সংসারের বিপর্যয় কিংবা অবক্ষয় যাই বলি, সেই নোংরা স্রোতে বাহার আজ উদভ্রান্ত।স্কুলের মাইনের সমস্থ টাকা সংসারে ভুর্তুকি দিয়েও তার কন্যা সন্তানের মুখে এক ফোটা দুধ জোটেনা।আর সংসারের বহুরুপি হিংস্র অনিষ্টকারী, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার প্রলয়ঙ্করী অগ্নি দহনে বাহারের সংসার ক্রমেই পুড়ে ছাই হচ্ছে।সে ছাই ঘূর্ণি বাতাসে সমস্থ ঝাপসা করে দেয়।সেখানে বাহারের সংসার হাতড়ে হাতড়ে একটু নিশ্বাস ফেলার যায়গা টুকু পায়না।ধুকে ধুকে বাঁচবার তাড়নায় তার বদ্ধ জীবন ঘুরপাক খায়।জীবন বৃত্ত পথে তার এমনি করুণ বিচরণ।হটাৎ একদিন মেয়ের দুধ খাওয়া প্রসঙ্গে শাস্তণবাণুর কুটুক্তি বাহারের কানে গেলে, নিজের প্রতি ঘৃনা তিক্ততায় তার শরীরের সমস্থ রক্ত যেন বের হয়ে আসতে চাইছে।সে এক পাগলা উন্মাদনা, নিজের অসহায়ত্তের প্রতি প্রচন্ড ঘৃনায় শিশু সন্তান কে কল্পনার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বাড়ির সামনে কুয়ায় নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল।মানুষের আকষ্মিক বাধা টানা হেচড়ায় কোন মতে শিশুর প্রাণ রক্ষা হল।অথচ এত বড় উদ্রেককারী ঘটনাবহুল পরিস্থিতিতেও শাস্তণবাণু অবিচল।তার শয়তানী আত্মায় অনুকম্পা হয়না।তপ্ত তেজে সে সমাগত মানুষ কে বলতে থাকে বৌ পোলাপান চালানোর মুরোদ নেই,কি করবে কোলের শিশু কে ডুবাতে গিয়েছিল, কি বলব দু;খের কথা এমনি মরার সংসার আমার ।স্বামীর সংসারে সুখ পাইনি, তাই ভেবেছিলাম ছেলে বিয়ে দিয়ে সুখ করব, তাকি কপালে সইবার,বড় লোকের বেটি সংসারে কাজ কামে মন নাই, কিছু বললেই মুখে মুখে কথা বলে।আমরাও বৌ ছিলাম, শ্বাশুড়িকে দেখলে ভয়ে কথা বন্ধ হয়ে যেত, একেই বলে বউ কাল,এখন বউরাই সব, সব হবেনা কি জন্য? স্বামীরা যে বউ ভাঁড়ু যদি আমার স্বামীর মত হত, কথায় কথায় মার খেত, তাহলেই ঠিক ছিল। এই রুপ অযাচিত প্যাচালে জনমানুষের কাছে শিশু নিক্ষেপের ঘটনার যেটুকু গুরুত্ব ছিল, তার অনেকটাই হালকা হয়ে গেল।পাড়ার কিছু মহিলারা যারা শাস্তণবাণু শ্রেণীর তারা শাস্তণ শাস্ত্রে সুর মেলাল। শাস্তণের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞ্যাপন করে বলতে লাগল, আর বলিস না বোন এখনকার যুগে বউরাই সব স্বামীরাই বউ।বয়স হয়েছে-সংসারের খাটাখাটুনি করে স্বামীর মন পাইনি, এখন একটু আরাম করব-তা কি আর কপালে আছে এ যে বৌ রাজার কাল। কালে কালে অারও কত কি………………..?কল্পনার মুখ বরাবর-ই বন্ধ। অভিযোগ অনুযোগের জিজ্ঞাসা তার নিজের কাছে।আজ তার মনে হতে লাগল এভাবে আর কত কাল।নিজের সাধ্য ছাড়িয়ে গিয়েও কুলের দেখা মিলেনা।