ক্ষুধা
পঞ্চম বারের মতো কলিংবেলে আঙুল। এইবার ইচ্ছে করেই লম্বা সময়ের জন্য বাজলো। ভিতরে জীবিত কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। একেবারে সুনসান নীরবতা। অথচ আধা ঘন্টা আগেই এখান থেকে খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছে। প্যাকেটটা পায়ের কাছে রেখেছি। জানি ডেলিভ্যারি ম্যানের এটিকেটের সাথে কাজটা বেমানান। কিন্তু কতক্ষণ আর হাতে ধরে থাকা যায়। ওজন ভালোই! ছাতার মাথা কি আছে উপরওয়ালাই জানে। বানরের মাথা, কুমিরের ডিম, কুকুরের ভুড়ি, বিড়ালের বাচ্চা, সাপের খোলস...
গাটা গুলিয়ে উঠলো৷ ইচ্ছে করছে একটা সিগারেট ধরাতে। হাতটা চলেও গেছিলো পকেটে। পরে চিন্তাটা বাদ দিলাম৷ কাস্টোমারের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালে আবার উলটা পালটা রিভিউ দিয়ে বারোটা বাজিয়ে দেবে।
এই মুহূর্তে চাকরিটা জরুরি। শুরুতে একটা দুটো টিউশনিতে হাত খরচটা ভালোই চলছিলো । হুট করেই সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। এই চাকরিটা ক্যাম্পাসেরই এক সিনিয়র যেচে এসে দিলেন। বেতন শুনে তো আমার চান্দি গরম অবস্থা। তবে খটকা লেগেছিলো শর্তগুলো শুনে।
"ডেলিভারি সম্পর্কিত কোন কথা বাইরে আলোচনা করা যাবে না।" সর্বনাশ! শুরুতেই তো দেখি ফাইট ক্লাবের মতো ব্যাপার স্যাপার। হে হে করে হাসতে গিয়েও বড় ভাইয়ের কঠিন চেহারা দেখে হাসিটা গিলে ফেললাম।
"একটা রেস্টুরেন্ট থেকেই সব অর্ডারগুলো যাবে। এইটা হইলো তোমার সুবিধা। দৌড়াদৌড়ি কম। কিন্তু কাদের খাবার দিচ্ছো, কি দিচ্ছো, কোত্থেকে নিছো এইসব নিয়ে কোথাও কথা বলবা না।"
"জ্বি ভাই।"
"কখনো দেরী করবা না। রেস্টুরেন্ট থেকে তোমারে সময় বলে দেওয়া হবে। তার এক সেকেন্ড দেরী করা যাবে না।
মনে মনে বললাম " কস কি মমিন!"। কিন্তু মুখে বললাম, "জ্বি ভাই। নো টেনশন। কিন্তু ভাই চট্টগ্রামের রাস্তার যা অবস্থা। মাঝে মধ্যে দেরী হওয়া স্বাভাবিক।"
"তোমার ডেলিভারি শুরু হবে কাঁটায় কাঁটায় রাত ১২টার পর থেকে। রাস্তায় কোন সমস্যা হবে না। সমস্যা হলে জানিয়ে দেওয়া হবে।"
সমস্যা হলে জানিয়ে দেওয়া হবে!
