাপ্ত হয়। এরপরে ভাইরাসটির প্রতিলিপি তৈরিতে পেপটাইড হস্তক্ষেপ করে ও পোস্ট- ট্রান্সলেশন প্রসেসে ভাইরাল ক্যাপসিডের সমাবেশ করতে দেয় না। যার ফলে, মানবদেহের কোষে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা রোধ হয়। (বিস্তারিত তথ্যসূত্রঃ [২])
ইতিমধ্যে পেপটাইডকে কাজে লাগিয়ে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। এর জন্য কাজ করছে বার্লিনের JPT পেপটাইড টেকনোলজিস (http://www.jpt.com) কোম্পানি । (বিস্তারিতঃ নিচের ডয়েচে ভেলের রিপোর্টের ইউটিউব ভিডিও, Apr 6, 2020)
চারপাশে উদীয়মান নতুন ভাইরাস সর্বদায় চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে। ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ব্যবহারের উপযোগী এবং অনুমোদিত হতে অনেক বেশি সময় নেয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন এখনও সফল ভাবে তৈরী হতে পারে নি। এইরকম পরিস্থিতিতে হয়তো মৌমাছির বিষ বা অন্য কোনো প্রাণীবিষে প্রাপ্ত পেপটাইডের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করে মানবজাতির সুরক্ষা সম্ভব হতে পারে।
মৌমাছির বিষ মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই বিষকে নানা রকম চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করে এসেছেন। অতিমাত্রায় মৌমাছির বিষ অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবে স্বল্প মাত্রায় এর প্রয়োগে মানুষের টি-সেলগুলোতে পরিবর্তন আসে, যা সার্স-কোভ-২ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিনের অভাবে হয়তো এই বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিটি করোনা জয়ের আশা জাগাতে পারে।
ইউটিউব ভিডিওঃ
সংক্ষেপে চীনে এপিথেরাপি:
এপিথেরাপি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক:
তথ্যসূত্রঃ
[১] ছবিঃ ইন্টারনেট
[২] Springer: Antiviral activity of animal venom peptides and related compounds
[৩] Bee venom appears to protect against SARS-CoV-2 infection
[৪] Inhibitory effects of bee venom and its components against viruses in vitro and in vivo
[৫] Bee Venom: Overview of Main Compounds and Bioactivities for Therapeutic Interests
[৬] Articles on Api-Virology