আজ তার জীবনের গল্প নিবু নিবু। বুকের ধন কন্যাকে কোন মতে ফিরে পেয়েছে।জীবন সাঁজানোর উপলক্ষ অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, এ সংসারে কিছুই জোটেনি স্বামীর ভালবাসা ছাড়া।ভালোবাসা উপেক্ষিত করার সাহস তার নেই, তাই এমন অনলে বিচরণ করতে তার বাধা ছিলনা, কিন্তু আজ নিজের সন্তানের দিকে তাকালে এসব দায়বদ্ধতার ভাষা তার কাছে ঝাপসা হয়ে যায়।ঘটনা লোক মুখে প্রসারিত হয়ে কল্পনার বাপের বাড়ি পোঁছে গেল।সেখান থেকে লোক এল কল্পনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।কল্পনার চোখ মুখের ভাষা স্তব্ধ। বাহারের সমস্থ ভাবনা কল্পনার স্তব্ধতার মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে কি যেন খুঁজছিল।শ্বশুর বাড়ির লোকের কাছে নিজের স্বকীয়তা অনেক আগেই লুপ্ত হয়েছে। তাই শ্যালক থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে কল্পনাকে পলকে পলকে বাহার লক্ষ্য করতে ছিল।এক ধরনের শুণ্যতা, এক ধরণের অশনি সংকেত বাহারের মনে কেমন করে যেন ঝড় তোলে।স্ত্রীকে যথার্তই তার জানা, কিন্তু সেই চীর চেনা স্ত্রীকে আজ অচেনা লাগছে।বাহারের লোকানো দৃষ্টি দেখল, কল্পনার ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কোন অনুকম্পা নেই, এ সংসারের প্রতি যেন তার কোন পিছুটান নেই।বাহার কেউ সে তার মধ্যে খুঁজে না, খুঁজলে সে হৃদয় এতক্ষনে জানান দিত।বাহারের বুঝতে বাঁকি রইলোনা স্ত্রীর বিদগ্ধ আত্মা যে টানে আজ ছুটে চলেছে সে পথ তার একান্ত। সত্যের মাঝে কঠিন সত্যকে উন্মুক্ত করার দিন আজ। আমি অক্ষম, আমি অপারক এ আমার আজন্ম কলঙ্ক,কিন্তু ভালবাসা দিয়ে সত্যকে বাঁধার প্রচেষ্টা কম ছিলনা আমার।আজ যদি এ সত্য উপেক্ষিত হয়, তাহলে জীবনের শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হয়ত থাকবেনা, তবুও মিথ্যাকে আলিঙ্গন করে জীবন কে ধুকে ধুকে মরতে না দিয়ে সত্যের সন্ধানে যাযাবর হওয়াতে স্বার্থকতা আছে।কল্পনা চলে গেল, যাওয়ার সময় বাড়ির সামনের পথে বাহারের খুবই কাছাকাছি চুপিসারে বলে গেল, আমি চললাম তুমি বাবুকে দেখতে যেও।এর পর ঘোড়ার গাড়িতে চলন্ত পথে যতদুর চোখ যায়, কল্পনার আড় চোখের স্থীর দৃষ্টি বাহারের দিকে চেয়ে রয়।দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে কল্পনা চলে গেলেও বাহারের বুকে সে স্থীর দৃষ্টির রেখাপাত জীবন্ত হয়ে হৃদয় পটে আঁকা হয়ে রইল।বাহারের লক্ষ স্মৃতির ভিড়ে এই জীবন্ত স্মৃতির আধিপত্য তার সমস্থ চেতনায় অস্থির জোয়ারের মত বেগবান হতে লাগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৬ রাত ১০:০৩