আশ্চর্য ব্যাপার। তারা জানবে কিভাবে! আরো আশ্চর্যজনক ছিলো তাদের কন্ট্রাক্ট পেপার। এক গাদা কথা লেখা। বেশিরভাগই কাস্টোমারের সাথে আচরণ বিধি। নিচে মান্ধাতার পদ্ধতিতে টিপসই দিতে হয়েছে। পুরো লেখায় কোথাও নিয়োগ কর্তার নাম নেই। অবশ্য তার একটি কারণ এখন জানি। যে রেস্টুরেন্ট থেকে প্যাকেটগুলো আসে আসলে তারই কোন নাম নেই। অসম্ভব মোহনীয় করে সাজানো একটি রেস্টুরেন্ট। সাইজে জনা পঞ্চাশেক বসতে পারে এমন। নানা রকমের আলোর কারুকাজে ভেতরটা যেন এক ইন্দ্রপুরী। সাথে বাতাসে ভেসে বেড়ানো সুগন্ধ৷ ফুলের গন্ধ এবং পারফিউম বিষয়ে আমার জ্ঞান শুধু হাঁটুর নীচে না। বলা যায় পায়ের পাতায়। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই সুগন্ধের উৎস পৃথিবীতে নয়। অন্য কোথাও।
এত চমৎকার একটি জায়গায় আমি সহ কয়েক জন মাত্র মানুষ। প্রতিবার যাওয়ার পর দেখি কেউ একজন বসে আছেন। সামনে কফির পেয়ালা। কোন একটি টেবিলে একটি কফির পেয়ালা আমার জন্যেও রেখে দেওয়া। কেউ বলে দেয়নি। প্রথম থেকেই বুঝে নিয়েছি। এত চমৎকার কফি আমি আগে কখনো খায়নি। কফি শেষ হতেই ভোজবাজির মত কাউন্টারের উপর ডেলিভারির প্যাকেটটা হাজির হয়ে যায়৷ কে কখন সেটা রেখে গেলো চেষ্টা করেও কখনো দেখতে পাইনি।
প্রথম বারের পর থেকে নানান প্রশ্ন জমে উঠেছে। যেহেতু বাইরে কোথাও বলা যাবে না। সেই বড় ভাইকে বলতে গেছি। তিনি গম্ভীর মুখে সব শুনে কেবল একটি কথাই বলেছিলেন,
"তোমার কাস্টোমাররা ক্ষুধার্ত। তোমার কাজ টাইম মতো তাদের খাবার পৌছানো। দ্যাটস ইট।"
ইয়াপ! দ্যাটস ইট। অতি বুদ্ধিমান না হলেও খুব একটা বোকা নই। অনেক কিছুই নিজের মতো ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। যেমন শুরুতে ভেবেছিলাম প্যাকেটে ড্রাগ পাচার করা হয়। পরে সেটা বাতিল করেছি। কিন্তু বেশির ভাগ জিনিসেরই কোন কূল কিনারা করতে পারিনি। এত রাতেও এত অর্ডার কোত্থেকে আসে! প্যাকেটে আসলে কি থাকে! রেস্টুরেন্টটি কেন দিনের বেলায় বন্ধ থাকে! তবে সব কিছুর উপরে একটি ব্যাপার বুঝতে পেরেছি। কৌতূহলটা নিজের কাছে রাখাই উত্তম।
ভিতর থেকে শব্দ আসছে। ভারি ধাতব কিছু ফ্লোরের উপর দিয়ে টানলে যেমন শব্দ হয় তেমন। তারপর থপথপ করে কিছু একটা দরজার দিকে হেঁটে আসছে। শব্দের উপর ভর করে কল্পনায় প্রাণীটির শরীরটা দেখতে পাই। দরজার ওপার থেকে একটি ভারী কন্ঠস্বর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললো, "দরজার সামনে রেখে চলে যান।"
সরু খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে যখন নেমে যাচ্ছি। দরজা খোলার শব্দে অকারণে গায়ের লোম কাঁটা দিলো। তবু অভ্যস্ত প্রফেশনালিজমে ঘাড় সোজা রেখে নেমে গেলাম। একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিলো। বহুদিনের পুরাতন ডাস্টবিন ঘাটলে যেমন গন্ধ আসে। প্রথমবার গন্ধটা পেয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম। এখন আর হই না।
তৃষ্ণা
