করোনাভাইরাস নিয়ে বর্তমান বিশ্বে এখন একধরণের আতংক বিরাজ করছে। নিমেষেই তা মানুষ থেকে অন্য মানুষে ভয়াবহ গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাস পরিবারে করোনাভাইরাস আছে, তবে এ ধরণের ছয়টি ভাইরাস আগে পরিচিত থাকলেও এখন মানুষ যেটিতে সংক্রমিত হচ্ছে, সেটি নতুন। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে পুরো বিশ্ব উদগ্রীব। যদি ভাইরাসের উৎস সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে রোগটি মোকাবেলা করা অনেক সহজ হবে। তাই সবার মনে প্রশ্ন জাগছে, এর উৎস কী হতে পারে! এ নিয়ে নানা মতভেদ দেখা দিয়েছে। সঠিক উৎস অনুসন্ধানে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা -নিরীক্ষা চলছে। চলুন, এর সম্ভাব্য উৎস অনুসন্ধানে আমরা নিজেরাও একটু ভাবনার জগতে ডুব দেই ।
সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2 ) বা গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ২ (Severe Acute Respiratory Syndrome CoronaVirus 2) হচ্ছে এক প্রকার করোনাভাইরাস যা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে ২০২০ সালে চলমান একটি বৈশ্বিক মহামারীর ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তাই ভাইরাসটির আক্রমণে সংক্রামক ব্যাধিকে করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ বা কোভিড-১৯ (COVID 19) নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনেকগুলো করোনা ভাইরাস জুনেটিক অর্থাৎ তারা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। প্রাথমিক ভাবে চীন সরকার সার্স-কোভ-২ বাদুড় থেকে চীনের উহান শহরের মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হয়েছে বলে প্রচারণা চালায়। এই প্রচারণায় তারা বলে এটি চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীতে সামুদ্রিক মাছ পাইকারিভাবে বিক্রি হয় এমন একটি বাজারে থেকে ছড়িয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমদিকে সনাক্ত রোগীদের কেউই ঐ বাজারে যায় নাই এবং ঐ সময়ে সেখানে কোনো বাদুড়ও বিক্রয় হয় নাই।
সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের আণুবীক্ষণিক ত্রিমাত্রিক বহির্গঠন। সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন দ্বারা প্রকাশিত।
উপরের চিত্রে করোনাভাইরাসের আণুবীক্ষণিক ছবির রূপক ডায়াগ্রাম থেকে আমরা দেখতে পাই এটি মূলত এনভেলপ প্রোটিন (E), নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন (N), মেমব্রেন-গ্লাইকো প্রোটিন (M) , স্পাইক প্রোটিন (S ) ও আরএনএ (RNA) দ্বারা গঠিত। স্পাইকের উপরের অর্ধাংশ কে S1 ও নিচের অর্ধাংশ কে S2 বলা হয়। ভাইরাসের গায়ে ব্যাঙের ছাতার মত দেখতে স্পাইক প্রোটিন (S ) গুলোর কারণে ভাইরাসটি অনেকটা মুকুটের মতন দেখায়। 'করোনা' শব্দটির অর্থ হচ্ছে মুকুট। এই S - প্রোটিনের একটি বিশেষ পৃষ্ঠতল ব্যবহার করে ভাইরাসটি জীবন্ত কোষের অ্যানজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-২ (Angiotensin-Converting Enzyme 2) বা এসিই-২ (ACE-2) রিসিপ্টরের যুক্ত হয়ে মধ্যে মানব কোষে প্রবেশ করতে পারে (নিচের চিত্র )।
