----------
মুক্ত মালার ছাতি মাথায় বর্ষা এলা রে
সারা গায়ে গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিলো রে.....
ফাকে ফাকে আকাশের ঘেমে ওঠা দেখলেই বর্ষার সম্ভাবনায় একটা মানসিক প্রস্তুতি চলে আসে। রংয়ের পসরা সাজিয়ে ময়ুর মেখম মেলে দেয় উম্মুক্ত নীলের পানে। চাতক তার লম্বা ঠোটে বৃস্টিকে স্বাগত জানাবার ইচ্ছায় অধীর আগ্রহে সময়ের পালা গোনে।
এখানে এখন ময়ুরও রনই চাতকও নেই। এই জনারন্যে ওদের পাবো কোথায়। হয়তো এজন্যই ময়ুরের বদলে আকাশটা নিজেই কেমন পেখম মেলে আছে। বৃস্টি হবে নাকি!! হলে হোক, না হলে না হোক। বিশেষ কিছু যায় আসে না।
বৃস্টি আমার অত বেশী প্রিয় নয়। রাস্তায় হাটতে চলতে যদি গায়ে কাঁদা লাগে তাতে দারুন বিরক্তি ধরে। ছোটবেলায় অবশ্য বৃস্টিতে ভিজতে মজা লাগত।কিন্তু ভয়ে নামা যেতনা। অপেক্ষায় থাকতাম কখন বন্যা হবে, ঘরে পানি উঠবে, পানির মধ্যে পা ভিজিয়ে হাটবো। কাগজ দিয়ে নৌকা বানিয়ে পাল উড়াবো। বন্যা আসে বন্যা যায় বন্যায় দেশ ডুবে মরে কিন্তু আমার ঘরে পানি আর ওঠেনা, পুরন হয়না পা ভিজানোর শখ।
-----------
এখনও আষাঢ় আসেনি। এত আগে ভাগেই আষাঢ়ে গল্প শুরু করা উচিত হবে কিনা তাই নিয়ে প্রকৃতিতে দ্বিধাদ্বন্দ কাজ করছে। একবার মেঘকালো হয় আবার ফিকে হয়ে সূর্যের দেখা মেলে। একসময় সত্যিই বৃস্টি নামে। নামলেই ভালো। কাজ বন্ধ করে বসে থাকা যায়। কাঠালের ঘ্রান আসছে। সাথে আরো কিছু দরকার। তাহলে জমবে ভালো। আয়োজন হোক তারপর একসাথে বসা যাবে। আচ্ছা এই ফাকে কি একটু পিছনের দিনগুলোতে ঘুরে আসার অনুমতি দেয়া যায়!
------------
আকাশে গুড় গুড় করছে। যাবো কি যাবো না, বের হবো কি হবো না করতে করতে গাড়িতে চেপে বসি। আস্তে আস্তে আকাশ পরিস্কার হয়ে যায়। সামনের সিটে একজনের এলোকেশ বাতাসে ওড়াওড়ি করছে। ভালই লাগছে । একসময় পথ শেষ হয়ে যায় তবে ভাললাগা শেষ হয় না। অগত্যা একতরফা ভাললাগাকে বিদায় জানিয়ে সুপারভাইজারের কথা মত বাম পা দিয়ে মাটি স্পর্শ করি।
বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠি। আঁকা বাঁকা মেঠো পথের সোদা গন্ধ গায়ে মেখে, নির্জন বাঁশের সাঁকো পার হয়ে একসময় আমি সত্যিই পৌছে গেলাম সেই ছায়াকুটিরে, যেখানে আমার শেকড় গ্রন্থিত আছে পরম মমতায়। এক বৃদ্ধার প্রতীক্ষীত চাহনী আর চোখের পানিতে সে শেকর দিনে দিনে শক্তিমান হয়ে ওঠে।
-----------
শেষ বিকেলের আলোয় বাশঝাঁড়ের তলায় দাড়িয়ে বুক ভরা নিশ্বাসে তুলে নেই ডাহুকীর একটানা বিরহের সুর, নতুন পানির খুশীতে কোলাব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, সবুজ পাতার শিরশির ঝিরঝির আর বিচিত্র ধরনের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। বাশবাগানের মাথার উপর এখনও চাঁদ ওঠেনি।
ঝুপ করা সন্ধ্যা নেমে আসে পশ্চিম লালিমায় আধার মেখে, সাথী হয়ে আসে বৃস্টি। টিনের চালে টুপ টাপ ছন্দের তালে মনের গহীনে নাচতে থাকে সেই বুস্টি দিনের ছড়া
বৃস্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায় রে
লুকিয়ে গেলো বাশবনে
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দুরে দেয়া যে......
সেযুগে মনে হয় ফেরী ছিলনা সবাই খেয়াতে পার হতো। এখনকার যুগে হলে ছড়াটা এ রকম হতে পারতো।
নদীতে নাই ফেরী যে
আজকে হলো দেরী যে...
-----------
সেই ক্লাশ থ্রি'র যুগে হয়তো মায়ের চোখ এড়াতে পারলেই বৃস্টিতে নেমে যেতাম। বাধভাঙা উল্লাস অতঃপর অবধারিত পিটুনী। সুযোগ থাকলেও এখন আর বৃস্টিতে ভিজতে যাইনা। নিজেরা স্ব-অধীনতায় বেধে নিয়েছি যান্ত্রিক নগর জীবন। আর বৃদ্ধাদেরকে পাহারা দেই। একদিন আমরা যেমন তাদের অবাধ্য ছিলাম আজ তারা অবাধ্য আমাদের। নিজেকে শেষ করে দিয়ে হলেও আমাদের সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার প্রানান্ত প্রচেস্টা। তসবিহর দানা গুনতে গুনতে আমার দৃস্টিকে ফাঁকি দিয়ে টুপটাপ বৃস্টিতে কখন যেন নেমে পড়েন।
-----------
কাজ শেষ করে ভেজা রান্নাঘর থেকে উঠে আসেন বৃদ্ধা, যথারীতি ঠোটে ঝুলে থাকে অকৃত্রিম হাসির পরশ। টুকটাক এদিক ওদিক করে একসময় খাটের নিচ থেকে কি একটা বের করে বসে পড়েন। আমি কৌতুহলে তাকিয়ে দেখি আর কিছু নয় একটা আস্ত কাঠাল। আহ, কাঠাল। আম জাম লিচু কাঠালের এই মধু মাসে কাঠাল সে বড় লোভনীয়, উপাদেয় এক।
হাতে সরিষার তেল মেখে দাদী কাঠাল ভাঙতে থাকেন। খইয়ের সাথে মিস্টি কাঠালের গোল্লা মুখে পুড়ে আমি ভাঙতে থাকি বর্ষনমুখর সাঁঝের নিরবতা।
------------
দেখতে দেখতে সময় বয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় আমার আষাঢ়ে গল্প। স্মৃতি যতই তাড়িয়ে বেড়াক কাজের তাকিদে সবাই উঠে পড়ে। আমাকেও উঠতে হয়।
কোথায় যাবো, বাইরে যে সত্যিই বৃস্টি পড়ছে। আষাঢ় কি তাহলে এসে গেল!!