এমন তৃষ্ণা এর আগে কখনো অনুভব করি নি। গলার ভেতরটা যেন উত্তপ্ত দুপুরের হাইওয়ে। পাশের সিটের ওজনদার ভদ্রলোক তার সমগ্র ওজন নিয়ে পড়ে আছেন আমার পায়ের উপরে। কত জায়গায় ভেঙ্গেছে বুঝতে পারছি না। কোমরের নীচের অংশটুকু অনুভূতিহীন। যে পাশে বসেছিলাম, বাসটা পড়েছে তার উলটো পাশে। এই মুহুর্তে উলটো দিকের সিটের উপর এমন বেকায়দায় শুয়ে আছি। যাকে বলে একেবারে নট নরণ চরণ অবস্থা। পায়ের উপর উপুড় হয়ে থাকা ভদ্রলোককে ডাকলাম দুবার। সাড়া নেই। ব্যাটা সারা রাত মুখে খই ফুটিয়ে এখন শ্বাসটাও বন্ধ করে আছে।
মনে পড়ে আসার সময় মুকুলিকা একটা বড় বোতলে পানি দিয়েছিলো। মেটালিক বডি। হালকা নীল রঙ। বোতলটা ব্যাগে। কিন্তু ব্যাগটা কই! চারিদিকে এত ওলট পালট অবস্থা। মানুষগুলো সব উলটে পালটে পড়ে আছে। এদিকে ওদিকে নানান ব্যাগ। তবে যাক! অবশেষে নিজেরটা দেখতে পেলাম। দুই সিট পরেই। ইম্প্যাক্টের জোরে ছিটকে গেছিলো বোধহয়।
আশেপাশের মানুষগুলো পড়ে আছে ঝড়ে পড়া বকের মতো৷ প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায় কিছু। তবে তা ক্ষীয়মান। শরীর মুড়িয়ে আরো একবার ওঠার চেষ্টা করলাম। এবার পায়ের দিক থেকে এক অসহ্য ব্যাথা ঢেউয়ের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণে অনুভূত হলো পিঠের জ্বলুনিটাও। শার্টটাও পিছনে ভেজা ভেজা লাগছে। সোজা উপরের জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢোকায় ভেতরে এক আবছায়ার মিশেল তৈরি হয়েছে। বাইরের দুনিয়ায় এতক্ষণে সব কিছু জেগে ওঠার কথা। হয়তো হয়েছেও। কিন্তু বুঝতে পারছি না। সব অনুভূতি হার মেনে যাচ্ছে কেবল একটি অনুভূতির কাছে। খড়খড়ে জিহ্বা তালুতে আটকে আছে। শুকনো ঢোক দলা বেঁধে আছে গলায়। বারবার শুকনো জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা। অদূরেই পড়ে আছে ব্যাগটা। তবু যেন যোজন দূরে।
পকেট হাতড়ে ফোন বের করার চেষ্টা করলাম। নেই — পড়ে গেছে কোথাও৷ কারো সাথে কথা বলার চেয়ে সময় দেখার ইচ্ছেটাই বেশি কাজ করছে। কটা বাজে! সময়টা কি আসলেই থেমে আছে না কি উলটো দিকে যাচ্ছে!
প্রায় নিঃশব্দে একটি ছায়া শরীর জানালা গলে প্রবেশ করলো। ছিপছিপে খর্বকায় দেহ। তবে হাত পায়ের পাতা বড় বড়। বেশ ধন্ধে পড়ে গেলাম। এটা কি আমার কল্পনা না কি বাস্তব! এই কি তাহলে মৃত্যুদূত — মালাক আল মউত! সেই কল্পনা না বাস্তব - ফেরেশতা না মানুষ ছায়া শরীরটি কিছুক্ষণ এদিকে সেদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। কয়েকটা ব্যাগ তুলে ভিতরটা দেখে নিলো। দুটো দু কাঁধে ঝুলালো। শেষে আমার ব্যাগটা তুলে নিলো। ভিতর থেকে ল্যাপটপ আর পানির বোতলটা বের করে দেখলো।
নীল রঙের বোতলটা দেখে দপ করে মাথার পেছন টা জ্বলে উঠলো। কিভাবে কিভাবে যেন হঠাৎ ছায়া মূর্তির দৃষ্টি পড়লো আমার উপর। তার ভাটার মতো চোখের গোপন অভিসন্ধি বুঝতে পারার ক্ষমতা আমার নেই। শুকনো খরখড়ে গলায় কোন কথা বের হলো না। কেবল যে গভীর তৃষ্ণায় ডুবে আছি তার সামান্য অংশ হলেও আমার দু চোখে দেখাতে চাইলাম। যদি তার দয়া হয়। সে কি বুঝলো কে জানে। অন্য এক জানালা দিয়ে পূর্বের মতো পিছলে বেরিয়ে গেলো। ব্যাগসহ। মালাকাল মউতের ব্যাগের কি প্রয়োজন!
কাছেই কোথাও থেকে চাপা উচ্চস্বর ভেসে আসছে। কেউ বা কারা যেন কিছু বলছে।
"কিরে মালপত্র কিরাম?"
...
"লোকজন?"
...
"কস কি! যদি কইয়া দ্যায়..."
...