বোঝার জন্য আমরা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে অনেকটা মেইল কানেক্টর (male connector ) ও আমাদের কোষে এসিই-২ রিসিপ্টর কে ফিমেইল কানেক্টরের (female connector) সাথে তুলনা করতে পারি (নিচের চিত্র)।
সহজভাবে সার্স-কোভ-২ বোঝার জন্য, আমরা নিচের ৪ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের ভিডিওটিও দেখতে পারি :
করোনাভাইরাসের অণুগুলো যখন আমাদের চোখ, নাক বা মুখের ভিতরে প্রবেশ করে, তখন ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনগুলো (S) আমাদের কোষ-পৃষ্ঠের এসিই-২ (ACE-2) রিসেপ্টারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এসিই-২ (ACE-2) রিসেপ্টররা আমাদের শরীরজুড়ে বিভিন্ন কোষে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ফুসফুসের এলভিওলার কোষে এসিই-২ (ACE-2) প্রচুর পরিমানে রয়েছে । ফলে ভাইরাসটি ফুসফুসের এলভিওলার কোষে প্রবেশ করে মানব দেহের শ্বাসযন্ত্রে রোগলক্ষণ তৈরী করতে পারে। একবার ভাইরাস প্রবেশের পরে, এটি দেহকোষকে একটি ভাইরাস কারখানায় পরিণত করে, নিজের কয়েক মিলিয়ন-মিলিয়ন ভাইরাল-কপি তৈরি করে- যা পরে শ্বাসক্রিয়া বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত করে। কাজেই, S - প্রোটিনের গঠন নিখুঁত ভাবে জানতে পারলে চিকিৎসদের ভাইরাস সংক্রমণের ফলে রোগটি নির্ণয় করতে সুবিধা হবে এবং তা টিকা ও জীবাণুনাশক ঔষুধ তৈরি করতেও সাহায্য করবে ।
বাদুড়ে পাওয়া ZC45 ও ZXC21 করোনাভাইরাসের সাথে সার্স-কোভ-২-এর প্রোটিন সিকিউন্স তুলনা করলে দেখা যায় সার্স-কোভ-২ বাদুড়ে করোনাভাইরাসের সাথে সামগ্রিক ভাবে প্রায় ৯৫% সাদৃশ্য। যেখানে E - প্রোটিন ১০০%, N -প্রোটিন ৯৪%, M - প্রোটিন ৯৮.৬%, S - প্রোটিনের S2 অংশ ৯৫% ও S1 অংশ ৬৯% সাদৃশ্যপূর্ণ। আর এই S1 অংশের মাত্র ৬৯% সাদৃশ্যই প্রমান করে ভাইরাসটি বাদুড় থেকে আসে নি। এছাড়া কোনো প্রাকৃতিক ভাবে মিউটেশন হয়ে বিবর্তন হলে সম্পূর্ণ জিনোমেই পরিবর্তন হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে নির্দিষ্ট ভাবে S1 অংশে বড় পরিবর্তন লক্ষণীয়।
যে করোনা ভাইরাস থেকে ২০০৩ -এ সার্স মহামারী হয় তার সাথে সার্স-কোভ-২ -এর ৮৬% সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এখান থেকে বলা যায় যে সার্স করোনাভাইরাস ও সার্স করোনাভাইরাস-২ -এর উৎস ভিন্ন। এছাড়া গবেষণায় দেখা যায়, সার্স ভাইরাসের তুলনায় সার্স-কোভ-২ -এর S - প্রোটিনের মানবকোষের আবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা ১০-২০ গুন্ বেশি।
সার্স-কোভ-২-এর S - প্রোটিনের সাথে প্যাঙ্গলিনে সংক্রমিত করোনা ভাইরাসের S - প্রোটিনের ৯৯% গঠনগত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে প্যাঙ্গোলিনের দেহে বিদ্যমান করোনা ভাইরাসের সাথে সার্স-কোভ-২ এর সাদৃশ্য প্রায় ৯০% মাত্র। প্যাঙ্গলিনে পাওয়া করোনা ভাইরাসে ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটও নাই। এই থেকে ধারণা করা হয় বাদুড়ে ও প্যাঙ্গলিনে পাওয়া ২ প্রকার করোনা ভাইরাসের রিকম্বিনেশনে বা শংকরণে সার্স-কোভ-২ তৈরী হতে পারে। কিন্তু এই শংকরণের জন্য এই ২ প্রকার করোনা ভাইরাস অবশ্যই একটি জীবে একই সময়ে সংক্রমণ করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, কোন প্রজাতির জীবে এই শংকরণ ঘটে বা ঘটানো হয়? এবং কেমন পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এই ঘটনা ঘটে? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা।
উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির চাইনিজ ব্যাট ওম্যান ডঃ শি ঝেংলি
৩রা ফ্রেব্রুয়ারি ২০২০ এ Nature আর্টিকেলে উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির ডেপুটি ডিরেক্টর ও চাইনিজ ব্যাট ওম্যান নামে খ্যাত ডঃ শি ঝেংলি গ্রূপের ভাইরোলজিস্টরা দাবী করেন, বাদুড়ে পাওয়া করোনাভাইরাস RaTG13 সার্স-কোভ-২-এর সাথে ৯৬.২% সাদৃশ্যপূর্ণ। কিন্তু পরে দেখা যায় RaTG13 - এর রিয়াল কোনই স্যাম্পল নাই।এটা শুধু মাত্র খাতা কলমেই পাওয়া যায় এবং ডাটা গুলো কপি করা হয়েছিল BtCoV/4991 করোনাভাইরাস থেকে, যেখানেও সামান্য কিছু পরীক্ষা করা হয়েছিল । ২০১৫ সালে উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির অন্যতম প্রধান গবেষক ডঃ শি ঝেংলি Nature Medicine - এর একটি জার্নালে বলেন, করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে প্রতিস্থাপন করলে ভাইরাসটি মানুষের কোষের এসিই-২ (ACE-2) রিসিপ্টরের এর সাথে আবদ্ধ হয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারবে। উহানে ঘটা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ একই ধরণের হওয়ায়, অনেকেই ধারণা করে যে ডঃ শি ঝেংলি সার্স-কোভ-২ তৈরী হওয়ার গোপন তথ্য জানেন অথবা তার ল্যাবে সার্স-কোভ-২ তৈরী হয়ে থাকতে পারে। ভাইরোলজিস্টরা সম্ভবতঃ রিকম্বিনেশন পদ্ধতিতে স্পাইক প্রোটিনকে এমনভাবে পরিবর্তন করছে যেন খুব সহজেই মানুষের কোষের এসিই-২ (ACE-2) রিসেপ্টরের সাথে আবদ্ধ হয়ে ফিউশন ঘটাতে পারে । এছাড়াও ভাইরাসকে অতিমাত্রায় প্যাথজেনিক করার জন্য স্পাইকের S1 ও S2 অংশের এর মাঝে ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট সন্নিবিষ্ট করেছে। ফলে তৈরী হয়েছে সার্স-কোভ-২-এর মত মারাত্মক ভাইরাস যা দুর্ঘটনাবশতঃ বৈশ্বিক মহামারী সৃষ্টি করেছে। অথবা চীনা সরকার করোনাভাইরাস-ভিত্তিক জীবাণু বোমা তৈরী করার জন্য এইসব জীবাণু সংগ্রহ করছে। কোনটি সত্য? আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখতে পারেন!
ইউটিউব ভিডিও :
Sky News : করোনাভাইরাস সম্ভবত উহান ল্যাবে 'জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং' পরীক্ষায় তৈরী হয়েছে (Jun 1, 2020)
Cassiopeia Project: সিনথেটিক পোলিও ভাইরাস অনেক আগেই ল্যাবে তৈরী সম্ভব হয়েছে। এই টেকনোলজিতে নতুন ভাইরাস তৈরী সম্ভব। (Jul 25, 2008)
কৃতজ্ঞতাঃ
১. ছবি: আন্তর্জাল
২. Alexandre Hassanin-"Coronavirus origins: genome analysis suggests two viruses may have combined"
৩. Lawrence Sellin, "Explained: Scientific indications that show COVID-19 is man-made"
৪. Nerd Has Power Blog , "Scientific evidence and logic behind the claim that the Wuhan coronavirus is man-made"