ভাঙ্গা ভাঙ্গা এসব সংলাপ ভিন জগতের প্রলাপ বলে ভ্রম হয়। ক্যাচ ক্যাচ করে কোথায় শব্দ হলো। চোখ মেলে দেখলাম ছায়া মূর্তি আবার উদয় হয়েছে — ঠিক আমার মাথার কাছে। তার চেহারাটা এবার অল্প অল্প দেখা যায়। চৌকোনা মুখ, নাকের উপর একটা বড় আঁচিল। হাতে নীল বোতলটা। এটা বলা হয়নি — আমার পছন্দের রঙ নীল। সে বোতলটা মাথার উপর তুলে এতো দ্রুত নামিয়ে আনলো যে নীল রংটা বাতাসে একটা বক্র রৈখিক তুলির আঁচড় তৈরি করলো।
ঘুম
এমন একটি রাত কাটাতে হবে ফাহিম কখনো ভাবে নি। কোন এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। অবচেতন মনের একটি অংশ নিজে থেকে ভাবতে থাকে। শুরুটা যেন কিভাবে হয়েছিলো?...ফ্যান...সিলিং ফ্যান...
ধুর শালা! সিলিং ফ্যানটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এতক্ষণ ঘট ঘট শব্দ করে তাও ঘুরছিলো। কিছু সময় মটকা মেরে শুয়ে থাকার পর ফাহিম উঠে বসে। প্রচন্ড বিরক্তিতে মেজাজের পারদ ধীরে ধীরে উর্ধ্বমুখী। একে তো ভিষণ গরম। এরই মধ্যে বুক পিঠ ঘামে ভিজে একাকার। ফ্যানের বিরতিহীন বিরক্তিকর শব্দে ঘুমটাও ঠিক মত হয় নি।
কটা বাজে? হাত ঘড়িতে দেখাচ্ছে ১:৪৭। এখনো অনেক রাত বাকি। ফাহিম অসহায় দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে তাকালো। উঠে দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে ফ্যানের উপরে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু দেখাই সার! ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রপাতির ব্যাপারে ওর কোন ধারণাই নেই।
ঘরের বাইরে একটা টানা বারান্দা। বারান্দায় কোন আলো নেই। ঘর থেকে আসা আলো আর আধখানি চাঁদের আধখানি আলোয় যা কিছু একটু দেখা যায়। ফাহিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোরে জোরে সিগারেট টানতে লাগলো। সিগারেটের ধোয়া ওকে ঘিরে আস্তে আস্তে ধুম্রজাল তৈরি করছে। এরকম নির্জন রাতে সামনের জায়গাটা কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
বারান্দার সামনে এক টুকরা জংলার মত জায়গা। বেশ লম্বা দুটো জোড়া নারকেল গাছ। জংলার পরে শেওলাপড়া কালো রঙের সীমানা প্রাচীর। প্রাচীর বেশ অনেক খানি উঁচু। উপরে কাঁটাতারের বেড়া। চোখের দৃষ্টি ওই দেওয়াল টপকে অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই৷ জংলায় অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। আর আছে মশার দল। সেই সব পালোয়ান মশা অতি সত্বর ফাহিমের উপস্থিতি টের পেয়ে গেলো।
নাহ! এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদ। হাঁটতে হবে। ফাহিম যে ঘরে আছে। সেটি বারান্দার এক প্রান্তে। ঠিক অপর প্রান্তের একটি ঘরে আলো জ্বলছে। সে সেদিকে হাঁটা দিলো। ও ঘরে যদি কেউ থাকে তাহলে অন্তত পরিচিত হওয়া যাবে।
ঘরটার দরজা জানালা বন্ধ। বন্ধ কাচের জানালার ভিতর দিয়ে একজনকে দেখা যায়। মাঝবয়সী, পরণে চেক লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া, স্টিলের স্ট্রেচারের উপর শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে বোধহয়! ভাবে ফাহিম। তাহলে নক করা ঠিক হবে না। আবার নিজের ঘরের সামনে ফিরে এলো। মন মেজাজটা এমনই বিগড়ে আছে। কারো উপর ঝাল মেটাতে ইচ্ছা করছে। এ ব্যাপারে মঈনের চেয়ে ভালো ক্যান্ডিডেট এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। আজকে ওর জন্যেই তো এই নরকবাস।
"এই ব্যাটা বদ।"
ফোনের অন্যপাশে মঈনের গা জ্বালানো হাসি শোনা গেলো। "ঘুমাস নাই ক্যান? ফ্যানের জন্য সমস্যা হচ্ছে?"
"এতক্ষণ হচ্ছিলো। এখন সমস্যা মিটে গেছে।"
"মানে কি?" মঈন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"মানে তোর ফ্যান আমারে ঘুম পাড়াইতে গিয়া নিজে ঘুমায় গেছে। এতক্ষণ শব্দের যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারি নাই। এখন গরমের যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারতেছি না।''
"তোর কপাল তো সেইরকম ভালো।"
"আমাকে এখানে ফেলে রেখে নিজে তো আরাম করতেছিস। গরম, মশা সব মিলিয়ে অবস্থা কেরোসিন। তুই এই রুমে ঘুমাস ক্যামনে?"
"আমি তো এই রুমে ঘুমাই না। আমার রুম বারান্দার অন্য মাথায়। এই কয়দিন ঐখানেই ছিলাম। আজ রাতটাই যেহেতু শেষ ডিউটি। তাই মালপত্র সব সরিয়ে এনেছি। অবশ্য আমি আনি নাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এনেছে। ঘরটা তাদের দরকার ছিলো। আমি আপত্তি করিনি। রাতে তো আমার থাকা হতো না। তুই যে আসবি তাও তো জানতাম না।"
"ও ঘরে একজনকে দেখলাম। কে উনি?"
"কে উনি এইটা বলা মুশকিল। গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখ। যদি কিছু জানতে পারিস তাইলে জানাস।"
"ঘটনা পরিষ্কার কর। এই গরমে তোর সাথে কথা চালাচালি খেলতে বিরক্ত লাগছে।"
"ঘটনা তেমন কিছু না। আজকে রাতের দিকে এই ভদ্রলোককে কিছু লোক ধরাধরি করে ক্লিনিকে আনছিলো। পরে দেখলাম সে আনার আগেই মারা গেছে। সম্ভবত মাতাল ছিলো৷ লাশের সাথের লোকজন লাশ রেখেই গায়েব। এখন সকালের আগে লাশটা সদরেও পাঠানো যাবে না। ড্রাইভার রাজি হবে না। আমাদের ছোট একটা মর্গ আছে। কিন্তু ব্যবহারের অনুপোযোগী। তাই আমার রুমটাকে আজ রাতের জন্য টেম্পোরারি মর্গ বানানো হয়েছে।"
"এরকম আবার হয় না কি!"
"এটা বাংলাদেশ ভাইজান। আর এরকম সস্তা ক্লিনিকে লাশ যে রাস্তায় ফেলে দেয়নি এটাই তো বড় ব্যাপার।"
ফাহিম ভ্রু কুঁচকে মঈনের কথা শুনলো। সত্যি বলতে এরকম কাহিনী শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। লোকটাকে দেখে তার লাশ বলে মনে হয় নি। পেটটাও কি উঁচু নীচু হচ্ছিলো না? শ্বাস নিলে যেমন হয়! নাহ — দেখার ভুল হবে নিশ্চয়ই।
"কিরে চুপ করে গেলি ক্যান?" মঈন জিজ্ঞেস করলো।
"নাহ। কিছু না।"
"তোরে একটা ভালো উপদেশ দেই?"
ফাহিমের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে মঈনের এই স্ব ঘোষিত ভালো উপদেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অকাজের হয়। তারপরেও শুকনো মুখে বললো, "কি উপদেশ?"
"সারা রাত জেগে কষ্ট করবি! তার চেয়ে ভালো ঐ রুমের লক খোলা আছে। তুই কাঁথা বালিশ বোগলে নিয়া ঐখানে গিয়া ঘুম দে। ওখানে খাট আছে। সমস্যা হবে না। তাছাড়া লাশের চেয়ে ভালো রুমমেট আর নাই। দেখ তোকে সে ডিস্টার্ব করবে না। আবার রুমে তোর একা একাও লাগবে না। ডাবল ফায়দা। টানা একটা ঘুম দিয়ে রাত পার করে দে। ভোর হলে লাশ এমনিতেই নিয়ে যাবে।"
ফাহিম গম্ভীর গলায় বললো, "দরকার নাই। বালিশ চাদর টানাটানি...ঝামেলা।"
"ঝামেলা? না কি ডরাইছস?"
"ডরানোর কি আছে!"
"আমার মত পাবলিকের জন্যে আছে। তুমি তো নিজেরে ফাহিম দা লায়ন হার্ট দাবি করো। তুমি ডরাইবা কেন! এক রাত লাশের সাথে থাকলে না হয় বাকী জীবনে কিছু গল্প দিতে পারবি। আমিও মেনে নেবো তোর সাহস আছে।"
ফোনের অন্যপাশে মঈনের বিটকেল মার্কা হাসি শোনা যাচ্ছে। ফাহিমের হাতটা নিশপিশ করতে লাগলো। ব্যাটাকে সামনে পাইলে খবর ছিলো।
***
ফাহিম সটান চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। নজর ছাদের দিকে। কিন্তু বেশিক্ষণ সেদিকে থাকলো না৷ মাথা ঘুরিয়ে রুমের অন্য প্রান্তে লোকটাকে দেখে নিলো। আরো একবারের মতো। গত এক ঘন্টায় এ নিয়ে সতেরো বার। অথচ লোকটা দৃষ্টি আকর্ষণের মতো কিছুই করছে না। চুপচাপ শুয়ে আছে স্টিলের স্ট্রেচারের উপর। পা সোজা, হাত বুকের উপর ভাঁজ করা। চোখ বন্ধ। কি আশ্চর্য! দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে।
ফাহিম অস্বস্তি বোধ করছে। সেই শুরু থেকেই। কারণটা ঠিক পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না। অস্বস্তির সাথে লোকটার যোগ সূত্রটাও ঠিক ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু যোগ সূত্র আছে এটা নিশ্চিত।
প্রথমে ফাহিম একেবারে দপদপিয়ে রুমে এসে ঢুকেছিলো। থোড়াই কেয়ার এমন ভাব। স্ট্রেচারটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলো একপাশে। লোকটার চেহারা এক ঝলক চোখে পড়েছিলো তখন। ছোট্ট একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলো। আসলে কি প্রত্যাশা করেছিলো সেটা ঠিক মতো না জানলেও অন্তত এতটা স্বাভাবিক চেহারা আশা করেনি।
বিছানায় দুই ঝাড়ুর বাড়ি মেরে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। কিন্তু শোয়ার পর থেকেই শুরু হলো ঝামেলা।
মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর মনে হলো শীতের পরিমাণ বেশি। এসিটা কমাতে পারলে ভালো হতো। খুঁজে পেতে নিয়ে রিমোট হাতে লোকটার দিকে আড় চোখে দেখে নিলো। সে কি আপত্তি করবে! ধুর! মরার আমার আপত্তি কি!
শুয়ে চোখ বুজতেই কানের কাছে মশক সঙ্গীত শোনা যেতে লাগলো। হয়তো মশাগুলো মৃত লোকটার উপর নানা এক্সপেরিমেন্ট করে এতক্ষণ বিরক্ত হয়ে পড়েছিলো। এখন ফাহিমের মত তরতাজা প্রাণী পেয়ে নতুন উদ্দমে ঝাপিয়ে পড়েছে।
মশকী নিধনের ব্যবস্থা করা হলো। অতপর পুনরায় শয্যা গ্রহণ।
শুয়ে শুয়ে ঘুমটা কেবল আসি আসি করছে। তবু কেন জানি আসছে না! বিষয়টা কি! তাকে আটকাচ্ছে কে?
শক্ত বিছানা। এলোমেলো তক্তাপোশের কারণে পিঠের নীচে খোঁচা লাগছে। বেশিক্ষণ তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। এক সময় উঠে গিয়ে পাতলা তোষক তুলে আনা হলো। তোষক বিছিয়ে তার উপর চাদর বিছিয়ে তবে শান্তি।
শান্তি! শান্তি? — বন্ধ চোখের পাতার উপর কমলা রঙের আভা। রুমের বাতি জ্বলছে। ফাহিম কখনো বাতি জ্বালিয়ে ঘুমায়নি। বাড়িতে পুরোপুরি অন্ধকার ঘর ছাড়া সে কখনো ঘুমাতে পারে না। কতক্ষণ চেষ্টা করলো ঠিক নেই। বেশ খানিক ক্ষণ হবে। এক সময় উঠে পড়লো। দ্বিধা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ঘরের অন্য বাসিন্দার দিকে। ভূতটুতে সে বিশ্বাস করে না। তবু মনটা খচ খচ করছে। লোকটা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ফাহিমের কর্মকান্ডে নিজস্ব মতামত দেওয়ার চেষ্টা করতো। হয়তো অনেক বিষয় নিয়েই তার ওজর আপত্তি থাকতো। অথচ দেখো! কোন কিছুই নিয়েই কোন ট্যাঁ ফুঁ নেই। "কি শান্তির ঘুমটাই না দিচ্ছে ব্যাটা।" ফাহিম আনমনেই বললো। ওর কি হিংসে হচ্ছে! ধুর! নিজের মাথায় নিজে থাপ্পড় দিয়ে চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলতো চাইলো। উন্মাদের মত কী সব ভাবছে সে!
বাতি নিভানোর পরেও ঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়নি। জানালার কাচ ভেদ করে একটা ঘোলা আলো ঘরে প্রবেশ করছে। ফাহিম চোখ খুলেই শুয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার চোখে সয়ে আসলে লোকটার দিকে আর একবার তাকালো। তার অবয়ব বেশ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে সাদা লুঙ্গি আর ফতুয়া অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। গায়ের উপর একটা চাদর দিয়ে আসবে না কি! না থাক।
চোখের পাতা বন্ধ করার পর এবার সামনে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এলো। প্রশান্তির একটি ঘুম নেমে আসবে নিশ্চয়ই। কিন্তু কই! একটু পর অন্ধকার গাঢ় হতে হতে হুট করে একটা নীল রঙ্গের চুলের ব্যান্ড ভেসে উঠল। নানা রঙের এক পাতা টিপ। কার এসব কিছু? — মা? শাই শাই করে একগাদা স্লাইড ভেসে গিয়ে হুট করে স্থির হলো একটা গাড়ি। ভিতরে বাবা আর মা। একটু পড়ে গাড়িটাতে আগুন জ্বলে উঠলো। জ্বলন্ত গাড়িটা তবুও চলতে থাকলো। চলতে চলতে হঠাৎ দেখা গেলো গাড়িটা ওর দিকেই তাড়া করে আসছে। ফাহিম ছুটতে লাগলো। কোথায় কোনদিকে ছুটছে তার ঠিক নেই। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত তেপান্তরের মাঠ। কোথাও কোন বাঁধা নেই। তবু মুক্তির কোন পথ নেই। দিক বিদিক হীন ছুটতে থাকা ফাহিমের বুকে একরাশ ভয় চেপে বসলো। গাড়িটা তাকে পিশে ফেললো বলে।
এর মধ্যে মাঝবয়সী এক লোক উদয় হলো। খুব দ্রুত গতিতে ফাহিমকে পাশ কাটিয়ে ছুটছে। তাকে আগে কোথাও দেখেছে সে। হাত ইশারায় লোকটা ফাহিমকে নিজের পিছনে ছুটতে বললো।
সামনেই একটা গিরিখাদ। ভিতরটা জমাট অন্ধকার। ফাহিম বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। লোকটা ও দিকে ছুটছে কেন! একটু পরেই গিরিখাদের অন্য কিনারায় দেখা গেলো তাকে। হাত ইশারায় ফাহিমকে থামতে মানা করছে। ফাহিম জ্বলন্ত আগুনের তাপ অনুভব করলো। পেছনে যান্ত্রিক আওয়াজ। সে প্রচন্ড গতিতে ছুটে গিয়ে গিরিখাদের একদম কিনারা থেকে লাফ দিলো। কিছুক্ষণ শূনের মাঝে এগিয়ে গিয়ে ঝপ করে গাঢ অন্ধকারে পড়ে গেল। পড়ে যেতে থাকলো।
দূরে কোথাও থেকে আজানের ধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। জানালা থেকে আসা আলোয় ঘরের অন্ধকার ভাবটা অনেকটাই কেটে গেছে। রাত শেষ হয়ে গেছে তা বোঝা যায়। ফাহিম সারা শরীরে একটা ঝাকুনি অনুভব করে উঠে বসে আবিষ্কার করলো এসিটা বন্ধ। সম্ভবত কারেন্ট চলে গেছে। এরই মধ্যে বুক পিঠ ঘামে ভিজে একাকার।
ফাহিমের পুরো শরীর মন জুড়ে কোন এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। একটু আগে কি দেখেছিলো কিছুই মনে পড়লো না। তবে কিছু একটা দেখেছিলো সেটা মনে পড়ে। মাথাটা ঝিম মেরে আছে। চোখ দুটো কড় কড় করছে। সে প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়ে স্ট্রেচারে শোয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি নিশ্চিন্ত ভাবেই না লোকটা ঘুমিয়ে আছে! দুনিয়ার কোন কিছু নিয়েই কোন আপত্তি নেই তার। মনে পড়লো বহুদিন ধরেই সে এমনভাবে ঘুমাতে চেয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৩৬